স্বাধীনতা ঘোষণার স্থানটি নেই
রশীদ হায়দার :
প্রকাশিত : ১২:৪০ পিএম, ৭ মার্চ ২০১৯ বৃহস্পতিবার
ঢাকার শিশু পার্ক প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব জেনারেল জিয়াউর রহমানের। তাঁর আমলের উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে জেনারেল জিয়া উন্নয়নের জোয়ারের যে ফিরিস্তি দিয়েছিলেন তার মধ্যে বিশেষভাবে অন্যতম শাহবাগের শিশু পার্ক। জিয়া জানতেন শিশু পার্ক জনপ্রিয় হবে। বিভিন্ন বয়সের মানুষের সমাগমও হবে। সেই সমাগমে কেউ হয়তো খুঁজবে না বঙ্গবন্ধু কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর ‘অমর কবিতাখানি’ সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু জিয়া হিসাবমতো মাপজোখ করেই পাবলিক টয়লেটটি বসালেন—যেখানে স্বাধীনতার মূল ঘোষণাটি প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই উচ্চারিত হয়েছিল পৃথিবীর সব সভ্য দেশে গৌরব করার মতো কিছু না কিছু বিষয় বা দিন কিংবা স্থান থাকে। সভ্য দেশে সেসব স্থান অথবা দিন বা বিষয়কে জাতীয় বিষয় বিবেচনা করে বিশেষ মর্যাদায় উদ্যাপন করা হয়, সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে গর্ব বা অহংকার করার মতো বেশ কিছু ঘটনা আছে। যা আমরা গর্বভরে মাথা উঁচু করে বলতে পারি, ঘোষণা দিয়ে জানান দিতে পারি, দেখো, এই কাজটির মূল স্রষ্টা আমরা। আমাদের হাতেই এই অসম্ভব কাজটি করা সম্ভব হয়েছে। সংক্ষেপে আমার কথার যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য শুধু বলি, যেহেতু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, সেই জনযুদ্ধের যোদ্ধারা যুদ্ধের আধুনিক অস্ত্রাদি ব্যবহার করা তো দূর, অনেকেই চোখেও দেখেননি হয়তো, নামও সম্ভবত জানেন না। অবিশ্বাস্য সত্য হচ্ছে, জেনে বা না জেনে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি সৈন্যদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরি হচ্ছিল হাতে বানানো তীর-ধনুক নিয়ে, বর্শা, বল্লম, ফালা, টেঁটা ইত্যাদি মজুদ করে। এখন এসব আয়োজনের কথা শুনে হাসি পেতে পারে, কিন্তু তখনকার বাস্তবতায় তা-ই ছিল নির্মম সত্য।
১৯৭১ সালে যুদ্ধ যখন আসন্ন; বঙ্গবন্ধু ঠিকই জানেন এ যুদ্ধ অসম হলেও বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ ও ভাগ্য নির্ভর করছে এই যুদ্ধের ওপরই; তখনই তিনি ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বললেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই দিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি নিহিত ছিল ভবিষ্যতের পরিণতিতে, তাই ‘অসম’ যুদ্ধ হলেও তিনি জনগণকে ‘অসম’ অস্ত্র দিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মূল সত্য হলো, দুর্দমনীয় সাহস ও অসামান্য দেশপ্রেম যখন প্রচণ্ড রকম প্রবল হয়, তখন মৃত্যুও তুচ্ছ হয়ে যায়। পিঠে আঘাত নয়, বুকে মৃত্যু এঁকেই শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে হবে—এই দৃশ্য যখন পাকিস্তান ও তার দালালদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, তখনই তারা হয়ে পড়ে ঘরবন্দি, দিনে একটু-আধটু ফুটফাট করলেও রাতের বেলায় মনে হয় সর্বক্ষণ মৃত্যুর প্রহর গুনত। যাঁরা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তাঁরা এই সত্যটি আরো ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারবেন।
২.
