ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

অগ্নিঝরা মার্চ

গণহত্যা ১৯৭১

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত : ১১:২৭ এএম, ২৫ মার্চ ২০১৯ সোমবার

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকেই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ মার্চ জাতির পিতা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বক্তৃতার মধ্য দিয়ে একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করেন। যে বক্তৃতা আজ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা; তাতে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন একাত্তরের দিনগুলোতে, আমরা অক্ষরে অক্ষরে সেসব নির্দেশ পালন করেছি।

এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাঙালি জাতিকে এক মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন। এই অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছি। বাংলার মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়ে `আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ` গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে।

মধ্য মার্চে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যখন বঙ্গবন্ধুর সংলাপ চলে, তখন প্রতিদিনই আমাদের চারজনকে, যারা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে মুজিব বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছি- মনি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমাকে প্রতি রাতেই ব্রিফ করতেন কী হয়েছে, কী ঘটছে এবং কী হতে চলেছে। তিনি কখনোই মনে করেননি, সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।

`৭০-এর ২১ মার্চ ছাত্রলীগের সভাপতির পদ থেকে বিদায় নিয়ে আমি ও রাজ্জাক ভাই ওই রাতেই হল ত্যাগ করে মাত্র ২০০ টাকায় গ্রিন রোডে `চন্দ্রশীলা` নামে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে শিল্পপতি শ্রদ্ধেয় জহুরুল ইসলামের কাছ থেকে আমরা একটা গাড়ি চেয়ে নিয়েছিলাম। এই গাড়ির পেছনে আমাদের ব্যাগ থাকত। কারণ, আমরা তৈরি থাকতাম- কোন সময় কী ঘটে! বঙ্গবন্ধু সব সময় বলেছেন- `প্রস্তুত থেকো।` যুদ্ধ শুরু হলে কলকাতা গেলে আমরা কোথায় থাকব? ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ বঙ্গবন্ধু আমাদের ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছেন। সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। ২৫ মার্চ বহু লোক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসেছেন। অনেকেই অনুরোধ করে বলেছেন, `বঙ্গবন্ধু, ৩২ নম্বরের বাসভবন ত্যাগ করেন।` বঙ্গবন্ধু বলেছেন, `ওরা যদি আমাকে না পায়, ঢাকা শহরকে ওরা তছনছ

করবে। লক্ষ লক্ষ লোককে ওরা হত্যা করবে। আমি তো জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমি এভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারি না। আমি আমার বাড়িতেই থাকব। কারণ, আমি আমার জীবন বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি।`

আমি ও মনি ভাই সবশেষে রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের দু`জনের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। কোথায় গেলে অর্থ ও সাহায্য পাব সেসব কথা বলে আমাদের কপালে চুমু দিয়ে সে রাতে বিদায় দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন যাচ্ছি, তখন রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। সেগুনবাগিচার একটি প্রেসে মনি ভাই লিফলেট ছাপতে দিয়েছিলেন। সেগুনবাগিচা গেলাম। জহুরুল ইসলাম সাহেবের গাড়িটা তার বাসায় পৌঁছে দিলাম। রাস্তায় গাড়ি চালানোর মতো অবস্থা নেই। আমরা হেঁটে মনি ভাইয়ের বাসায় গেলাম।

এর পর `অপারেশন সার্চলাইট`-এর মাধ্যমে শুরু হয় ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা নগরীর নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ট্যাঙ্ক ও ভারী অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামানের গোলা, মর্টারের শেল আর মেশিনগানের ভয়াল গর্জনে রাত ১২টার পর পুরো নগরীই জাহান্নামে পরিণত হয়। চারদিকে শুধু বিকট আওয়াজ। রাতে ওখানেই ছিলাম আমরা। ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ইয়াহিয়া খান বলেন, শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। `মুজিব ইজ এ ট্রেইটর।

দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিশড।` বক্তৃতায় তিনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, `আওয়ামী লীগকে আরও আগেই আমার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা উচিত ছিল। এদের নেতাদের আগেই আমার গ্রেফতার করা উচিত ছিল।` পরদিন ২৭ মার্চ আমরা ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আশ্রয় নিই। কেরানীগঞ্জে ২ রাত থাকার পর ২৯ মার্চ আমি, মনি ভাই, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান সাহেব এবং আমাদের বন্ধু `৭০-এ নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আবু হেনাসহ, যিনি অসহযোগ আন্দোলনের সময় যে পথে কলকাতা গিয়েছিলেন এবং এসেছিলেন, সেই পথে আমরা প্রথমে দোহার-নবাবগঞ্জ, পরে মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়া হয়ে বালুরঘাট দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে ৪ এপ্রিল সেই `সানি ভিলা`য় আশ্রয় গ্রহণ করি।

