ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

পুরনো জৌলুস ফিরে পাচ্ছে ডাকসু

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ১০:৩২ এএম, ১০ মার্চ ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ০৯:১৬ পিএম, ১০ মার্চ ২০১৯ রবিবার

দীর্ঘ ২৮ বছরের পর বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামীকাল সোমবার। সকাল ৮টা থেকে শুরু হবে ভোট গ্রহণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ হাজার ১৭৩ জন শিক্ষার্থী নিজের ভোটাধিকার প্রদান করে নতুন নেতৃত্বকে বেছে নিবে এমন আশা সংশ্লিষ্টদের। আগামীকাল ভোটের মধ্যে দিয়ে আসবে ডাকসু ও হল সংসদগুলোর নতুন নেতৃত্ব। তাদের সাদরে বরণ করে নিতে অপেক্ষায় রয়েছেন ছাত্র-শিক্ষকসহ পুরো ঢাবি পরিবার। কারণ নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আড়াই দশকের বেশি সময় পর আবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা। নির্বাচন ঘিরে সব প্রস্তুতি শেষ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এবারের নির্বাচনে ১০ প্যানেলে মোট প্রার্থী সংখ্যা ৭৩৮ জন অংশ নিয়েছে। তাদের মধ্যে ডাকসুতে প্রার্থী হয়েছেন ২২৯ জন। ১৮ টি হলে ৫০৯ জন প্রার্থী হয়েছে । এর বাইরে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও। ইতোমধ্যে বিনা ভোটে ৬৫ জন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের ৫০জন প্রার্থী রয়েছে।

ডাকসু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই উৎসবের আমেজ বিরাজ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গতকাল শনিবার প্রচারের শেষ দিনটিও দারুণ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে প্রার্থী ও ভোটারের পদচারণায়। ছুটির দিন থাকায় প্রচারে বিশেষ গুরুত্ব পায় আবাসিক হলগুলো। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি, অপরাজেয় বাংলার মতো জমজমাট আড্ডাস্থলগুলোও লিফলেট বিতরণসহ বহুমুখী প্রচারে মুখর থাকে সারাদিন।

আচরণবিধি অনুসারে শনিবার ছিল প্রচারণার শেষ দিন। শেষ দিনের প্রচারণায় প্রার্থীরা সকলেই উত্সবমুখর পরিবেশে নিজেদের জন্য ভোট চেয়েছেন। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দিনভর প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আবাসিক হলগুলো। এছাড়া মধুর ক্যান্টিন এবং টিএসসি কেন্দ্রীক প্রচারণাও ছিল চোখে পড়ার মত।

নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, এরই মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এখন সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, আমরা এখন ভোটের অপেক্ষায় রয়েছি। নিরাপত্তা, ব্যালট, প্রার্থিতা, হল ম্যানেজমেন্ট, বুথ ও কেন্দ্র সব নির্ধারিত হয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী, হাউস টিউটর, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রক্টরিয়াল বডি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মোবাইল টিম, মোবাইল পুলিশ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে থাকবেন। সঙ্গে আর্চওয়ে, ক্যামেরা ও সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে। এগুলোর মাধ্যমেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। তবে প্রয়োজন ছাড়া পুলিশ থাকবে না।

ডাকসু নির্বাচনের সার্বিক বিষয় নিয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন `সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদ` প্যানেলের ভিপি প্রার্থী রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশের মাধ্যমেই ডাকসু নির্বাচন হোক, তা আমরা চাই। এখানে সব শিক্ষার্থীর স্বতঃস্ম্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকবে। সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব সবার। আর শিক্ষার্থীরা যাকে রায় দেবেন, আমরা তা মেনে নিয়ে তাদের সাদরে গ্রহণ করব। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার ফিরে পাচ্ছে। আমরা তাদের জন্য কাজ করতে চাই। তবে শুধু প্রতিশ্রুতি দিতে চাই না। নির্বাচিত হই বা না হই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাব।

