আজ বিশ্ব পানি দিবস
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:০৭ এএম, ২৩ মার্চ ২০১৯ শনিবার
আজ বিশ্ব পানি দিবস। বলা হয়ে থাকে-পানির অপর নাম জীবন। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে পানি। পানি ছাড়া মানব জীবন কল্পনা করা যায় না। পৃথিবীতে এখন সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। এই ঝুঁকিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ। তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের সুপেয় পানির অভাব ও আগামির ভয়াবহতা বিবেচনা করে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইনডিপেনডেন্টের সাংবাদিক জোয়ান হারি জলবায়ু বিষয়ক এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, বাংলাদেশ: রক্তে যার জন্ম, লবণাক্ত পানিতে তার মৃত্যু`। এমন লেখার কারণ ব্যবহারোপযোগী পানি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে এ দেশটিতে। লবণাক্ততা, আর্সেনিক দূষণ আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানীয়জলের সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যমতে, দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র জলসংকট। রাজধানী ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে চলে গেছে। যে কারণে ভবিষ্যতে এখানকার পানিতে সমুদ্রের লবণজল চলে আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওয়াটার এইড জানাচ্ছে, সুপেয় পানি পাচ্ছেন না দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। উপকূলীয় অঞ্চলে এখনই ১০ কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ এলাকায়ই শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। কারণ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। জাতিসংঘ দিবসটির প্রাতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘পানির মৌলিক অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না`। তবে সাপ্তাহিক বন্ধের কারণে আজ বাংলদেশে দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হবে না। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আগামী ১১ এপ্রিল দিবসটি পালিত হবে। পানি দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন।
বিএডিসির `গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ` অনুযায়ী, চলতি শুস্ক মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ অগভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। দেশে বর্তমানে ১৭ লাখ শ্যালো টিউবওয়েল মাটির নিচ থেকে পানি তুলছে। এগুলো ২২ থেকে ২৪ ফুট মাটির নিচ থেকেও পানি তুলতে পারে। কিন্তু এখন অনেক এলাকায় মাটির ২৪ ফুট নিচেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সেসব স্থানের কৃষক আরও পাঁচ ফুট মাটি গর্ত করে শ্যালো টিউবওয়েল বসাচ্ছেন। তারপরও অনেক জায়গায় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি গভীর নলকূপেও অনেকস্থানে ঠিকমতো পানি মিলছে না। মহুরি সেচ প্রকল্প, জিকে প্রকল্প, বরেন্দ্র সেচ প্রকল্প এবং মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প পানির অভাবে বন্ধ হওয়ার পথে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের মূলত মধ্যভাগ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ৩১ জেলার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর এক ফুট নিচে চলে গেলে কৃষকদের বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হয়। এক ফুট বেশি দেবে গেলে বেশি হর্সপাওয়ারের পাম্প দরকার হয়। এতে জ্বালানি তেল বা বিদ্যুৎ বেশি দরকার হয়। ১৯৬৮ সালে যখন বাংলাদেশে ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়, তখন সর্বোচ্চ ৫০ ফুট নিচে বসানো হতো। এখন ১৫০ ফুট নিচে বসানো হলেও পানি মিলছে না।
গত ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশের পানি নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের তথ্য মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাবে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া, বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়া, নদী শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় সেচের পানির পাশাপাশি সুপেয় পানির পরিমাণও কমতে শুরু করেছে। আশঙ্কাজনকভাবে ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকা ওয়াসার তথ্য মতে, রাজধানীবাসীর ব্যবহূত পানির ৮৬ ভাগই ভূগর্ভস্থ পানি। মাত্র ১৪ ভাগ পানি উপরিভাগের।
