ডায়াবেটিস ‘নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ শ্রেয়’
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ :
প্রকাশিত : ১২:১১ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৩:০৮ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ বৃহস্পতিবার
দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক, নীরব ঘাতক স্বভাবের ডায়াবেটিস রোগটির অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে যথা সচেতন করে তুলতেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ২৮ ফেব্রুয়ারিকে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধি নিচয়ের নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটিবসন্ত ও পোলিও নির্মূলে সফল হতে সক্ষম হলেও মানুষের সুন্দর সাবলীল জীবনযাপনের পথে নীরবে তার সর্ব কর্মক্ষমতা হরণকারী অসংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনতার অনিবার্যতা এবং এর জন্য সুপরিকল্পিত সর্বজনীন উদ্যোগ গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের আবশ্যকতা যথা মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আসছে না বলে প্রতীয়মান হয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে বিশ্বব্যাপী তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৫-২০১৯) মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘ডায়াবেটিস রোগকে জানা, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের মাধ্যমে এর বিস্তার রোধ’। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যক্তির সজ্ঞান ও আন্তরিক আগ্রহ আবশ্যক বলেই তাকে উদ্বুদ্ধকরণ, সার্বিক সহায়তা প্রদান, চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি ও উপায় উপকরণ সরবরাহ তথা পরিবেশ নির্মাণে অবিসংবাদিত ভূমিকা রয়েছে সরকার এবং সমাজের। কেননা সুস্থ জনশক্তি বা নাগরিকের সুস্বাস্থ্য সব সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার অন্যতম অবলম্বন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবসের প্রচার-প্রচারণায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাদের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা আছে, আর এ চিকিৎসায় নিবেদিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী সবারই শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিসের বিস্তারকে থামানো, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়াকে সীমিতকরণ। এসব প্রচার-প্রচারণা মূল ৩ঊ (ঊফঁপধঃরড়হ, ঊহমধমব ধহফ ঊসঢ়ড়বিৎ) বা তিনটি প্রতিপাদ্যে প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ সবাইকে এ রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে শিক্ষার প্রসার, বেশিসংখ্যক রোগী-অরোগী-চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও সেবায় সম্পৃক্তকরণ এবং ডায়াবেটিক রোগীদের নিজেদের কর্তব্য ও অধিকার সম্পর্কে ক্ষমতায়ন।
রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে বা ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাঁদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়-স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাঁদের ওজন খুব বেশি, যাঁদের বয়স চল্লিশের ওপর এবং যাঁরা শরীরচর্চা করেন না, গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন তাঁদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। অত্যধিক চিন্তাভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে গেলে এ রোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষামতে নগরায়ণ, ’ওয়েস্টার্ন ফুড’ আর সার্বিক পরিবেশ এর ভারসাম্যহীনতায় এ রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, এই শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌঁছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারিরূপে উদ্ভাসিত হবে।
ডায়াবেটিস মেলাইটাস সংক্রামক রোগ না হওয়ার কারণে এখনো পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য কার্যক্রমের অগ্রাধিকার তালিকায় সংক্রামক রোগের তুলনায় এর স্থান অনেক নিচে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তাদের আঞ্চলিক অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সুতরাং ডায়াবেটিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচি এসব দেশে সন্তোষজনকভাবে গড়ে ওঠেনি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হয় ঠিকই, কিন্তু রোগীকে ইনসুলিন দেওয়া হয় শুধু হাসপাতালে ভর্তি হলেই, বহির্বিভাগের রোগীকে কখনোই ইনসুলিন দেওয়া হয় না। দেশের ৮৫ শতাংশ অধিবাসী যে পল্লী অঞ্চলে বাস করে, সেখানে ইনসুলিন পাওয়া যায় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডায়াবেটিসের মতো আজীবন রোগের ক্ষেত্রে যে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন এসব উন্নয়নশীল দেশে সে সস্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতাও নেই। যেসব হাসপাতালে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয় সেখানেও এসব রোগীর কোনো নথি কিংবা তালিকা রক্ষা করা হয় না; এমনকি কোনো কেন্দ্রীয় নিবন্ধনও নেই।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেও জলবায়ুর পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। দ্রুত ও দুর্বল নগরায়ণের ফলে বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা এখন শহরে বাস করে। এখানে আছে যন্ত্রচালিত পরিবহনব্যবস্থা, চলছে বস্তির বিস্তার, শরীরচর্চাবিহীন যাপিত জীবনে বাড়ছে বয়োবৃদ্ধ জনসম্পদ, হচ্ছে বনজ প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড়, প্রাণিজ ও সুষম খাদ্যের জায়গা দখল করছে কল-কারখানায় প্রক্রিয়াজাত কৃত্রিম অস্বাস্থ্যকর খাবার, পরিবর্তিত হচ্ছে আহার প্রক্রিয়া, বাড়ছে বিশ্বখাদ্য—কৃষির ব্যবসা ও বিপণনে প্রতিযোগিতা। ২০৩০ সালের মধ্যে আট বিলিয়ন বিশ্ব জনসংখ্যার পাঁচ বিলিয়ন বাস করবে শহরে, যাদের মধ্যে দুুই বিলিয়নই বাস করবে বস্তিতে। ফলে জীবনযাত্রায় জটিলতা বাড়তেই থাকবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা নানা অনিয়মের ও ব্যবস্থাপনার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হতে থাকবে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা সাত থেকে ৯ বিলিয়নে বৃদ্ধি পাবে এবং এশিয়া ও আফ্রিকায়ই ঘটবে এর ব্যাপক বিস্তার। সার্বিকভাবে বিশ্ব জনসংখ্যায় প্রবীণের প্রাধান্য পেলেও উন্নয়নশীল দেশে নবীনের পাল্লা হবে ভারী। জনমিতিতে এমন অসম পরিবর্তন প্রবণতায় এরই মধ্যে সম্পদের অপ্রতুলতায় পরিবেশদূষণে, নানা রোগের প্রাদুর্ভাবে ও বিস্তারকে প্রভাবিত করছে। এ পটভূমিতে বর্তমানে বিশ্বে ৩৬৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ অর্ধ বিলিয়নে দাঁড়াবে। বছরে ৪.৬ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে মারা যায়। ডায়াবেটিসে সবচেয়ে বড় ক্ষতি কর্মক্ষমতা হারানো, এ রোগের পেছনে বার্ষিক ব্যয় হয় ৪৬৫ বিলিয়ন মা. ড.। পাঁচজনের মধ্যে চারজন ডায়াবেটিক রোগী বাস করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। এ রোগ পরিবারকে অসচ্ছল করে, শ্রমশক্তি বিনষ্ট করে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে পর্যুদস্ত করে।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
এবং চিফ কো-অর্ডিনেটর, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি
এসএ/