ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

স্যানিটারি প্যাড তৈরির গল্প জিতে নিল অস্কার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:১২ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৯:১৪ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সোমবার

স্নেহার বয়স যখন ১৫, তখন তার ঋতুস্রাব শুরু হয়। প্রথমবার তিনি যখন নিজের মাসিকের রক্ত দেখেছিলেন, তখনও এ বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না।

"আমি খুবই ভয় পেয়ে যাই। ভেবেছিলাম হয়তো ভয়ানক এক অসুখ হয়েছে। তখন আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম," বলছিলেন স্নেহা, দিল্লির কাছেই তার গ্রাম কাথিখেরায়, নিজের বাসায়।

"মাকে বলার মতো সাহস ছিল না। তাই আমি খালাকে জানাই। তিনি বলেছিলেন, `কেঁদো না। তুমি এখন একজন নারী হয়ে উঠেছ। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।` তারপর তিনিই আমার মাকে জানান।"

স্নেহা এখন ২২ বছরের তরুণী। কাজ করছেন গ্রামের ছোট্ট একটি কারখানায়, যেখানে স্যানিটারি প্যাড তৈরি করা হয়।

তার এই গল্প নিয়ে নির্মিত একটি তথ্যচিত্র এবারের অস্কার পুরস্কার পেয়েছে। তথ্যচিত্রটির নাম "পিরিয়ড। এন্ড অফ সেন্টেন্স।"

উত্তর হলিউডের কিছু শিক্ষার্থীর প্রযোজনায় একজন ইরানি-মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়কা জেতাবচি তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে স্নেহার গ্রামে গিয়েছিলেন।

ভারতের রাজধানী দিল্লির চাকচিক্য থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরে, হাপুর জেলাতে এই কাথিখেরা গ্রামটি।

এই তথ্যচিত্রে চিত্রায়িত হয়েছে গ্রামটির শস্য খেত, স্কুলের শ্রেণীকক্ষ। ভারতের বাকি অংশের মতো এই গ্রামেও নারীদের মাসিক যেন একটি নিষিদ্ধ ব্যাপার।

ঋতুস্রাব চলাকালে নারীরা বিবেচিত হন অশুচি হিসেবে। ধর্মীয় স্থানে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। তাদেরকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে দেওয়া হয় না।

স্নেহা বলছিলেন, "এটি নিয়ে কখনোই কোনো আলোচনা হয় না, এমনকি মেয়েদের নিজেদের মধ্যেও।"

তবে `অ্যাকশন ইন্ডিয়া` নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান যখন নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করতে শুরু করে এবং কাথিখেরা গ্রামে স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদনের জন্যে একটি কারখানা স্থাপন করে, তখন থেকে এই অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়।

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে, সুমন নামে এক প্রতিবেশী, যিনি অ্যাকশন ইন্ডিয়াতে কাজ করতেন, স্নেহাকে ঐ কারখানায় কাজের কথা বলেন।

কলেজ পাশ করে স্নেহা স্বপ্ন দেখতেন দিল্লিতে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করবেন। কারখানায় কাজের এই প্রস্তাবে উত্তেজিত হয়ে পড়েন তিনি। কেননা গ্রামটিতে চাকরির কোন সুযোগ ছিল না।

স্নেহা বলেন, তিনি যখন তার মায়ের কাছে এবিষয়ে অনুমতি নেওয়ার জন্যে যান- তখন তার মা তার বাবার কাছে অনুমতি চাইতে বলেন। কেননা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো সাধারণত পুরুষরাই নিয়ে থাকেন।

কিন্তু স্নেহা স্যানিটারি প্যাড তৈরি করবেন এ কথাটি তার বাবাকে বলতে খুবই সংকোচ বোধ করছিলেন। তাই বাবাকে জানালেন যে তিনি শিশুদের জন্যে ডায়াপার তৈরির একটি কারখানায় কাজ করবেন।

এর মাস দুয়েক পরে তার মা বিষয়টি খোলাসা করেন তার বাবার কাছে।

এখন ওই কারখানায় ১৮ থেকে ৩১ বছর বয়সী সাতজন নারী কাজ করেন। মাসে বেতন পান আড়াই হাজার রুপি। সেখানে দিনে ৬০০টি প্যাড উৎপাদন করা হয় যা `ফ্লাই` নামে বাজারজাত করা হয়।

স্নেহা বলছিলেন, "এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো কাজের সময়ে বিদ্যুৎ চলে যাওয়া। অনেক সময় টার্গেট পূরণের জন্যে বিদ্যুৎ এলে রাতেও কাজ করি।"

গ্রামের একটি বাড়ির দুটি কক্ষ নিয়ে এই ক্ষুদ্র ব্যবসাটি চালানো হয়, যা সেখানকার নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করছে।

