ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

ক্লান্তিহীন বাউল ও একান্ত স্বজন মো: সাইদুর

ড. মোহাম্মদ আলী খান

প্রকাশিত : ১১:৫৪ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ১১:৫৮ পিএম, ৪ মার্চ ২০১৯ সোমবার

যাঁর বিচরণ বিশাল তাঁকে ধরা যায় না। ফোকলোর চর্চায় যিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ তাঁকে সাধারণ যোগ বিয়োগের হিসেবে মূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। তাই স্মৃতিচারণই সহজ পথ। মো: সাইদুরকে চিনি ১৯৮৪ থেকে। তার জন্মভূমি কিশোরগঞ্জ। লম্বা চুল, চোখে ভারী চশমা, কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, সাদা পাজামা- পাঞ্জাবি পরিহিত নাতিদীর্ঘ এই মানুষের সাধারণ পরিচয় একজন বাউল। পৈত্রিকসূত্রে তা পেয়েছেন। কিন্তু তিনি গিয়েছেন অনেক দূর। মো: সাইদুর কোন স্কুলে পড়ালেখা করেছেন সেটা মুখ্য বিষয় নয়। বরং গুরুত্বপূর্ন হলো তিনি কোন পথে হেঁটেছেন। 

দেখা যেতে পারে, কিশোরগঞ্জ আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পার্শবর্তী, দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতের জন্য বিখ্যাত, ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মাঠে তিনি কতটা সময় ব্যয় করেছেন। শুধু তাই নয়, এই শোলাকিয়া নামটি কেমন করে এলো, কেনো এতো বেশি সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মুসলমান এখানে নামাজে শরীক হন কিংবা নরসুন্দা নদী ও তার তীরবর্তী হারিয়ে যাওয়া কোন ঘটনা নিয়ে কি বিশ্বাস ছড়িয়ে আছে লোকমুখে তার সন্ধানে তিনি কীভাবে নিয়োজিত ছিলেন! তার গবেষণা তাই অনেক গভীরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে বহু তথ্য নিয়ে এসেছেন নয়ন সম্মুখে। গভীর অনুসন্ধিৎসু মন আর আপন ভোলা সহজাত প্রবৃত্তির টানে তিনি চলেছেন প্রিয় জন্মভুমি কিশোরগঞ্জে যতো নদী আছে এবং যতো নদী শুকিয়ে গেছে তার তীর ঘেঁষে। সে মাটির কোলে যে লজ্জাবতী লতা, হিজলের মায়া, বউ কথা কও পাখির ডাক, এমনকি বিবর্ণ হয়ে আছে যে ‘মরা ঘাস’ সব ধরা পরেছে তার সন্ধানী চোখে।

ঐতিহ্যবাহী জনপদে যত পুরাকীর্তি আছে, ঘটেছে স্মরনীয় ঘটনাপ্রবাহ বা কীর্তিসমূহ সব যেন এক ক্ষ্যাপা বাউলের সংগ্রহে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। সত্যিকার অর্থে তিনি শ্যামল বাংলার মাটির কাছাকাছি মিশেছেন, কখনো পদব্রজে, এমনকি ক্ষুধার্ত অবস্থায়। দরদী কৃষক মাটি খুঁড়ে ফলায় ফসল, মাঝি পাল তোলা নৌকায় দরাজ কণ্ঠে গায় গান, কুমার গভীর মমতায় তৈরি করে মাটির তৈজসপত্র আর মো: সাইদুর সে মাটির মাঝে গানের সুরে সুরে খুঁজে ফিরেন অন্তহীন লোক-সংস্কৃতির বর্ণিল ধারা। সে ধারার সিক্ত হয়েছে অনন্য সাধারণ কয়েকটি গ্রন্থ। উল্লেখ করা যায় কিশোরগঞ্জ ইতিহাস, জামদানী, মহরম, শীর্ষক মূল্যবান গ্রন্থসমূহ।

ড.দীনেশ চন্দ্র সেনের মৈমনসিংহ গীতিকা নিয়ে কতো আলোচনা হয়। কিন্তু যতো কাহিনী এই গীতিকায় তার সিংহভাগ তো কিশোরগঞ্জের। যদি ড. সেনের সাথে দেখা হতো মো: সাইদুরের, তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্বসাহিত্য ভাণ্ডারে উজ্জল হয়ে স্থান করে নিত কিশোরগঞ্জের গীতিকা। মো: সাইদুর আজ নেই অথচ তিনি নিজেই ছিলেন ফোকলোরের ভ্রাম্যমাণ অভিধান। দেশে বিদেশে যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই রেখেছেন তার অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয়। কিশোরগঞ্জে তার বিন্নগাঁস্থ বাড়িতে কতো যে সঞ্চয় তা তিনি নিজেও বলতে পারবেন না। তিনি বৈষয়িক নন। গতানুগতিক জীবনধারায় অভ্যস্ত নন। ছুটে চলার মাঝে কোনো সমন্বয় নেই। সময়ের প্রতি কোনো মায়া নেই। কারণ তিনি একজন আপন ভোলা মানুষ, ক্লান্তিহীন বাউল, একজন সংগ্রাহক। মো: সাইদুর সত্যিকার অর্থে একজন ফোকলোরবিদ।

কিশোরগঞ্জ শহরের বুক চিরে চলে গেছে মৃতপ্রায় নরসুন্দা। এই নরসুন্দার যৌবনের ইতিহাস শুধু নয়। তিনি ঘেটেছেন তার জন্মেও ইতিহাস। বিখ্যাত পাগলা মসজিদ থেকে শুরু করে এগারসিন্দুরের জাফরি ইট বিছানো জমিতে ফেলে আসা অতীতের ছবি তুলে আনার চেষ্টা করেছে। একোরকাম দিয়ে রেনেলের ম্যাপে পাকুন্দিয়া উপজেলার টোকে সুবিশাল ব্রক্ষ্মপুত্রের প্রশস্ততা বের করে দেখিয়েছেন এ নদ সে সময় ১২ মাইল চড়া ছিল (প্রায় ১৯ কি. মি) তার চোখে সহজেই ধরা পড়েছে জংগলাকীর্ণ সালংকা জামে মসজিদ, হিলোচিয়া বৌদ্ধস্মৃতি, টেরাকোটা সমৃদ্ধ সাদী মসজিদ। আপন মনের তাগিদে তিনি ‘মাধব মালঞ্চী’ কইন্যা সহ অসংখ্য লোককাহিনী সুধীসমাজের কাছে তুলে ধরেছেন।

বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগ, তার সংগ্রহে হয়েছে সমৃদ্ধিশালী। তবে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য দিক হল, নকশী কাঁথা। কয়েক হাজার এবং সুপ্রাচীন নকশী কাঁথার মাঝে মো: সাইদুরের শিল্পীমন যেনো আপন মহিমায় উদ্ভাসিত। সুন্দর হস্তাক্ষরে কিশোরগঞ্জ সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোককাহিনি তুলে ধরেছেন।

লেখক- ড. মোহাম্মদ আলী খান, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

এসি