অগ্নিঝরা মার্চ
জয়দেবপুরে সশস্ত্র বিদ্রোহ
তোফায়েল আহমেদ :
প্রকাশিত : ১১:৩৪ এএম, ১৯ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার
১৯৭১-এর ১৯ মার্চ দিনটি ছিল শুক্রবার। আজ লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টাদশ দিবস অতিবাহিত হয়। আজও রাজধানীর সব সরকারি-বেসরকারি বাসভবন এবং যানবাহনগুলোয় কালো পতাকা উড্ডীন থাকে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনানুযায়ী বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা অব্যাহত থাকে। স্বাধিকার আদায়ের দাবি এবং বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার সমর্থনে রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত থাকে। একদিন বিরতির পর আজ সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আজকের আলোচনা ৯০ মিনিটকাল স্থায়ী হয়। আজও আলোচনা চলে ওয়ান টু ওয়ান; অর্থাৎ তৃতীয় কেউই উপস্থিত ছিলেন না। আলোচনা শেষে দুপুর ১২টায় স্বীয় বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, `আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে। আমরা আগামীকাল সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে পুনরায় আলোচনা বৈঠকে বসব। তৎপূর্বে উপদেষ্টা পর্যায়ে সন্ধ্যায় আমার প্রতিনিধি এবং প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।` আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, `আলোচনার কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আরও সময়ের প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি, জেনারেল ইয়াহিয়া বাস্তবতাকে অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। তার বিপরীত কিছু ঘটলে তা হবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা পিছু হটতে পারব না- এটা তাদের বুঝতে হবে।` আলোচনাকালে প্রেসিডেন্ট কোনো প্রস্তাব দিয়েছিলেন কি-না- এরূপ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, `ইয়াহিয়া খান বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াসের ব্রিফ অনুযায়ী আগে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের প্রস্তাব দিলে আমি সঙ্গে সঙ্গে তা নাকচ করে দিই এবং প্রথমে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবির পুনরুল্লেখ করি।` শাসনতান্ত্রিক সংকট প্রশ্নে কোনো আলোচনা হয়েছে কি-না- একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, `আমি প্রেসিডেন্টকে বলেছি, দেশের সংবিধানের খসড়া রচনা হয়ে গেছে এবং সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে তা পেশ করা হবে। এর ফলে দেশে যে শাসনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সংকট বা জটিলতা সৃষ্টির কথা বলা হচ্ছে, তা একটি কাল্পনিক বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। বরং আমার দাবিগুলো না মানা হলেই এসব জটিলতা বাড়তে পারে এবং দিন দিন পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। অযথা কালক্ষেপণ করা ঠিক নয়।` আজকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বেলা আড়াইটায় সেনাবাহিনীর গণবিরোধী কাজের প্রতিবাদে জয়দেবপুরে প্রায় ১০ হাজার লোক এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। শান্তিপূর্ণ এ মিছিলটি জয়দেবপুর চৌরাস্তা ও রেলগেটের কাছে অবস্থান গ্রহণ করলে বিনা উস্কানিতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা জনসাধারণের ওপর গুলিবর্ষণ ও এলোপাতাড়ি বেয়নেট চার্জ করে। ফলে ঘটনাস্থলে নয়জন এবং পরে আরও ১১ জনের মৃত্যু ঘটে এবং শতাধিক লোক আহত হয়। প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগদলীয় কর্মীদের প্রাপ্ত তথ্যে অবগত হই, জয়দেবপুর চৌরাস্তা ও রেলগেটের কাছে জমায়েত হওয়া হাজার হাজার লোকের ওপর গুলিবর্ষণের সংবাদে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে লাখো মানুষ ছুটে আসে এবং সড়ক অবরোধ করে। তারা বিনা উস্কানিতে সেনাবাহিনীর এ বর্বরোচিত হামলার বিচার দাবি করতে থাকলে সেনাবাহিনী পুনরায় ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। ঘটনাটি ঘটেছিল রাজধানী থেকে ২০ মাইল দূরে জয়দেবপুরে। এখানে অবস্থানরত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের বাঙালি সৈনিক এবং কর্মকর্তারা এদিন তাদের ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তাদের হাতিয়ার ছিনিয়ে নিরস্ত্র করার ষাড়যন্ত্রিক এক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। ঘটনাটি ছিল বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া আলোচনা চলাকালেই স্বাধিকারের দাবি আদায় না হলে পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রথম স্বতঃস্টম্ফূর্ত সশস্ত্র বিদ্রোহ।
সকালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু এবং প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে দু`ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন মি. এআর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান। বৈঠক শেষে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ফিরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তাজউদ্দীন আহমদ জানান, `উপদেষ্টা পর্যায়ের এই বৈঠকে দেশের স্বার্থসংশ্নিষ্ট রাজনৈতিক সমস্যাবলির বহু বিষয় আলোচিত হয়েছে।` বৈঠকে কোনো বিশেষ ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, `আজ বলব না। তবে কোনো ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হোক বা না হোক, বহু কিছু সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে।` শাসনতান্ত্রিক ইস্যুতে কোনো আলোচনা হয়েছে কি-না- জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, `অবশ্যই! শাসনতান্ত্রিক সংকটই তো আজ দেশের মূল সমস্যা।` উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক আবার কখন অনুষ্ঠিত হবে- এরূপ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, `শেখ সাহেব এবং প্রেসিডেন্টের মধ্যে পরবর্তী বৈঠকেই তা নির্ধারণ করা হবে।` উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে জয়দেবপুরে গুলিবর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে কি-না- জানতে চাওয়া হলে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, `সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য এবং নিন্দা প্রকাশ করেছি।`