ফিরে যাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমালার দিকে। আমরা সত্যিই যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে যুদ্ধ করেছি, শত্রুদের ভাতে বা পানিতে মেরেছি, মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, এটা সচেতন বিশ্ববাসী দেখতে বা বুঝতে ভুল করেনি। ভুল করেনি বলেই পাকিস্তানের বাঙালি দালালরা মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই নতুন চক্রান্তে মেতে ওঠে—কিভাবে এই অর্জনকে নস্যাৎ করা যায়। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের নেতা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাঙালিদের ভাতে মারার জন্য খাদ্যভর্তি জাহাজ সাগর থেকেই ফিরিয়ে নিয়ে যান, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে থাকেন, সে সবই তো ইতিহাসের পাতায় পাতায়, যুদ্ধ-পরবর্তী খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় লিখিত রয়েছে। চক্রান্ত করে বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষে ফেলে যে উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে, সেই ইতিহাসও বাঙালি জাতি ভুলে যায়নি। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলায় স্বাধীনতাবিরোধী ও পাকিস্তান-প্রেমিকদের সে কী উল্লাস! এখন কারা তলাবিহীন ও কারা ঝুড়িভর্তি—তা দিব্য চোখেই প্রমাণিত। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নোবেলজয়ী উপন্যাসের বিখ্যাত উক্তি—মানুষ মৃত্যুবরণ করতে পারে, কিন্তু কখনোই পরাজিত হয় না। নইলে ১৯৭১-২০১৮, ৪৭ বছরে বিশ্বে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অবস্থা ও অবস্থান যে কোথায় তা কি চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়োজন আছে?
বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস আসে, যখন দেখি স্বাধীনতা লাভের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরেও আমরা বাঙালি না বাংলাদেশি, তাই নিয়ে বাক্যুদ্ধে নামতে হয়। আগেকার পূর্ববঙ্গবাসীকে বাঙাল বলে পশ্চিমবঙ্গের ‘সভ্য’ বাঙালিরা যে পুলক বোধ করত, তারা তাদের দেশের রাষ্ট্রভাষার কাছে নতজানু হয়ে প্রতি পাঁচজনের দুজন-আড়াইজনই যে বাংলা বলে না, তা দুই পা ফেলে কলকাতায় গেলেই বোঝা যায়। অথচ আমরা একসময় কলকাতার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম, তাদের সাহিত্য পাঠের জন্য অপেক্ষা করতাম।
মাতৃভাষাকে খাটো করার জন্য কতই না চেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তান সরকার তো প্রথম থেকেই বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা বলে দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে একপাশে ঠেলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষাকে উপেক্ষা করে, করতে থাকে। চালাকি ও ছলনার একটা প্রমাণই যথেষ্ট। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালে রচিত শাসনতন্ত্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করা হলেও বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে ২০ বছর পর। অর্থাৎ ১৯৭৬ ও ১৯৮২ সালে। কিন্তু ইতিহাসের কী অমোঘ রায়, পূর্বোক্ত দুটি সালই কিন্তু তখন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অধিকারে।
৩.
বাংলাদেশের ইতিহাস ও মর্যাদাকে অপমান করার পর্ব কি এখনো চলছে না? চলছে। চলবে। কত দিন পর্যন্ত চলবে তা নির্ধারণ করবে সময় তথা ইতিহাস। প্রশ্নটি তোলার মূল কারণটি হচ্ছে একটি পাবলিক টয়লেট। ইংরেজি শব্দটি ব্যবহার করলাম, কারণ বাংলায় বললে সঙ্গে সঙ্গে নাকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ আঘাত করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি বা প্রতিবাদ হয়েছে কি না আমার জানা নেই। তেমন কোনো উচ্চবাচ্যও কানে আসেনি। দুর্গন্ধ বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে তা বেশি ছড়ায় বলে মানুষ নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করে বলে জেনেছি।
বিষয়টি খোলাসা করা যাক।
শহর-নগরবাসীর জন্য পার্ক একটা জরুরি বিষয়। মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিতে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পার্কের প্রয়োজন আছে। পার্কেরও প্রকারভেদ রয়েছে; যেমন—লেডিস পার্ক, শিশু পার্ক ইত্যাদি। আমাদের আজকের কথাটি ঢাকার শিশু পার্ক নিয়ে।
