কার্যকারিতা হারাচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ১১:৫০ এএম, ২৩ মার্চ ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ১২:১৩ পিএম, ২৩ মার্চ ২০১৯ শনিবার
নাম মহসিন, গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া, বর্তমানে তিনি ঢাকাতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যলয় হাসপাতালে। বর্তমানে তিনি আইসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। খুব জটিল কোনো রোগ নয়, সাধারণ নিউমোনিয়া।
কিন্তু এই অসুখই তাকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর মুখে। কারণ জানতে চাইলে ডাক্তার বলেন,সংক্রমণ ঠেকাতে তার দেহে যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হচ্ছে, কাজে আসছে না তার কোনোটিই। ডাক্তার আরো জানান, ২০টি অ্যান্টিবায়োটিক কালচার করেছি। তাঁর মধ্যে ১৯টি অ্যান্টিবায়োটিক তাঁর রেসিস্টেন্স। তা থেকেও তাঁর শরীরে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ১৭ দিন আগে ঢাকা মেডিকেল ভর্তি হয় ঝিনাইদহ আতিক। অবস্থার অবনতি না হওয়ায় সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয়ে আইসিইউতে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে,একটি মাত্র অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে তার শরীরে, যেটি আবার কিডনির জন্য ক্ষতিকর। মহসিনের মতো তার শরীরেও একটি মাত্র অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে। সহসিন বা আতিক নয়
আইসিইউতে ভর্তি রোগীদের অধিকাংশই কোনো না কোনো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। বর্তমানে বাজারে প্রচলিত ২০-২৫ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। যা আইসিইউতে অধিকাংশ রোগীর শরীরে রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে। কিছু রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করলেও দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. এম এ হাবিব বলেন, বর্তমানে আইসিইউতে ভর্তির অধিকাংশ রোগীর শরীরের অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। কিছু রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করলেও তা তাঁর শরীরে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। শুধু আইসিইউ, সিসিইউর রোগীরাই নয়, শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষের শরীরেই এখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে জীবাণু।
বিষয়টি আরো পরিস্কার হতে বিএসএমএমইউর ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, বিভিন্ন সময় গবেষণা করে আমরা দেখেছি, যেকোনো আইসিইউতে প্রায়ই সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থাকে অন্তত ২৫ শতাংশ রোগীর। তখন অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দেয়া হয় বা শক্তিশালী কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হয়। এ রোগীগুলোর জন্য বিকল্প কিছুই থাকে না। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া।
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকার ও বংশবিস্তার করার ক্ষমতা অর্জনই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স। অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার, নিয়ম না মেনে ব্যবহারের কারণে জীবাণুরা অ্যান্টিবায়োটিক চিনে ফেলে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানান চিকিৎসকরা।
ডা. এ কে এম হাবিব উল্লাহ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। ফার্মেসির দোকানদার, পল্লী চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। কোন রোগের কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক কোন মেয়াদে দিতে হবে তা না জেনেই তারা অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে যে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন, রোগীরা পূর্ণমেয়াদে তা শেষ করছে না। ফলে তার শরীরে যে জীবাণু থাকছে তা ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছর পর এ অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ফার্মেসিতে ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হয়। অনেক চিকিৎসক সামান্য অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক দেন। বেশি দামের কারণে রোগীরা কিছুটা সুস্থ হলে অ্যান্টিবায়োটিকের মেয়াদ শেষ করে না। এর ফলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে। দেশে গড়ে প্রতিদিন সাত লাখ মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে।
অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় বাজারে এ ধরনের ওষুধ বিক্রির তথ্যেও। গত বছর দেশে দ্বিতীয় সর্বাধিক বিক্রীত ওষুধ ছিল সেফালোসপোরিন্স অ্যান্ড কম্বিনেশন বা অ্যান্টিবায়োটিক। এ শ্রেণীর ১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয় গত বছর। ওষুধটির বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর বলে সর্দি, কাশির মতো জীবাণুবাহিত সংক্রমণেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি হাসপাতালের পরিবেশ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে জানান চিকিৎসকরা।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সমস্যা সমাধানে চিকিৎসক ও রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে। চিকিৎসকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিকের ঝুঁকি সম্পর্কে বোঝানো। অযৌক্তিক কারণে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করবে না। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে কাজ করতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি না হয়।
এই বিষয়ে আইসিডিডিআর,বি`র জেষ্ঠ্য বিজ্ঞানী ড. মুনিরুল আলম বলেন, `অ্যান্টিবায়োটিকের পলিসি খুব স্ট্রং করতে হবে। তা না হলে আপনি যত পাওয়ারফুল হননা কেন, ইউ উইল নট বি স্পেয়ারড। প্রেসক্রিপশন ছাড়া যতদিন না ওষুধ বিক্রি বন্ধ হবে, ততদিন অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ঠেকানো যাবে না। অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচার ব্যবহারের লাগাম টেনে ধরতে হবে। না হলে মানুষ ফিরে যাবে অ্যান্টিবায়োটিক আবিস্কারের আগের সময়ে।
এবিষয় আশার বাণী শোনালেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক সানিয়া তাহমিনা। তিনি জানান, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যাতে না হয়, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু রোডম্যাপ যেমন—অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি, ইউজার্স গাইডলাইন, সব ইনস্টিটিউটের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন। সেটি নিয়েই আপাতত কাজ করা হচ্ছে। আমরা দেখার চেষ্টা করছি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কী অবস্থা। তার ভিত্তিতে আমরা পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ নেব। এছাড়া চিকিৎসকদের মাধ্যমে মানুষকে অহেতুক অ্যান্টিবায়োটিক না খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। যাতে অপ্রয়োজনে কেউ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করে।
টিআর/