ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

বঙ্গবন্ধুর বাসভবন হয়ে ওঠে বাঙালির তীর্থকেন্দ্র

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত : ০১:২৭ পিএম, ১৮ মার্চ ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৪:০০ পিএম, ১৯ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার

১৯৭১-এর ১৮ মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস। স্বাধিকারকামী অসহযোগ আন্দোলনের ধারাক্রমে প্রবীণ-নবীন নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের শ্রেণি-পেশার মানুষের ঢল নেমেছে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডির ৩২নং বাসভবনে। বাসভবনটি যেন বাংলার মুক্তিকামী মানুষের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। ভোর থেকে গভীর রাত অবধি শত শত মিছিলের লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে স্লোগানে মুখরিত নেতার বাসভবনের সম্মুখ প্রাঙ্গণ। শপথদীপ্ত ছাত্রছাত্রী, যুবক-যুবতী, শিক্ষক-কর্মচারী, চিকিৎসক-নার্স, শ্রমিক-কৃষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবীদের সংগঠন অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপনপূর্বক নেতার আশীর্বাদ কামনা করেন। নেতার বাসভবনে সমাগত বিদেশি সাংবাদিকদের এসব মিছিলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আবেগভরা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিদেশি বন্ধুরা, দেখুন। আমার দেশের মানুষ আজ প্রতিজ্ঞায় কী অটল! সংগ্রাম আর ত্যাগের মন্ত্রে কত উজ্জীবিত! কার সাধ্য এদের রোখে? আমার দেশ আজ জেগেছে, জনগণ আজ জেগেছে। জীবন দিতে শিখেছে। স্বাধীনতার জন্য জীবনদানের অগ্নিশপথে দৃপ্ত, জাগ্রত জনতার এ জীবন-জোয়ারকে, প্রচণ্ড এ গণবিস্টেম্ফারণকে স্তব্ধ করতে পারে- এমন শক্তি মেশিনগানেরও আজ আর নাই। ভোর ৫টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আপনারা কেবল একই দৃশ্য দেখতে পাবেন।’

বাসভবনে আগত একের পর এক মিছিলের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রত্যয়দৃপ্তভাবে মুক্তিসংগ্রামের পতাকা আরও ঊর্ধ্বে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে আপামর বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, ‘বাংলার মানুষ, তোমরা ঘরে ঘরে সংগ্রামের দুর্গ গড়ে তোলো। আঘাত যদি আসে, প্রতিহত কর, পাল্টা আঘাত হানো। ৭ কোটি শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। চরম ত্যাগের বিনিময়ে হলেও আমরা লক্ষ্যে পৌঁছবই। দরকার হলে রক্ত দিয়েই আমরা দাবি প্রতিষ্ঠা করব, তবু শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। দাবি আদায় শান্তিপূর্ণভাবে হলে ভালো। নইলে সংগ্রামের দুর্গম পথ ধরেই আমরা লক্ষ্যস্থলে গিয়ে পৌঁছব।’ নার্সিং স্কুলের ছাত্রীদের এক বিশাল মিছিল বঙ্গবন্ধুর সামনে সমবেত হয়ে গগনবিদারী স্বাধীনতার স্লোগান দিতে থাকলে বঙ্গবন্ধু নিজেই করতালি দিয়ে মিছিলটিকে স্বাগত জানিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা স্বাধীনতা পাবে।’ এ সময় কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিকের একটি গ্রুপ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসে। নেতাও স্বল্পকালের জন্য সাক্ষাৎকার দেন। একজন প্রশ্ন করেন, ‘মি. ভুট্টো কি ঢাকা আসছেন?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জানি না।’ অপর একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার কাছে কি এমন কোনো খবর আছে যে, এখানে আরও সৈন্য এসে পৌঁছেছে?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে যা কিছুই ঘটে, সব খবরই আমি রাখি।’