ঢাকার শিশু পার্ক প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব জেনারেল জিয়াউর রহমানের। তাঁর আমলের উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে জেনারেল জিয়া উন্নয়নের জোয়ারের যে ফিরিস্তি দিয়েছিলেন তার মধ্যে বিশেষভাবে অন্যতম শাহবাগের শিশু পার্ক। সামরিক শাসনেই তিনি দেশ চালাচ্ছিলেন। পরে রাজনৈতিক দল করে গণতন্ত্রের পোশাক পরালেও চরিত্রে সামরিক শাসনই বিরাজ করছিল। ছলে-বলে-কৌশলে বিরোধী পক্ষ তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা দল ও ব্যক্তিকে গোপনে, বিনা বিচারে, নিভৃতে নির্যাতন করে ‘স্বাধীনতাকে সমুন্নত’ রাখার যে গালগল্প আমরা শুনছিলাম, তার চিত্র তাঁর ‘শহীদ’ হওয়ার পরপরই বেরিয়ে আসতে শুরু করে। অনেকের কথা ও তথ্য থেকে জানা যায়, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে-বাইরে ১৯-২০ বার ‘মিলিটারি ক্যু’ হয়েছিল এবং এই ‘অপরাধে’ ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও ‘বীর-উত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত জিয়া কত শত নির্দোষ ও নিরীহ মুক্তিযোদ্ধাকে যে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তার হিসাব নেই। অবাক লাগে, যখন শুনি জিয়ার মৃত্যু হয় ‘শহীদ’-এর মর্যাদায় আর বঙ্গবন্ধু হন ‘সাধারণ মরহুম’। শোনা যায়, জিয়া মৃত্যুদণ্ডে স্বাক্ষর করতেন স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে বলতে, হাসতে হাসতে, চা খেতে খেতে; এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেও চা পানে আপ্যায়িত করার ‘উদারতাও’ তাঁর ভেতর দেখা গেছে।
কথাটা বিশ্বাসযোগ্য, কারণ বঙ্গবন্ধুকে খুন করার আগে ঘাতকদের কয়েকজন জিয়াকে জানাতে তাঁর বাসায় গিয়েছিল, ভোররাতে। জিয়া তখনো জেগে, শুধু তা-ই নয়, নির্বিকার মনে দাড়ি কামাচ্ছিলেন। অতি চালাক জিয়া মৌন সমর্থন ও সম্মতি জানিয়েছিলেন। শিশু পার্ক নিয়ে যে ঘটনার কথা বলতে যাচ্ছি, তা সংঘটিত হয়েছিল জিয়ার সমর্থন ও ইচ্ছাতেই।
বয়সী যাঁরা শিশু পার্কে যান, প্রয়োজনে অনেককেই পাবলিক টয়লেটও ব্যবহার করতে হয়। যাঁরা এটি ব্যবহার করতে যান, তাঁদের কাছেই জিজ্ঞাসা, আপনি কি জানেন আপনি ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার জায়গাটির ওপরই মল বা মূত্র ত্যাগ করছেন? বঙ্গবন্ধুর কোন ঘোষণাটি ছিল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ? বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকো পর্যন্ত যে ভাষণটিকে অমরত্বের মর্যাদা দিয়েছে, সেই ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণাটিই যে স্বাধীনতার ঘোষণা, তা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বুঝতে সময় লাগেনি। শুধু গুলি চালিয়ে, বোমাবর্ষণ করে গণহত্যার সূচনা করতে পারেনি, কারণ বঙ্গবন্ধু ঘোষণাটি তো সরাসরি দেননি।
ইতিহাস বলে, জেনারেল জিয়া সময় নিয়ে, ঝোপ বুঝে কোপ মারার অপেক্ষায় ছিলেন, যেটি পাওয়া গেল ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫; বঙ্গবন্ধু নেই, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটিও নেই হয়ে যেতে শুরু করে। কতখানি বিকৃত মানসিকতার মানুষ হলে জিয়া ওই কাজটি করতে পারেন? তিনি নিজে কখনো সরাসরি বা প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর নিন্দা-মন্দ বা সমালোচনা করেননি, কিন্তু যা করেছেন তাতে পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির সাহস ও শক্তি যে বৃদ্ধি পায়, তা তো পদে পদে প্রমাণিত।
জিয়া জানতেন শিশু পার্ক জনপ্রিয় হবে। বিভিন্ন বয়সের মানুষের সমাগমও হবে। সেই সমাগমে কেউ হয়তো খুঁজবে না বঙ্গবন্ধু কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে তাঁর ‘অমর কবিতাখানি’ সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু জিয়া হিসাবমতো মাপজোখ করেই পাবলিক টয়লেটটি বসালেন—যেখানে স্বাধীনতার মূল ঘোষণাটি প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই উচ্চারিত হয়েছিল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক
এসএ/