ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

৭ মার্চের পথ ধরে এসেছিল স্বাধীনতা

একুশে টেলিভিশনলে. কর্নেল (অব.) এটিএম মহিউদ্দিন সেরনিয়াবাত :

প্রকাশিত : ১২:২৬ পিএম, ৭ মার্চ ২০১৯ বৃহস্পতিবার

স্মৃতিতে ভাস্বর ১৯৭১-এর মার্চ। বাঙালিরা এবার নিজেরাই হবে নিজেদের রাজা। হাজার বছরের তাদের এই স্বপ্ন, এই আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু ১ তারিখ দুপুরে ষড়যন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্বনির্ধারিত ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ করেই স্থগিতের ঘোষণা দেন। ফলে বাঙালিদের সুখনিদ্রা ও স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। মুহূর্তেই তাদের চেহারা পাল্টে যায়। তারা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে রাস্তায় নেমে আসে।

বিক্ষুব্ধ জনতা অনেক স্থানে ভাংচুর চালায়। এমনকি পাকিস্তানের জাতির পিতার ছবি ও পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ছুটতে থাকে হোটেল পূর্বাণীর দিকে, যেখানে সংসদীয় দলের মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করছিলেন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বিক্ষুব্ধ এই মানুষকে তিনি শান্ত হতে, ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা দেশে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হয়ে পরবর্তী করণীয় জেনে আসার আহ্বান জানান।

৭ মার্চ ছিল রোববার। দেশের বিভিন্ন স্থানে গত এক সপ্তাহে বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে অকাতরে মানুষ মরেছে। চারদিকে অস্থিরতা, টান টান উত্তেজনা। বোধকরি হাজার বছরের পরাধীন, নিরীহ বাঙালি জাতি বিসুভিয়াসের জ্বালা মুখে উপস্থিত। কখন অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়ে যায় বলা মুশকিল এমন অবস্থা।

তাতে কী! তারপরও বাস-ট্রাক, ট্রেন-লঞ্চ-স্টিমার-নৌকা সব রকমের বাহন যেখানে পূর্ণ, সেখানে সকাল থেকে হেঁটে ঢাকার দিকে ছুটছে মানুষ। খাল-বিল-নদীর স্রোতধারা যেমন ধাবিত হয় সাগরের পানে, তেমনি মানুষ ছুটছে ঢাকা অভিমুখে। লক্ষ্যস্থল- ঢাকা রেসকোর্স ময়দান। এদের কাউকে ভাড়া করে আনা হয়নি। মিডিয়াতে মুখ দেখানো কিংবা ছবির প্রতিও এদের বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। মনের টান, উচ্ছ্বাস। সর্বোপরি দেশের প্রতি যে ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ এদের হৃদয়ে জাগিয়ে তুলেছেন শেখ মুজিবুর রহমান, সেটিই এদের তাড়িত করছে।

সেদিন নিতান্তই এক কিশোর ছিলাম কিন্তু সচেতন ও এই দৃশ্যের চাক্ষুষ সাক্ষী হিসেবে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, বাংলাদেশের এমন কোনো জেলা, মহকুমা, থানা কিংবা গ্রাম ছিল না যে, ঢাকায় তার প্রতিনিধি পাঠিয়ে ঐ ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার গৌরব অর্জন করেনি। ঢাকার এমন কোনো পাড়া-মহল্লার অলি-গলি, কাঁচা-পাকা রাস্তা ছিল না যার বুকের ওপর দিয়ে রেসকোর্সগামী উন্মত্ত জনতার মিছিল এগিয়ে যায়নি। মিছিলে মিছিলে মুখরিত পুরো ঢাকা শহর।

সুন্দরবন যেন এ পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ায় চারদিকে কেবল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের গর্জন। মাটি কাঁপছে। এই জনপদে এমন দৃশ্য কোনো জনমেই দেখেনি কেউ। যারা কখনোই ঢাকা শহরে আসেনি এমন মানুষ যুদ্ধজয়ের আনন্দ ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে রেসকোর্সের দিকে, যেখানে লিখিত হতে যাচ্ছে একটি জাতির ভবিষ্যৎ, বাঙালির ইতিহাস। এরা সবাই সাক্ষী হতে যাচ্ছে গৌরবময় নতুন ইতিহাসের। এখানেই পঠিত হবে শ্রেষ্ঠ কবিতা।

