ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাংলা ভাষার বর্তমান অবস্থা

সরওয়ার হোসেন

প্রকাশিত : ০৮:০৪ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৯ সোমবার

মোদের গরব মোদের আশা,আ-মরি বাংলা ভাষা। কবির বর্ণনায় বাংলা ভাষার মাধুর্য এভাবেই ফুটে উঠেছে। বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলার জন্য জীবন বিসর্জন করেছেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেক বিপ্লবী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শত শত বীর বাঙালি ঢাকার রাজপথ কাঁপিয়ে দিয়েছি, রক্ত দিয়ে পিচঢালা পথ রঙিন করে ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রেখেছিল। এরপরই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। এসব ইতিহাস সকলেরই জানা। তবে যে আশা ভরসা, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে ভাষা সংগ্রামীরা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলেন। স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরও আমাদের খুঁজে ফিরতে হয় সেসব উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা?

সকলেই জানেন,মাতৃভাষা বাংলাকে সর্বস্তরে ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির জন্যই ভাষা আন্দোলনের সূচনা। একটি ভাষাকে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ব্যবহার করতে হলে তাকে অবশ্যই রাষ্ট্রের প্রধান ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু কাগজে কলমে বাংলাকে মর্যাদা দিলেও বাঙালিদের শোষণ নির্যাতন চালাতে থাকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। নিজেদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘ সংগ্রামের পর বাঙালিরা লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র জন্ম নেয় বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশে সকলের আশা ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার হবে। বিশেষ করে সরকারি দপ্তর,আদালত এসব স্থানে সাধারণ মানুষ বাংলায় সেবা পাবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তবে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকে বাংলা ভাষার প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই বাংলাকে সর্বস্তরের ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অনেকে মনে করেন। বাংলাদেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। পরবর্তী রাষ্ট্র প্রধানগণ বাংলায় ভাষণ দেননি। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলায় ভাষণ দেন এবং বাংলাকে জাতিংসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জনিয়ে আসছেন।

জাতীয় সংসদে একটি শব্দ বারবার আমি শুনি আর ভাবি এই শব্দটির মনে হয় কোন বাংলা শব্দ নেই। যখন সংসদের স্পীকার বলেন, অমুকের বক্তব্য ‘এক্সপাঞ্জ‘ করা হলো তখন আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে কেন বলেন না, অমুকের বক্তব্য বাদ দেওয়া হলো বা বাতিল করা হলো। বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরের ব্যবহারের জন্য সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও কার্যকর হয়নি এ চাওয়া। এমনকি সুপ্রীম কোর্টের রায় এখনও লেখা হয় ইংরেজীতে, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেনা।

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলার প্রচলন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি অন্য ভাষা বিশেষ করে ইংরেজীকে চরম অবজ্ঞা করা হয়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে ডিগ্রী পাস করা কেউ যেমন বাংলা ভাল জানে না, তেমনি ইংরেজীও শিখে কম। অথচ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ইংরেজী অবশ্যই জানতে হবে। আবার মেডিক্যাল কলেজ বা কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষার বই নেই বললেই চলে। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে মেডিক্যাল বা কারিগরি পড়াশোনা। ফলে জানা বা বুঝার চেয়ে মুখস্থ করে পরীক্ষা পাসের চিন্তা করে অনেক শিক্ষার্থী। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার এমন বেহাল দশার সুযোগ নিয়ে যেখানে সেখানে গড়ে উঠছে ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল যেগুলোর অধিকাংশ মানসম্মত নয়। ফলে এমন এক প্রজন্ম গড়ে উঠছে তারা বাংলা ভাষা সম্পর্কে যেমন কম জানে তেমনি ইংরেজীও শিখছে ভুল ভাবে।