কয়েক বছর আগে বিএডিসির এক গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়, রাজধানী ঢাকার পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের ১৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঢাকার ভূ-স্তরের উচ্চতা ৫০ ফুট। সেই হিসাবে ঢাকায় পানির স্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে গড়ে ২১২ ফুট নিচে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় মাটির নিচ থেকে অব্যাহতভাবে পানি তোলা হলে আগামীতে ঢাকার পানিতে সমুদ্রের লবণ পানি চলে আসবে। সংস্থাটি সরকারকে সতর্ক করে জানিয়েছে, এখনই ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় শিল্প ও সেচ কাজের জন্য মাটির নিচ থেকে পানি তোলা বন্ধ করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন,এভাবে পানির স্তর নিচে নামতে থাকলে এক সময় শুধু পানির অভাবেই ঢাকা ছাড়বে মানুষ।
সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও এশীয়-প্রশান্ত পানি ফোরাম `দ্য এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক` শীর্ষক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে পানি সংকট ভয়াবহ। এতে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৯ দেশের মধ্যে ৩৭ দেশেই পানি সংকট রয়েছে। এর মধ্যে পানি সংকট ভয়াবহ রূপ পেতে চলেছে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ায়।
গত মার্চে নোবেল জয়ী ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণের খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ ১৬ জেলার কোনোটাতেই পর্যাপ্ত সুপেয় পানি নেই। সবখানেই লবণজলের আগ্রাসন। ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে তাই এক কলস পানি কিনে আনতে হয় ১০ টাকা দিয়ে। খাবার পানি জোগাড় করতেই উপকূলের নারীদের দিন কেটে যায়। অনেক এলাকার নলকূপের পানিতে আবার রয়েছে আর্সেনিক!
ওয়াটার এইডের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় পাঁচ হাজার শিশু মারা যায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধার অভাবে।
জাতিসংঘের সদ্য প্রকাশিত বিশ্বপানি উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শতাব্দীর মধ্যভাগে পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৭২০ কোটি থেকে ৯৬০ কোটি হবে। তখন পৃথিবীতে পানির চাহিদা বাড়বে ৫৫ শতাংশ।
গত বছর `নেপোটিজম অ্যান্ড নেগলেক্ট : দ্য ফেইলিং রেসপন্স টু আর্সেনিক ইন দ্য ড্রিংকিং ওয়াটার অব বাংলাদেশ’স রুরাল পুওর` শীর্ষক প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ জানায়, খাওয়ার পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হওয়ার ২২ বছর পরও বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এখনও আর্সেনিকে অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সেচ বিষয়ক পরামর্শক ড. ইফতেখারুল আলম বলেন, ভয়াবহ পানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে। বাড়াতে হবে সেচ দক্ষতা। একই সঙ্গে পানির উৎস তৈরি করতে হবে। নদীনালা খনন ও বড় বড় জলাশয় তৈরি করতে হবে। শিল্প ও কৃষি খাতে পানির অপচয় রোধ করতে হবে। পানির অপচয় রোধে স্মার্ট কার্ড ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সরকার একশ` ইকোনমিক জোনের পরিকল্পনা নিয়েছে। এতেও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়বে। তাই শিল্প প্রতিষ্ঠানের পানি রিসাইক্লিং বাধ্যতামূলক করতে হবে।
আন্তর্জাতিক জলবায়ু ও পানি বিশেষজ্ঞ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, বাংলাদেশ এখনও পানির অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে না। দেশে এলাকা ও ঋতুভিত্তিক পানি সমস্যা রয়েছে। এ ছাড়াও বড় শহর, ছোট শহর এবং তৃণমূল ও দুর্গম এলাকার মানুষের পানি সমস্যার মধ্যে নানা ধরনের পার্থক্য রয়েছে। এক সময় ভাবা হতো-ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ালে নিরাপদ পানি পাওয়া যাবে। অথচ এতে ভূগর্ভস্থ পানি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। নানা সংকট তৈরি হচ্ছে। এখন সময় এসেছে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার- ভূগর্ভস্থ নাকি ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহার করা হবে।
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর খাইরুল ইসলাম বলেন, জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, উপকূল, পার্বত্য এলাকা, হাওরাঞ্চল, বরেন্দ্র এলাকা, চা বাগান ও দুর্গম এলাকার মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে। এসব এলাকায় নিরাপদ পানির ব্যাপক সংকট রয়েছে। এসডিজির সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৫৬ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছেন। এসডিজি অর্জনে নিরাপদ পানির বিষয়ে জোর দিতে হবে।
কেআই/