হাজার বছর ধরে যে কবিতার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল এদের পূর্বপুরুষরা। আজ সেই কবিতা শোনার সৌভাগ্য হবে তাদেরই উত্তরাধিকারের। সেই কবিতা শুনে তারা ধন্য হতে চায়, কর্ণ জুড়াতে চায়। কেবল যে ঢাকায় উপস্থিত জনতা, তা নয়। সমগ্র জাতিকে এই সৌভাগ্যের অংশীদার করার জন্য ঢাকার রেডিও-টিভি রেসকোর্স থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের আয়োজন করেছে।

দুপুরের অনেক আগেই রেসকোর্স ছাপিয়ে পার্শ্ববর্তী বড় বড় গাছ, অট্টালিকার ছাদ ভরে গেছে মানুষে। চারদিক থেকে ঢেউয়ের মতো মিছিলের পর মিছিল এসে মানুষের ভিড়ে যেখানেই বাধা পাচ্ছে সেখানেই স্থান করে নিচ্ছে। প্রধান সড়ক-অলি-গলি শুধুই মানুষ আর মানুষ। এ যেন মানুষের সমুদ্র যার শুরু ও শেষ কোথায় খালি চোখে তো নয়ই, বোধকরি বৈজ্ঞানিক কোনো যন্ত্র দিয়েও তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

এমন সময় একটি হেলিকপ্টার মাথার ওপর দিয়ে কয়েকবার উড়ে গেলে এই জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ মানুষ হাতের লাঠি উঁচিয়ে মুহুর্মুহু স্লোগানে তাদের ক্ষোভ জানিয়ে দিল। এরা নিশ্চিতভাবে সাহসী ও দেশপ্রেমিক কিন্তু অপরিণামদর্শী। মৃত্যুকে এরা পরোয়া করে না। আর তাইতো বাঁশের লাঠি-রড নিয়ে এরা ঢাকায় এই জনসমুদ্র হাজির হয়েছে। ভাবখানা- নেতা মুজিব নির্দেশ দেয়া মাত্র গুঁড়িয়ে দেবে সব দুর্গ।

বিকাল ৩টার কিছু পর সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। এমনি সময় সুউচ্চ মঞ্চে ওঠে এলেন চোখে চশমা, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর হাফ হাতা কালো কোট পরিহিত এ যাবৎকালের এই উপমহাদেশের সবচেয়ে সুন্দর মুখশ্রীর রাজনীতিক, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, সুঠাম দেহের অধিকারী, আত্মপ্রত্যয়ী, সাহসী, আপাদমস্তক খাঁটি বাঙালি পুরুষ। যার ধমনিতে প্রবাহিত হচ্ছে পূর্বপুরুষ বাগদাদ থেকে ২শ’ বছর পূর্বে আগত শেখ বোরহান উদ্দিনের রক্ত। নাম শেখ মুজিবুর রহমান।

তারুণ্যের সেই দিনগুলো থেকে বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন ধারণ করে তিনি সব ঝড়ঝাপটা, সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে যেন এই মাত্র উপকূলে হাজির। তিনি এক জাদুকর। যার অঙ্গুলি হেলনে- টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, জাকিগঞ্জ-গোয়াইঘাট থেকে শ্যামনগর, কলাপাড়া অবধি শুরু হয়েছে অগ্ন্যুৎপাত। আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে লাভা নয়, যেন বেরিয়ে আসছে কোটি কণ্ঠের আওয়াজ- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো। শেখ মুজিবের পথ ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’

উত্তাল এই জনসমুদ্রে আজ সমবেত হয়েছে ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদহীন নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা-কিশোর। এসেছে কৃষক-শ্রমিক-কামার-কুমার-তাঁতি-ড্রাইভার-রিকশাচালক-ছাত্র-শিক্ষক-উকিল-মোক্তার-ডাক্তার-চাকরিজীবী-সংস্কৃতিক কর্মী-ভবঘুরে-ভিক্ষুকসহ সব পেশা ও পথের মানুষ। এরা সবাই নিজ কানে শুনতে চায় মুজিবের পরবর্তী সিদ্ধান্ত, তার নির্দেশনা। এটা যে শুধু এই জনসমুদ্রের দৃশ্য তা নয়। পুরো দেশ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়। নারী-পুরুষ যাদের বিশাল অংশ কখনও মুজিবরকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তারপরও তিনি তাদের স্বপ্নের মুক্তিদাতা।