এদিকে গত ২ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কী পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সামরিক বাহিনীকে ডাকা হয়েছিল, তা তদন্তের জন্য ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক ৫ সদস্যবিশিষ্ট যে কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেন, সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, ‘এহেন তদন্ত কমিশন আমরা চাই নাই। আমরা চেয়েছিলাম সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত।’ সেহেতু, সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিযুক্ত কমিশনের সঙ্গে কোনোরূপ সহযোগিতা না করার জন্য তিনি সবার প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ‘আমি দুঃখিত, যে তদন্ত কমিশনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে উত্থাপিত আমার দাবির পরিপূরক নয়। একটি সামরিক নির্দেশবলে এই সামরিক কমিশন গঠন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছেই এর রিপোর্ট দাখিলের বিধান অত্যন্ত আপত্তিকর। কমিশনের বিবেচ্যসূচিই মূল ইস্যুর পূর্বাহ্নিক বিচার এবং আসল ইস্যুর তদন্ত না করার মতলব ফাঁস করে দিয়েছে। একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, মার্চ মাসের ২ তারিখ থেকে ৯ তারিখের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় যে পরিস্থিতিতে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল, তা নির্ধারণ করা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্যার্থে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই সেনাবাহিনী তলব ও শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল কি-না, তা তদন্ত করতে হবে বিধায় মূল বিষয় সম্পর্কে শুনানির আগেই বিচার করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব নির্যাতনমূলক কার্যকলাপে হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে, সে সম্পর্কেও তদন্ত করার এখতিয়ার তদন্ত কমিশনকে দেওয়া হয়নি। আর তাই কতজন মারা গেছে, কী পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করা হয়েছে, সেটিও তদন্ত করে দেখা যাবে না। এহেন কমিশনের দ্বারা কোনো ফলপ্রসূ লক্ষ্য হাসিল হতে পারে না। বস্তুত, এটি মোটেই সত্যে উপনীত হওয়ার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি যথাযথ তদন্ত হবে না। হবে জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার একটি ফন্দিমাত্র। তাই আমরা এ কমিশন মেনে নিতে পারি না। বাংলাদেশের জনগণ কোনো প্রকারেই এ ধরনের কমিশনের সঙ্গে কোনো সহযোগিতা করবে না। কেউ এ কমিশনে কোনো সদস্য মনোনীত করবেন না এবং কেউ এর অধীনে কাজ করবেন না। জনগণের পক্ষ থেকে আমরা গত ৭ মার্চ ৪ দফা দাবি তুলেছি। এর একটি দাবি ছিল, যথাযথ বিবেচ্যসূচিসহ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত অনুষ্ঠান। সে দাবিগুলোর নামমাত্র বা খণ্ডিত স্বীকৃতি, তাও উল্লিখিত পদ্ধতিতে আমাদের সামনে বিরাজমান গভীর সংকট সমাধানে কিছুমাত্র সহায়ক হবে না।’

সামরিক সরকার কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশন দেশের সব মহল কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। সব রাজনৈতিক মহল থেকে কমিশন প্রত্যাখ্যান করে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এদিকে গত মঙ্গল ও বুধবার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও আজ কোনো বৈঠক হয়নি। তবে আগামীকাল পুনরায় তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া আজ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে কয়েকশ’ লোক মিছিল সহকারে এসে এই মর্মে অভিযোগ করে- ‘গত কয়েক দিন যাবৎ সেনাবাহিনীর সদস্যরা যশোর, খুলনা, রাজধানী ঢাকার মহাখালী এসব জায়গায় সাধারণ মানুষের ওপর জোর-জুলুম করে, মারধর করে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে। বিনা উস্কানিতে সেনাবাহিনীর এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা এবং দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, ‘কোনোরূপ উস্কানিমূলক আচরণ তা যে মহলই করুক না কেন, তা সহ্য করা হবে না এবং এর দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে উস্কানিদাতাদেরই বহন করতে হবে।’ এদিকে নিউজপেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েমের লক্ষ্যে সব বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রস্তুত হওয়ার জন্য দেশের শ্রমিক শ্রেণির প্রতি আহ্বান জানায়। প্রাক্তন বৈমানিকরা শহীদ মিনারে এক প্রতিবাদ সভায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এদিনে মিছিল এবং প্রতিবাদ সমাবেশের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল বিপুল সংখ্যায় নারীদের উপস্থিতি। আজ চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে আগত ৪৩ হাজার টন গম বহনকারী আরেকটি জাহাজ গতিপথ পরিবর্তন করে অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে চলে গেছে। এমন সংবাদে স্পষ্টই বোঝা যায়, আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে খাদ্যের বদলে সৈন্য এবং অস্ত্র আগমনে জেনারেল ইয়াহিয়ার আসল উদ্দেশ্যটা কী?

সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলিত রেখে এবং অফিস-আদালতে যোগদানে বিরত থেকে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ অসহযোগকে সফল করে তুলেছে। ঢাকার রাজপথ বিক্ষোভকারী জনতার পদভারে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলন এবং কর্মসূচির প্রতি রাজনৈতিক মতভেদ নির্বিশেষে সব প্রতিষ্ঠান, সব শ্রেণির মানুষ সংঘবদ্ধভাবে অকুণ্ঠচিত্তে এক কণ্ঠ হয়ে নিরঙ্কুশ সমর্থন প্রদান এবং তার নির্দেশকে বাস্তবায়ন করতে মিছিল, সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, সশস্ত্র প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে যেভাবে শপথ ও প্রস্তুতি গ্রহণ করছে, তাতে আসন্ন সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।