এদিকে বরাবরের মতো আজও বঙ্গবন্ধুর বাসভবন মিছিল আর জনস্রোতে প্লাবিত ছিল। বিজ্ঞান কর্মচারীদের এক বিশাল মিছিলের উদ্দেশে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, `বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার অর্জনের কোনো ত্যাগকেই অসাধ্য বলে বিবেচনা করা হবে না। বাংলাদেশের রাজপথ, অলি-গলি শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ আবার জয়দেবপুরের মাটি শহীদের রক্তে সয়লাব হয়ে গেছে।` সামরিক শাসকদের উদ্দেশে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করে তিনি বলেন, `আর কত রক্ত চাও? আর কত রক্ত পান করলে তোমাদের তৃষ্ণা মিটবে? আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান চেয়েছি। আর তোমরা চাও অস্ত্রের জোরে, শক্তির জোরে শাসন করতে। কিন্তু বাঙালিদের শক্তির জোরে দাবিয়ে রাখা যাবে না।` এদিন ঢাকার সোভিয়েত কনসাল জেনারেল পেট্রোভ ভলটিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তার সঙ্গে এক বৈঠকে বলেন, `বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সরকার ও জনগণ খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা এ দেশের বর্তমান সংকটের একটি ন্যায়সঙ্গত ও শান্তিপূর্ণ সমাধান কামনা করি।` এ রকম উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আজ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে এক সংবাদ সম্মেলনে মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী বলেন, `শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ ভিন্ন অন্য কোনো উপায়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জানা উচিত যে, তিনি জনগণের প্রতিনিধি নন। সুতরাং জনগণের ওপর কর্তৃত্ব করার কোনো অধিকারও তার নেই। সৈন্যবাহিনীর আস্থার ওপর তার ক্ষমতায় থাকা-না থাকা নির্ভর করে।` সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, `শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণের সঙ্গে সঙ্গেই সামরিক শাসন সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ আগুন ও পানি একত্রে অবস্থান করে না। তবে ইয়াহিয়া খান যদি মুজিবের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন তবে সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবকে আহ্বান জানাই।` অন্যদিকে বাংলাদেশে চলমান সর্বব্যাপী অসহযোগের বিপরীতে জনাব ভুট্টোও তার শক্তিমত্তা প্রমাণে মরিয়া হয়ে ওঠেন। আজ এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, `আমি এখন পরিস্কার বুঝতে পেরেছি, আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনের আমাদের আর কোনো সুযোগ নেই। কেন্দ্রে ক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের হিস্যা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হলে আমিও চুপ করে থাকব না। আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখেছেন; এবার পশ্চিম পাকিস্তানের লোকদের শক্তি দেখবেন।` ভুট্টোর এই উস্কানিমূলক বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ঘটনার ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য দলের নেতা ভুট্টোকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিক খলনায়কের ক্ষমতালিপ্সা বলে উল্লেখ করেন। আবার এ ধরনের একটি বক্তব্যের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত ছোট দলগুলো এবং স্বতন্ত্র সদস্যদের প্রায় ৫৫ জন একত্র হয়ে বঙ্গবন্ধুর চার দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থনদান ও ভুট্টোবিরোধী এক যুক্তফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে কনভেনশন আহ্বান করেন। এ কনভেনশনে উপস্থিত হতে ৪৫ জন এমএনএ ইতিমধ্যে সম্মতি দান করেন। এদিকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান দলের নেতারা যেমন মিয়া মমতাজ দৌলতানা, ওয়ালী খান, মুফতি মাহমুদ, শওকত হায়াৎ খান বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়ার আলোচনা যখন দেশের ভাগ্য নির্ধারণে কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন ভুট্টোর এহেন বক্তব্য শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথ পরিহারে শক্তি প্রয়োগের উস্কানি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আজ স্বাধিকারের দাবিতে সেনাবাহিনীর গুলিতে এ পর্যন্ত যারা শহীদ হয়েছেন, সেসব বীর শহীদ স্মরণে এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করে বাদ জুমা বায়তুল মোকাররমসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। আন্দোলনে যেসব মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান এবং ভাইহারা হয়েছেন কিংবা বিধবা হয়েছেন তাদের কল্যাণ কামনা করা হয়। এ ছাড়া বর্তমান স্বাধিকার আন্দোলনের সাফল্য ও আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। বস্তুত বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধিকারের আন্দোলন এত প্রচণ্ডতা, এত সর্বব্যাপী ব্যাপকতা লাভ করে সামগ্রিকভাবে স্বাধীনতার জন্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে এমন মাত্রায় জাগ্রত ও বেগবান করেছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এসএ/