কিশোর গ্যাংগের কাছে জিম্মি জাবির শিক্ষার্থীরা!
জোবায়ের কামাল, জাবি
প্রকাশিত : ০৬:২৬ পিএম, ২ মার্চ ২০১৯ শনিবার
রাজধানীর উত্তরায় আতঙ্কের নাম ছিল ‘কিশোর গ্যাং’। উত্তরার ডিসকো গ্রুপের হাতে নাইনস্টার গ্রুপের কিশোর আদনান নিহত হওয়ার পর কিশোর অপরাধ নিয়ে গণমাধ্যমে শোরগোল পড়ে যায়। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজকে ঘিরে অন্তত তিনটি কিশোর গ্যাং সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি, অস্ত্র প্রদর্শন, শো-ডাউন লেগেই থাকে। আধিপত্য বিস্তারে দেশীয় অস্ত্র ব্যবহারসহ নানা অসামাজিক কাজকর্ম চালাচ্ছে তারা।
দলবেঁধে বিভিন্ন জায়গায় বসে আড্ডা দেওয়া, ইভটিজিং করা, এমনকি মাদক সেবনের মতো অপরাধে বভিন্ন সময় তাদের কাছে মাদক সেবনের সামগ্রীও পাওয়া গেছে বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অফিস।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কলাবাগান এলাকার কিশোর গ্যাং ‘জিআই পাইপ’র সঙ্গে আমবাগান এলাকার ‘ব্রাদারহুড’র সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে এই গ্যাং কালচারের বিষয় নজরে আসে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কলাবাগান, আমবাগান ও রাঙামাটি এলাকা ঘিরে অন্তত তিনটি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। যাদের সবাই জাহাঙ্গীরনগর স্কুল এন্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী ও একাদশ শ্রেণির ছাত্র।
সবচেয়ে সক্রিয় ও বড় গ্যাং হিসেবে পরিচিত কলাবাগান এলাকার ‘জিআই পাইপ’। এই গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছে সবুজ ইসলাম বাবু, আবুু সুফিয়ান আকাশ, উজ্জ্বল সিয়াম, মো. রবিন, কামরুল হাসান রনি। এরা নিজেদের ‘ডিফারেন্ট বয়েজ’ নামে পরিচয় দিলেও চলাফেরায় তারা জিআই পাইপ নিয়ে ঘুরে বলে এরা ‘জিআই পাইপ’ গ্রুপ নামে পরিচিত। এই গ্যাংয়ের বেশীরভাগ সদস্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীর সন্তান।
‘ব্রাদারহুড’ নামের আমবাগান এলাকাজুড়ে রয়েছে সক্রিয় আরেকটি গ্যাং। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফারভিদ মিরাজ নামে এক কিশোর। মিরাজ জাবি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক শহিদুল ইসলামের ছেলে। এই গ্রুপে আরও রয়েছে ইশতিয়াক আহমেদ রুদ্র, মোতাহের হোসেন তাসিম, সালমান হোসেন রাতিন, রাকিব হোসেন, শারাফ শাফিন ইমন প্রমুখ। জানা যায়, ২০১৫ সালে সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন কিশোর গ্যাং গড়ে তুলে তারা। ফেসবুকে তাদের ‘ব্রাদারহুড’ নামে একটি গ্রুপ রয়েছে যেখানে তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে। গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৯২ জন। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে বাইক শোডাউন করে এই গ্যাংটি। স্কুল এন্ড কলেজের মেয়েদের টয়লেটে এদের বড় চিকাও রয়েছে। এই গ্যাং মূলত আমবাগান কেন্দ্রিক হলেও রাঙামাটি এলাকায় রয়েছে তাদের কার্যক্রম। এই অংশের নেতৃত্ব আছে হৃদয় নামে আরেক কিশোর। এই গ্যাংয়ের বেশীরভাগ সদস্যও বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রাঙামাটি এলাকা’য় সক্রিয় আরেকটি গ্যাং। এই গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছে সজীব আহমেদ, আজীজ আহমেদ, রাহাত খান, রাজীব হোসেন অপি, মেহেদি হাসান রাজা। এর মধ্যে আজিজ পাথালিয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও রাহাত খান পাঠাগারবিষয়ক সম্পাদক। রাহাত ছাড়া সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীর ছেলে। রাহাতের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অফিসে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। রাহাতকে একবার মাদকসহ আটক করে বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা অফিস। তখন তাকে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মহিতোষ রায় টিটু ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। এই গ্যাংয়ের সঙ্গে জাবি ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত কর্মী আশরাফুল ইসলাম দ্বীপের ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে। দ্বীপকে গত ডিসেম্বরে ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার কারণে ২ বছরের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই তিন গ্যাং গত একবছরে অন্তত ৬-৭ টি বড় সংঘর্ষের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। গত বছরের মার্চে ‘জিআই পাইপ’ গ্যাংয়ের সদস্য আবু সুফিয়ানকে সিনিয়র হিসেবে সম্মান না দেওয়ার কারণে শান্ত সরকার নামে এক ছাত্রকে রড, জিআই পাইপ দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। রক্তাক্ত অবস্থায় শান্তকে স্কুল কলেজের পেছনের জঙ্গলে ফেলে চলে যায়। এই ঘটনায় সবুজ ইসলাম বাবু, উজ্জ্বল সিয়াম, আবু সুফিয়ানসহ ছয়জন জড়িত থাকার তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অফিস সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঘটনার দিন তাদের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা অফিস জিআই পাইপ ও ইয়াবা খাওয়ার কয়েন ও ফ্রয়েল পেপার উদ্ধার করে। আটককৃতদের স্কুল এন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
এই ঘটনার পর ২৬ এপ্রিল আরেকটি মারামারি ঘটনায় শহীদ রফিক-জব্বার হলের মালি আবদুল ওহাবের ছেলে কাউছার উদ্দীন, শেখ হাসিনা হলের ক্লিনার রেজিয়া বেগমের ছেলে সবুজ ইসলাম বাবু, আ ফ ম কামাল উদ্দীন হলের কর্মচারী নজরুল ইসলামের ছেলে নাজিরুল ইসলাম, আল-বেরুনী হলের গার্ড খোরশেদ আলমের ছেলে আল আমিন হোসেন, মওলানা ভাসানী হলের গার্ড জামশেদ আলীর ছেলে সোহল রানাকে তাদের অভিভাবক নিরাপত্তা অফিস থেকে মুচলেকা দিয়ে নিয়ে যায়। এরা সবাই ‘জিআই পাইপ’ গ্যাংয়ের সদস্য। এই গ্যাংয়ের ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাসানী হল ও শহীদ রফিক জাব্বার হলের পেছনে নিয়মিত জুয়া ও গাঁজার আসর বসায় ।
অন্যদিকে ‘ব্রাদারহুড’র ছেলেরা বাইরে থেকে কেউ কলেজ এলাকায় ঘুরতে এলে, ঠিকঠাক মতো তাদের ম্যানার না মানলে, তাদের সামনে সিগারেট খাওয়াসহ কোন ভুল করলে ভোগান্তি পোহাতে হয়। ত্রিশ বছর বয়সী এক ভুক্তভোগী জানান, স্কুল থেকে ছোট বোনকে নিতে এসে তিনি নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। তখন কিছু ছেলে এসে এই এলাকায় কেন এসেছি, কথা বলার সময় হাত নড়ছে কেন, মুখে মুখে কথা বলছি কেন এসব কথা বলে আমাকে বিনা কারণে মারধর করে ব্রাদারহুডের ছেলেরা।
সম্প্রতি আমিন মডেল স্কুলের দুই ছেলে জাবি স্কুলের আদ্রিতা নামে এক ছাত্রীকে নিয়ে স্কুল এলাকায় ঘুরতেছিল। সে সময় তাদেরকে ‘ব্রাদারহুড’ এর ছেলেরা লাঞ্ছিত করে বলে ‘জিআই পাইপ’ গ্রুপের কাছে অভিযোগ করে আদ্রিতা। এই ঘটনার জেরে গত ২৯ জানুয়ারি ‘জিআই পাইপ’ গ্রুপের সঙ্গে ‘ব্রদারহুড’ এর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। সংষর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ব্রাদারহুডের মিরাজকে ৬ মাসের বহিষ্কার করা হয়। সেই সঙ্গে আদ্রিতাসহ দুই গ্যাংয়ের ছয়জনকে স্কুল এন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ শোকজ করে। এই ঘটনার পর ‘জিআই পাইপ’ গ্রুপের ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মিরাজ ও তার বাবা শহিদুল ইসলামের বহিষ্কারের দাবিতে মিছিল করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহিন পরে তাদের মিছিল থামিয়ে দেয়। জানা যায়, এই গ্যাংগুলো এভাবে ঠুনকো কারণে প্রায় মারামারিতে লিপ্ত হয়।
জাবি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল জলিল ভূঞা এসব বিষয়ে জানান, এই ধরনের দলে উপদলে ভাগ হয়ে মারামারির কথা শুনছি আমি। কিন্তু এই গ্যাং মূলত বাইর থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়, তাদের পেছনে এলাকার সিনিয়ররা আছে তাই খুব একটা অ্যাকশনে যেতে পারি না।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল হাসান বলেন, কোমলমতি কিশোররা এই ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া খুবই দুঃখজনক। এই কিশোরদের পরিবার, সমাজ ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এই ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি দেয়া জরুরি।
এসএইচ/