ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব বণ্টন করে দেন

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত : ০৩:৩৩ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৩:৩৫ পিএম, ৮ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার

৭ মার্চের ভাষণে সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে প্রদত্ত ১০টি নির্দেশ ৮ মার্চ থেকে হুবহু অনুসৃত হতে থাকে। এই প্রথমবার বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘গ্রামে, মহল্লায় যাও। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করো।’

আমাদের মধ্যে চারজন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব দিয়েছিলেন যুব ও তরুণ সমাজকে সংগঠিত করার জন্য। আমরা নেতার নির্দেশে উদয়াস্ত সে কাজেই নিজদের ব্যস্ত রেখেছি। এছাড়াও সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালিদের সংগঠিত করার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন কর্নেল ওসমানীকে। এ কাজে আমাকেও বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

১৯৭১-এর ৮ মার্চ ছিল সোমবার। গতকাল ইতিহাসের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে চারটি শর্ত প্রদান করে বলেন, `পরিষদে যাওয়ার প্রশ্ন বিবেচনা করতে পারি যদি- ১. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হয়; ২. সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়; ৩. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করা হয় এবং ৪. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়।

আগে এসব দাবি মানতে হবে। আর সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে সর্বমোট ১০টি নির্দেশ প্রদান করেন- ১. বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ রাখুন; ২. সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্টে হরতাল পালন করুন; ৩. রিকশা, বেবি, বাস-ট্যাক্সি প্রভৃতি রেলগাড়ি ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন; কিন্তু জনগণের উপর জুলুম চালাবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করবেন না; ৪. বেতার-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বক্তৃতা-বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ প্রদান করুন এবং গণআন্দোলনের কোন খবর গায়েব করবেন না।

যদি তাতে বাধা দেওয়া হয় তবে কোন বাঙালী কাজে যোগদান করবেন না; ৫. শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন; ৬. স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বন্ধু রাখুন; ৭. সকল গৃহশীর্ষে কালো পতাকা উড্ডীন রাখুন; ৮. ব্যাঙ্কসমূহ প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে যেন এক পয়সাও পাচার না হয়; ৯. অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ হতে হরতাল প্রত্যাহূত হলো; কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে কোন সময় পুনরায় আংশিক বা পূর্ণদিবস হরতাল দেওয়া হতে পারে, সে জন্য প্রস্তুত থাকুন; ১০. প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন।`

গতকাল রোববার বাংলার সংগ্রামী জনতার তুমুল করতালির মধ্যে বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের উপরোক্ত রূপরেখা প্রদান করে আসন্ন স্বাধীনতার ঘোষণাও উচ্চারণ করে বজ্রকণ্ঠে বলেন, `এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।` গতকালের পর আজ ৮ মার্চ থেকে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব। জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত নিরস্ত্র বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রতিদিন সশস্ত্র হয়ে উঠতে থাকে।

এদিন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিব গণমাধ্যমের উদ্দেশে একটি লিখিত বিবৃতি প্রদান করেন। এই বিবৃতিটি ছিল গত শনিবার জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত ভাষণের বিপরীতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি দলীয় জবাব। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের নিভৃত কোণে ঠাঁইপ্রাপ্ত সুদীর্ঘ এই বিবৃতিটি এক ঐতিহাসিক দলিল।

গত শনিবার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে যেসব কথাবার্তা বলেন, এদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর জবাব প্রদান করে জেনারেল ইয়াহিয়ার উদ্দেশে বলেন, "১লা মার্চ তারিখে আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সেদিন হতে ৬ই মার্চ পর্যন্ত বাংলার মানুষ সামরিক মোকাবেলার অধীনে রয়েছে।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিক ও অবাঞ্ছিতভাবে স্থগিত ঘোষণা করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত নিরস্ত্র বেসামরিক অধিবাসীদের (শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র) ওপর ব্যাপকভাবে গুলি চালানো হয়েছে। গত সপ্তাহে যারা প্রাণ দিয়েছেন তারা শহীদ। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন খামখেয়ালিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করার ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণ করতে গিয়ে তারা মৃত্যুবরণ করেছেন।

এই শহীদানদের ধ্বংসকারী শক্তি অ্যাখ্যাদান নিঃসন্দেহে সত্যের অপলাপ। প্রকৃতপক্ষে তারাই ধ্বংসকারী শক্তি, যারা বাংলাদেশের বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির জন্য দায়ী। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গত সপ্তাহে যে বিভীষিকার সৃষ্টি করা হইয়াছে তাহা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসিবার সময় করিতে পারিলেন না।

প্রেসিডেন্ট যাহাকে সর্বনিম্ন শক্তি প্রয়োগ বলিয়াছেন, তাহাতেই যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হইতে পারে, তাহা হইলে তাহার অভিহিত `পর্যাপ্ত` শক্তি প্রয়োগের অর্থ কী আমরা সম্পূর্ণ নির্মূল করাই বুঝিব?" আসলে পাকিস্তানি সেনা শাসকরা যে বাঙালিদের `সম্পূর্ণ নির্মূল` করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, এটা বুঝতে আমাদের কারোরই সন্দেহ ছিল না। কেননা প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাহাজ-উড়োজাহাজে অস্ত্র-গোলা আসছে।

প্রতিদিনই শত শত নিরস্ত্র-নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃবৃন্দ গণহত্যার বিষয়ে ছিলেন সজাগ। বঙ্গবন্ধুর হিসাব ছিল পরিস্কার। তিনি সবসময় এটা বলতেন যে, `গোটা দেশে আমরা বাঙালিরা সংখ্যাগুরু; সংখ্যাগুরু কখনোই বিচ্ছিন্নতার দাবি করতে পারে না।` তাছাড়া আমরা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছি। সুতরাং আঘাত করলে ওদেরকেই সেটা আগে করতে হবে; কেননা তারা সংখ্যালঘু।

আর আমরা তাদের আঘাত প্রতিরোধ করব। আর তাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণের সমালোচনায় বঙ্গবন্ধু তাঁর লিখিত বিবৃতিটিতে এতদ্বিষয়ে চুলচেরা বিশ্নেষণ করে শাসকগোষ্ঠীকে ষড়যন্ত্র ও শক্তির পথ পরিহারের আহ্বান জানান। অপরদিকে ৭ মার্চের ভাষণে সংগ্রামী জনতার উদ্দেশে প্রদত্ত ১০টি নির্দেশ আজ থেকে হুবহু অনুসৃত হতে থাকে। এই প্রথমবার বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে থাকে।

বঙ্গবন্ধু আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, `গ্রামে, মহল্লায় যাও। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করো।` আমাদের মধ্যে চারজন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব দিয়েছিলেন যুব ও তরুণ সমাজকে সংগঠিত করার জন্য।

আমরা নেতার নির্দেশে উদয়াস্ত সে কাজেই নিজদের ব্যস্ত রেখেছি। এছাড়াও সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালিদের সংগঠিত করার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন কর্নেল ওসমানীকে। এ কাজে আমাকেও বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এভাবেই আমাদের একেকজনকে পৃথক পৃথক দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছিলেন। আর ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করার দায়িত্বভার দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সর্বজনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও শাজাহান সিরাজকে।

এভাবে সব পর্যায়ের যোগ্যতরদের যথাযথ স্থানে অধিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুনিপুণভাবে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে প্রতিটি নিরস্ত্র বাঙালি হয়ে উঠল সশস্ত্র। গণমানুষের জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে একসূত্রে গেঁথে তুললেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য