তাই মুখে দু’মুঠো গুঁজে দিয়ে অনেক আগে থেকে বাড়িঘরের আঙিনা, বাজার-দোকান-ক্লাবঘরের আশপাশে রাস্তায় রেডিও-ট্রানজিস্টারের সামনে সমবেত হয়েছে এরা সবাই। যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ, পুরো বাংলাদেশ যেন স্থির। পাখির চোখ দিয়ে দেখলে মনে হবে পুরো দেশটাতেই একটি জনসভা। এই জনসভার একমাত্র বক্তা শেখ মুজিবুর রহমান, সেই হ্যামিলনের বংশীবাদক।

কিন্তু কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে মুজিব যে জংশনে এসে দাঁড়িয়েছেন, এখান থেকে তিনি কী শোনাবেন? জীবনের সবচেয়ে মধুর সময় এই দেশ ও জাতির জন্য তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। আজ সেই মুজিবের দিকে তাকিয়ে আছে বাঙালি জাতি। আজ তার যে কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত স্বাধীনতার স্বপ্ন থেকে এদের আজীবনের জন্য না হলেও শত বছরের জন্য পিছিয়ে দেবে।

আবার দুর্বলতা প্রদর্শন জাতির মনোবল ও ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারে। এমন একটি কঠিন ও বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতিতে কোনো প্রকার কাগুজি সহায়তা ছাড়া স্বভাবসুলভ, সহজ ও সবার বোধগম্য চলিত ভাষায় আঠারো মিনিটের যে বক্তৃতা তিনি করলেন তা বাংলাদেশে এ পর্যন্ত একটিও নয়, আগামী দিনে তেমন আর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা ও কারণও নেই।

তাই তো বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বীকৃতি দিলেও সত্যিকার অর্থে তেমন উল্লসিত হতে পারিনি। কারণ ৪৮ বছর পূর্বেই তো এই ভাষণটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দু-চারটি ভাষণের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল।

‘ভাইয়েরা আমার’ সম্বোধন করে নিজস্ব স্টাইলে জাদুকরের মতো তিনি যেভাবে আঠারো মিনিট পুরো একটি জাতিকে হিপনোটাইজ করে রেখেছিলেন, জানি না পৃথিবীর অন্য কোনো নেতা বা কবি তা কখনও পেরেছেন কি না। তার এই নাতিদীর্ঘ বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, কণ্ঠের উত্থানপতন সবই ছিল চুম্বকের মতো আকর্ষণীয়, মনমুগ্ধকর এবং সময়োপযোগী।

তার আশঙ্কা ছিল, যে কোনো সময় তাকে আটক কিংবা হত্যা করা হতে পারে। মৃত্যুতে তার ভয় নেই; কিন্তু তার জনগণের সম্মুখে যে তিনি আর উপস্থিত না-ও হতে পারেন। অতঃপর এমন কোনো কথা অব্যক্ত রাখলেন না যেন আক্রান্ত হলে নেতার অনুপস্থিতিতে সঠিক পথে এগিয়ে যেতে তাদের বেগ পেতে হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ দেয়ার সুযোগ না রাখলেও প্রকাশ্যে অথচ কৌশলে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধই যে হবে একমাত্র পথ, তা বাতলে দেন।

তার অনুপস্থিতিতে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে এবং রাস্তাঘাট বন্ধ করে মূলত শত্রুর এল অব সি কেটে ফেলার নির্দেশ দিলেন। তার এই ভাষণ যেন রীতিমতো যুদ্ধের অপারেশন অর্ডার। যে মানুষটিকে এতদিন সবাই কেবল তাদের আপসহীন সাহসী নেতা হিসেবে জেনে এসেছিল, সেই তিনি আজ গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞ সেনাপতিরূপে আবির্ভূত হলেন। তার মুখ থেকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল যেন বন্দুকের নল থেকে এই মাত্র বেরিয়ে যাওয়া একেকটি তপ্ত বুলেট।

টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত আকাশ কাঁপিয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল সেই বজ্রকণ্ঠ। এরই উন্মাদনায় পদ্মা-মেঘনা-যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে উঠেছিল ঝড়। ৪৮ বছর পর তার সেই ভাষণ আজও ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধের রক্তে উত্তাপ ছড়ায়, শিহরণ জাগায়। বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তার জীবনের স্বপ্ন উগরে দিলেন। দেহ ও কণ্ঠের সব শক্তি দিয়ে উচ্চারণ করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’ মানুষ আনন্দে ফেটে পড়ে, তৃপ্ত হৃদয়ে ঘরে ফিরে যায়। সেই দিন সরকার তার ভাষণ প্রচার করতে না দিলেও পরদিন সকালে রেডিও-টিভিতে তা প্রচারে বাধ্য হয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

এসএ/