৭ মার্চের ভাষণ : বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা
মুনতাকিম আশরাফ :
প্রকাশিত : ০২:১১ পিএম, ৭ মার্চ ২০১৯ বৃহস্পতিবার
বেলা ১১টা বাজতেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল সেদিনের রেসকোর্স ময়দান, আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। গণসূর্যে মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি। অগ্নিঝরা সে ভাষণের প্রতিটি বাক্যই ছিল কবির কবিতার মতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের অগ্নিঝরা দিন একাত্তরের ৭ মার্চের সেই কবিতার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সব অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সদা প্রতিবাদী এবং দেশ, জনগণ, অধিকার ও নীতির প্রশ্নে সর্বদা আপসহীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে স্বীকৃতি পান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল তাৎক্ষণিক, উপস্থিত ও অলিখিত। ১৮ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষাকে একসূত্রে গেঁথে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এক হাজার ৯৫ শব্দে বুলেটমালা গেঁথে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সমস্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তিনি সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি শেষ করেন।
বঙ্গবন্ধু অন্তরের গভীরে যা বিশ্বাস করতেন, বক্তৃতায় তা-ই তিনি ব্যক্ত করতেন। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল তার হৃদয়ের গভীরে যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাস থেকে উৎসারিত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সর্বজনীনতা ও মানবিকতা। যে-কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য এই ভাষণ সব সময়ই আবেদন সৃষ্টিকারী। এই ভাষণে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, মানবতা এবং সব মানুষের কথা বলা হয়েছে। ফলে এই ভাষণ দেশ-কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বজনীন হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া বুঝতে পেরেছেন। তারা যা চেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু তা-ই তাদের কাছে তুলে ধরেছেন। ফলে এই ভাষণটি একটি জাতির প্রত্যাশার আয়নায় পরিণত হয়। এই ভাষণই একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এই ভাষণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে, গবেষণা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকেও ঠাঁই পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো।
জাতির জনকের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, ভাষণটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পুরো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশ্বসম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের মতে, ‘বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আরেকটি পরিকল্পিত ও বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এবং দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।’
এএফপি বলেছে, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণেরই আলোকে।’
আনন্দবাজার পত্রিকার এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘উত্তাল জনস্রোতের মাঝে, এ রকম একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দিকনির্দেশনামূলক ভাষণই শেখ মুজিবকে অনন্য এক ভাবমূর্তি দিয়েছে দিয়েছে অনন্য মহান নেতার মর্যাদা।’
শান্তিতে নোবেলবিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি, বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’
অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক। তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে।’
পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা, অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা।’
কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’
গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যত দিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, তত দিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
সময়ের পরিক্রমায় বছর পেরিয়ে আবারও ৭ মার্চ আসে। ৪৮ বছর ধরে রক্তঝরা একাত্তরের ৭ মার্চের সেই ভাষণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে বাঙালির মানসে। স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তধরা দিনের সেই ভাষণ দেখেনি আজকের তরুণ প্রজন্ম। কিন্তু নানা, নানি, দাদা, দাদি বা বাবা কিংবা মায়ের কাছ থেকে শোনা, তারপর ক্যাসেট বা সিডিতে শুনে শুনে তারা ঠিকই ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি আত্মস্থ করে ফেলেছে। আজও সেই ভাষণ শুনলে আমাদের শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। আজও বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ শুনলে আমরা উজ্জীবিত হয়ে উঠি। সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনলে আজও আমাদের রক্তে শিহরন জাগে।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলিহেলনে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’য় পরিণত করাই ছিল তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করে এনে দিয়েছিলেন আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী পাক হায়নাদের প্রেতাত্মা তথা সেনাবাহিনীর একটি চক্রান্তকারী চক্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে পুরো বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। এই কলঙ্কের দায়ভার আমাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়একটি মহাকাব্য, একটি স্বাধীনতা, একটি সার্বভৌম বাংলাদেশ। জাতির জনকের জন্ম না হলে বাংলাদেশ নামক এই শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্রের জন্ম হতো না। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে বলতে পারতাম না আমরা বাঙালি, বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় জন্ম ভূমি। ১৯৯৭ সালের একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই। জীবনের পুরোটা সময় মানবতার মুক্তির সংগ্রামে ব্যয় করা বিশ্বের বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা শান্তিতে নোবেলজয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা একবার ঢাকায় এসেছিলেন। ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট মুক্তিকামী মানুষের নেতা ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে, এমন একটি জাতিকে শ্রদ্ধা জানাতে আমি বাংলাদেশে এসেছি।’ মার্চ মাসে সদ্যপ্রয়াত বিশ্বনেতা নেলসন মেন্ডেলার কথাগুলো বারবার মানসপটে ভেসে উঠছে। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ইতিহাস রচিত হয়েছে যাঁকে কেন্দ্র করে, বাঙালি জাতিকে যিনি বিশ্বদরবারে সুমহান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন, তিনি হলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বাঙালির প্রাণপুরুষ মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাঁর ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণ জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল এক অভিন্ন লক্ষ্যে। আর আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন করেছি লাখো প্রাণের বিনিময়ে। তাই আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সেই মহান শহীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করছি।
লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, এফবিসিসিআই
এসএ/