এটি প্রতিষ্ঠার আগে গ্রামের বেশিরভাগ নারী মাসিকের সময় পুরনো শাড়ি বা বিছানার চাদর কেটে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করছেন অন্তত ৭০ শতাংশ নারী।

এমন একটি রক্ষণশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন মাত্র কয়েক বছর আগেও ছিল অকল্পনীয়।

স্নেহা বলছেন, মেয়েদের পিরিয়ড নিয়ে এখন খোলাখুলিই আলোচনা হয় নারীদের মধ্যে। তবে বিষয়টি এত সহজে হয়নি।

"শুরুতে খুবই কঠিন ছিল। আমাকে কাজের পাশাপাশি মায়ের ঘরের কাজে সাহায্য করতে হতো, পাশাপাশি পড়ালেখাও চালিয়ে যেতে হতো। মাঝে মধ্যে পরীক্ষা চলার সময় চাপ বেড়ে গেলে আমার মা-ই আমার পরিবর্তে কাজে যেতেন।"

তার বাবা রাজেন্দ্র সিং তানওয়ার এখন তার মেয়ের কাজ নিয়ে গর্বিত। তিনি বলেন,"যদি তার কাজ সমাজকে, বিশেষত মহিলাদের উপকার করে, তবে তা নিয়ে আমি খুশি।"

প্রথমদিকে, এই কারখানায় কাজ করতে আসা নারীদের গ্রামবাসীর বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারখানায় কী হয় সেটা নিয়ে অনেকেরই মনে নানা সন্দেহ ছিল। আর যখন চলচ্চিত্রের লোকজন ওই গ্রামে গেলো তখন তাদের কাজ নিয়েও প্রশ্ন উঠলো।

এই কারখানাতেই কাজ করেন ৩১ বছর বয়সী সুষমা দেবী। তার এই কাজের জন্যে প্রতিদিন তার সংসারে অশান্তি সহ্য করতে হয়।

দুই সন্তানের মা সুষমার স্বামী তাকে এই কাজ করতে দিতে রাজী হয়েছেন গৃহস্থালির সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে যাবার শর্তে।

"সেজন্যে, আমি সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠি, ঘরদোর পরিষ্কার করি, কাপড় ধুই, গরুর খাবার দেই, রান্নার জন্যে গোবর শুকাতে দেই, গোসল করি, এরপর কাজে বের হওয়ার আগে সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার রান্না করি। আর সন্ধ্যায় ফিরে তৈরি করতে হয় রাতের খাবার," বলেন তিনি।

কিন্তু এরপরও তার স্বামী খুশি নন। তার মতে এত কিছুর পরেও ঘরের কাজে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

সুষমার মতে তার স্বামী যদি এই কাজ ছেড়ে দেবার জন্যে তাকে প্রহারও করেন, তবুও তিনি কাজ ছাড়বেন না।

তথ্যচিত্রটিতে দেওয়া সাক্ষাতকারে সুষমা বলেছেন যে, সে তার উপার্জনের বাড়তি অংশ দিয়ে তার ছোট ভাইয়ের জন্যে কাপড় কিনে দিয়েছেন।

"এটি অস্কারে যাবে জানলে আরো বুদ্ধিদীপ্ত কিছু বলতাম," হাসতে হাসতে বলছিলেন সুষমা।

সুষমা, স্নেহা বা তাদের সহকর্মীদের জন্যে অস্কার মনোনয়নের বিষয়টি আসলেই খুব বড় একটি প্রাপ্তি। এই তথ্যচিত্রটি এখন নেটফ্লিক্সেও দেখা যাচ্ছে এবং সেখানে সেরা সংক্ষিপ্ত ডকুমেন্টারি বিভাগে মনোনীত হয়েছে।

স্নেহার প্রতিবেশীরা এটিকে গ্রামের জন্যে অনেক বড় `সম্মান ও খ্যাতি` বলে মনে করছেন।

"আমিই প্রথম কাথিখোড়ার কেউ যে কিনা দেশের বাইরে যাচ্ছে," অস্কার ঘোষণার আগে বলেছিলেন স্নেহা।

"আমি এখন গ্রামে স্বীকৃত এবং সম্মানিত, সবাই বলছে যে তারা আমাকে নিয়ে গর্বিত।"

স্নেহা বলছিলেন যে, তিনি অস্কারের কথা শুনেছিলেন এবং জানতেন যে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিনেমার পুরষ্কার। তবে কখনো সে অনুষ্ঠানটি দেখেননি, এবং কখনোই ভাবেননি যে সেখানকার রেড কার্পেটে তিনি থাকবেন। বিবিসি বাংলা

এসি