ছাত্রদল প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান অভিযোগ করেন, প্রশাসন শুরু থেকেই বিশেষ একটি সংগঠনের পক্ষে কাজ করছে। তাদের পক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমরা শুনেছি, ভোটের দিন ছাত্রলীগের কর্মীদের সারিবদ্ধ লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হবে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়া হবে। সবাই যেন ভোট দিতে না পারে। নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে আমরা শঙ্কিত। ক্যাম্পাস ও হলে আমাদের কর্মীদের প্রচারে নানাভাবে বাধা প্রদান ও হেনস্তা করা হয়েছে। কয়েকবার লিখিত অভিযোগ দিয়েছি, কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তার পরও আমরা ডাকসুর ব্যাপারে ইতিবাচক রয়েছি। সর্বশেষ সময় পর্যন্ত দেখতে চাই এবং দেখব। শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ থাকবে, তারা যেন ভোট দিতে আসেন। তবে কূটকৌশলের নির্বাচনের চূড়ান্ত রূপ যদি দেখতে পাই, তাহলে সব ছাত্র সংগঠন সংঘবদ্ধ হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলব। তিনি আরও বলেন, স্বল্প সময়ের ভেতরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বোঝার চেষ্টা করেছি। তাদের দাবি ও সমস্যা নিয়ে ইশতেহার প্রণয়ন করেছি। আবাসন সমস্যা, গবেষণা প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরে তা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছি।

প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য প্যানেলের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী বলেন, নির্বাচনে আমাদের জয় বা পরাজয় মুখ্য নয়। শিক্ষার্থীদের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্ল্যাটফর্ম ডাকসু চালু হবে, সেটিই মুখ্য। শুরু থেকেই আমরা এক ধরনের প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে চলছি। প্রশাসন আমাদের দাবি না মেনে নির্দিষ্ট একটি দলের কথাই শুনছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হলে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি। ভয়ভীতি প্রদর্শন ও আমাদের ব্যানার সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীরা যদি ভোট দিতে আসেন, তাহলে তাদের সম্মিলিত প্রতিবাদে এসব অপকৌশল ও চক্রান্তকে রুখে দেওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করি। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের সূচনা হবে বলে প্রত্যাশা করি।

`বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদে`র ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুর অভিযোগ করেন, তাদের বিভিন্ন প্রার্থীকে নানাভাবে বাধা ও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রশাসনের বিমাতাসুলভ আচরণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সবার মধ্যেই শঙ্কা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রশাসন সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা সবার। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ডাকসু বন্ধ থাকায় ছাত্রদের দাবি ও অধিকার বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। ক্যাম্পাসে একটি লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে। এখন শিক্ষার্থীরা চান ডাকসু তাদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হোক। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতিচর্চার পুণ্যভূমি হিসেবে পুনরায় স্থাপন করতে চাই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনে `সময়` ও `শিক্ষার্থী`র সংখ্যা বিবেচনায় বিভিন্ন হলে পোলিং বুথ বসানো হবে। এর মধ্যে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ২০টি, কবি জসীমউদ্‌দীন হলে ২০টি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৩৫টি, সূর্য সেন হলে ৩৫টি, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৩০টি, রোকেয়া হলে ৫০টি, কবি সুফিয়া কামাল হলে ৪৫টি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ২২টি, স্যার এ এফ রহমান হলে ১৬টি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ২৪টি, অমর একুশে হলে ২০টি, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ২২টি, বিজয় একাত্তর হলে ৪০টি, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ১৯টি, জগন্নাথ হলে ২৫টি, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৩৫টি পোলিং বুথ বসানো হবে। তবে শামসুন নাহার হল ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের তথ্য পাওয়া যায়নি।

হল প্রশাসনের প্রস্তুতির ব্যাপারে সূর্য সেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, প্রস্তুতি এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দপূর্ণ উত্তেজনা বিরাজ করছে। তারা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করা হয়েছে। ভোটকক্ষ প্রস্তুত করা এবং যে শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করবেন, তাদের সব বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে নির্বাচনের জন্য একটি পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নেওয়া আছে। শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন অনুযায়ী পোলিং বুথ বসানো হবে।

 

টিআর/