ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

যেন ভুলে না যাই

গণহত্যা ফিরে আসুক বিশ্বজনের স্মৃতি ও স্বীকৃতিতে

মফিদুল হক

প্রকাশিত : ০৯:১০ এএম, ২৫ মার্চ ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৯:৫৫ এএম, ২৫ মার্চ ২০১৯ সোমবার

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি জাতিসত্তা ধ্বংস করে দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক অলীক জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী শুরু করেছিল গণহত্যাযজ্ঞ। দেশের নাগরিক সমাজের সদস্যরা হয়েছিল তাদের আক্রমণের লক্ষ্য, জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালি তথা বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী সব মানুষ পাকিস্তানি `ধর্মরাষ্ট্র` বা স্বঘোষিত ইসলামের শত্রু হিসেবে গণ্য হয়েছিল। ধর্মগোষ্ঠী হিসেবে হিন্দুরা হয়েছিল আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্য।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মন-মানসিকতা কলুষিত করে তাদের বাঙালিয়ানায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য, পাকিস্তানের সামরিক কর্তাদের বিবেচনায়, বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন দায়ী, তাই তাঁরা হয়েছিলেন নৃশংসতার শিকার, প্রায় পাইকারিভাবে। চরম নিষ্ঠুরতা নিয়ে পরিচালিত সামরিক আঘাতে বইয়ে দেওয়া হয়েছিল রক্তস্রোত, যা অব্যাহত ছিল একাত্তরের নয় মাসজুড়ে। এভাবে সূচিত গণহত্যার কৃষ্ণগহ্বরে বিলীন হয়েছিল ত্রিশ লাখ প্রাণ, তছনছ হয়ে গিয়েছিল কোটি মানুষের জীবন।

জেনোসাইডের আক্রমণের থাকে বিশেষ লক্ষ্য, ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে বলা হয়েছিল- কোনো জাতি, ধর্ম, বর্ণ বা নৃগোষ্ঠীকে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে পরিচালিত আক্রমণ জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হবে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী সূচিত আক্রমণের লক্ষ্য ও ধরন দেখে একে জেনোসাইড হিসেবে শনাক্ত করতে বিলম্ব ঘটেনি। ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল আর্চার কে ব্লাড ৩১ মার্চ ওয়াশিংটনে প্রেরিত বার্তার শিরোনাম দিয়েছিলেন, `সিলেকটিভ জেনোসাইড`। ভারতীয় পার্লামেন্টে একই দিন গৃহীত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে `জেনোসাইড` বন্ধের জোরালো আবেদন জানানো হয়। ১ এপ্রিল আগরতলায় সমবেত বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্টের কাছে `জেনোসাইড` বন্ধের আবেদন জানান। এর বিপরীতে একাত্তরের জেনোসাইড রোধে কোনো ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘ ও বিশ্বসংস্থা ছিল অকেজো, অপারগ ও পঙ্গু। কিন্তু বিশ্বসমাজ বড়ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশের জেনোসাইডের। বহুভাবে ধ্বনিত করেছিল প্রতিবাদ, উচ্চকণ্ঠে বলেছিল, স্টপ জেনোসাইড। এ ক্ষেত্রে বিশ্বগণমাধ্যম পালন করেছিল অসাধারণ ভূমিকা। জুন মাসে লন্ডনের সানডে টাইমসে দু`পৃষ্ঠাজুড়ে পত্রস্থ অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের রিপোর্টের শিরোনামে বিশাল টাইপে লেখা হয়েছিল `জেনোসাইড`, আর কিছু নয় কেবল ওই ভয়ঙ্কর শব্দ, কিন্তু সেই রিপোর্ট কাঁপিয়ে দিয়েছিল দেশে দেশে মানুষের অন্তর।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বিশ্বলোকের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে থাকে একাত্তরের গণহত্যা। দেশের ভেতরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার নিষ্ঠুরতার পর অস্বীকৃত ও বিকৃত হতে থাকে ইতিহাস। গণহত্যার বাস্তবতা সরকারিভাবে ঔদাসীন্য, অবহেলা ও তুচ্ছতা আক্রান্ত হতে থাকে। আন্তর্জাতিকভাবে বিস্মৃত ও জাতীয়ভাবে অস্বীকৃত হলেও গণহত্যার শিকার বাঙালি জনগোষ্ঠী লোকস্মৃতি থেকে গণহত্যার নিষ্ঠুরতা কখনও হারিয়ে যেতে দেয়নি, নানা উদ্যোগ-আয়োজনে স্মৃতির মশাল তারা প্রজ্বলিত রেখেছিল। এরই ফলে দেশ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তরুণ প্রজন্ম এক মশাল থেকে জ্বালিয়েছে অনেক মশাল, শামিল হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন অভিযাত্রায়।

বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তরুণ সমাজ বিপুলভাবে রায় দিয়েছে গণহত্যার বিচারের পক্ষে। সেই ধারাবাহিকতায় জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, গণহত্যার দোসরদের বিচার একে একে সম্পন্ন হয়ে চলেছে। এই বিচার জাতীয়ভাবে তো বটেই, আন্তর্জাতিকভাবেও একাত্তরের গণহত্যা আবার ফিরিয়ে এনেছে বিভিন্ন আলোচনা ও বিবেচনায়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ঘুরে দাঁড়িয়েছে নব্বইয়ের দশক থেকে। গণহত্যার বিচারে বিভিন্ন অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২০০২ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বর দিনটিকে ঘোষণা করেছে জেনোসাইড স্মরণ-দিবস হিসেবে। বাংলাদেশের সংসদও ২৫ মার্চ, জনচিত্তে যা কালরাত্রি হিসেবে পরিচিত, সেই দিনটিকে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জেনোসাইড স্মরণ-দিবসরূপে।

এই পটভূমিকায় আমাদের আরও নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান ও অধ্যয়ন করতে হবে একাত্তরের গণহত্যার নানা দিক। ইতিহাসের সত্যোপলব্ধি মেলে ধরতে হবে সবার কাছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে। বাংলাদেশে জেনোসাইড জাতীয়ভাবে আবার ফিরে এসেছে তার নিষ্ঠুর বাস্তবতা ও অপরিমেয় বেদনার স্মৃতি নিয়ে। এর বিচার-বিবেচনা থেকে ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে সর্বতোভাবে সক্রিয় হতে হবে বিশ্বলোকের স্মৃতিতে বাংলাদেশের জেনোসাইডের পুনঃপ্রতিষ্ঠায়, যেন মানবসমাজ ও বিশ্বগোষ্ঠী জেনোসাইডের ইতিহাসের এই মর্মান্তিক অধ্যায় আর কখনও বিস্মৃত না হয়, এর স্বীকৃতি থেকে নিতে পারে শিক্ষা, বলতে পারে `নো টু জেনোসাইড`, `নেভার এগেইন`।

 

টিআর/