প্রযুক্তির কারণেও বাংলা ভাষা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে হিন্দি সংস্কৃতি। হিন্দি ভাষার অনুকরণে লোকজন ব্যবকরণগত অনেক ভুল শব্দ ব্যবহার করছে প্রত্যাহিক জীবনে। কয়েকদিন আগে নতুন একটি শব্দ শুনলাম ‘কেনকি’। হিন্দী ‘কিউকি‘ শব্দ থেকে নাকি বাংলা করা হয়েছে ‘কেনকি‘। অথচ ব্যকরণগতভাবে এটি ভুল একটি শব্দ। ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক বা ব্যবকরণবিদগণ নতুন নতুন শব্দ সৃষ্টি করে ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন। কিন্তু এখন অন্য ভাষার নাটক সিনেমা দেখে সাধারণ মানুষই মনের মতো করে শব্দ সৃষ্টি করছেন। আমাদের একটি প্রজন্ম এভাবেই ভুল শব্দ শিখছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক নতুন নতুন শব্দ বা কথ্য ভাষার শব্দ স্থান পাচ্ছে প্রমিত বাংলা হিসেবে। যেমন আমরা অনেকেই মুঠোফোনে বার্তা পাঠানোর সময় লিখি ‘বলিয়েন’ ‘কইরেন‘ এ জাতীয় শব্দ। ইংরেজীর মিশ্রণ তো ডাল ভাতের মতো হয়ে গেছে।

গণযোগাযোগ মাধ্যমেও প্রমিত বাংলার ব্যবহার অনেক কমে গেছে। টেলিভিশনের সংবাদ বা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এখনো অনেক কঠোর নিয়ম অনুসরণ করা হয়। কিন্তু রেডিওতে বর্তমানে তুমুল জনপ্রিয় ডিজে নামক পদবীতে যারা কাজ করেন তাদের ভাষা শুনলে যেকোন বিদেশি বিশেষ করে ইংরেজী ভাষার কোন বিদেশী নির্ঘাত অজ্ঞান হয়ে যাবেন। তারা যেভাবে বাংলা উচ্চারণ করেন এবং এতে দুই একটা শব্দ পরপর ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করেন তাতে সাধারণ মানুষের ভ্যাবচ্যাকা খাওয়ার উপক্রম হয়। গত কয়েক বছর ধরে বাংলা নাটকে প্রমিত বাংলার স্থলে আঞ্চলিক ভাষা প্রাধান্য পাচ্ছে। অনেকে এর পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, এসব নাটকের মাধ্যমে আঞ্চলিক ভাষাগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাংলা নাটক যদি আপনি বলেন তাহলে সেখানে প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যবহারই কাম্য। আমরা দেখি হিন্দি নাটক বা সিনেমায় প্রমিত হিন্দি ভাষা ব্যবহার হয়, ইংরেজী সিনেমায় প্রমিত ইংরেজী ভাষার ব্যবহার হয়। যদি তেলেগু, মারাঠী, অসমীয় ভাষায় নাটক বা সিনেমা বানানো হয় সেগুলোকে তারা কখনো হিন্দি নাটক বা সিনেমা বলে না।

বর্তমানে সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে ২১শে ফেব্রুয়ারী। এখন সুযোগ আছে মহান ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার। সাথে সাথে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটিও করা যায় এ সুযোগে। তবে সবচেয়ে জরুরি বাংলাদেশে বাংলা ভাষার চর্চা সঠিকভাবে করা। সেটা হওয়া উচিত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। দেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী যেন বিদেশে কোন অনুষ্ঠানে বাংলায় ভাষণ দেন সেটি বিবেচনা করা যেতে পারে। সুপ্রীম কোর্ট যেন নিজেরা বাংলা ভাষার চর্চা শতভাগ শুরু করেন এবং তাদের দেওয়ার নির্দেশনা যেন পালিত হয় সেজন্য সরকারকে তাগাদা দিতে পারেন। হয়তো সাধারণ মানুষ ভুল উচ্চারণ করবে, কিন্তু যাদের দেখে তারা শিখবে সে মানুষগুলো বিশেষ করে যাঁরা অভিনয় করেন, সংবাদ পড়েন বা উপস্থাপনা করেন তাঁরা যেন শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে ইউটিউব থেকে যেমন অশ্লীলতা দূর করতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে তেমনি বাংলা ভাষার নামে যারা অপভাষা ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে আকাশ সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করতে হলে বাংলা ভাষার প্রচার এবং প্রসারের কোন বিকল্প নেই।

লেখক- সাংবাদিক, লন্ডন