মার্চের ২৫ থেকে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত কালপর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনে ৯ মাসব্যাপী বর্বর গণহত্যা পরিচালনা করে। `অপারেশন সার্চলাইট`-এর নীলনকশায় ঢাকার ৪টি স্থান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং তৎকালীন ইপিআরের পিলখানা (বর্তমান বিজিবি)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দসহ ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্রলীগ নেতা চিশতী হেলালুর রহমান ও বর্তমান কেবিনেট সেক্রেটারির ভাই জাফর আহমদকে হত্যা করে। এ ছাড়াও জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। ঢাকার ৪টি স্থান ছাড়াও রাজশাহী, যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রাম ছিল `অপারেশন সার্চলাইট`-এর আওতাভুক্ত এলাকা। `৭১-এর গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। পৃথিবীতে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু এভাবে রক্ত দিয়ে একজন নেতার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি এক কাতারে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত হয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে ৯ মাসে মহান বিজয় অর্জন মানবজাতির ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা।

স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে দু`বছর আগে ১৫ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আলোচনা সভার কথা। সে অনুষ্ঠানে আমি ছিলাম প্রধান অতিথি। সেখানে শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন এই দিনটিকে কেন আমরা `গণহত্যা দিবস` হিসেবে পালন করি না- সে প্রশ্ন তুলে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। সেদিনের সভায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ দু`জন বিদেশি উপস্থিত ছিলেন। সেদিন তারা এই দিনটির যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তাতে আমি বিব্রত ও লজ্জিত এই ভেবে- কেন আমরা এ দিনটিকে এতদিন `গণহত্যা দিবস` হিসেবে পালন করিনি! আমি অকপটে স্বীকার করি, ২৫ মার্চ `গণহত্যা দিবস` রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালনের সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। পাকিস্তানের জুনায়েদ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি `ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস্‌ এক্সপ্লোডেড` শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। যে বইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দোষারোপ করা হয়েছে এই বলে যে, ২৫ মার্চের গণহত্যার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা দায়ী। তারাই নিরীহ-নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করেছে। সভাস্থলে জুনায়েদ আহমেদ লিখিত বইটির পাতা উল্টে যখন দেখছিলাম তখন বিস্মিত হয়েছি এই ভেবে, কীভাবে মিথ্যাচার করা হয়েছে! `৭১-এর গণহত্যাকে ভিন্ন খাতে চালিত করার জন্য দেশ-বিদেশের অনেকেই অপকর্ম করে থাকে। দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, এ জন্য আমাদের দেশের কতিপয় রাজনৈতিক নেতা দায়ী।

বিশেষ করে বিএনপি নেতৃবৃন্দ। যেদিন বিএনপি নেত্রী প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছিলেন, ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে তার প্রশ্ন আছে, সেদিন থেকে অনেকেই শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর লেখা প্রকাশের সাহস পেয়েছে। জুনায়েদ আহমেদ লিখিত বইটিতে যে কীভাবে মিথ্যাচার করা হয়েছে, দেখলে অবাক হতে হয়! বিশ্বখ্যাত পত্রপত্রিকায় `৭১-এর গণহত্যার যেসব ছবি মুদ্রিত হয়েছিল, সেসব ছবি বইটিতে সংকলিত হয়েছে এবং প্রতিটি ছবির নিচে লেখা হয়েছে- এসব হত্যাকাণ্ড মুক্তিযোদ্ধাদের সৃষ্ট।

বইটিতে ইতিহাসের এসব মিথ্যাচার দেখে আমার মন বিক্ষুুব্ধ হয়ে ওঠে এবং জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পয়েন্ট অব অর্ডারে বিষয়টি উত্থাপন করি এবং উল্লিখিত বই থেকে উদ্ধৃত করে বক্তৃতায় বলি, ২৫ মার্চ `গণহত্যা দিবস` হিসেবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালন করা হোক। সেদিন সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রস্তাবটিকে সমর্থন করেন এবং একটি দিন নির্ধারণ করে আলোচনার প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। মাননীয় স্পিকার ১১ মার্চ শনিবার আলোচনার দিন নির্ধারণ করেন। নির্ধারিত দিনে ২৫ মার্চ `গণহত্যা দিবস` প্রস্তাবের ওপর ৫৬ জন এমপি দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতার পূর্বে পিনপতন নীরবতার মধ্যে গণহত্যার ১৮ মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়।

নৃশংসভাবে খুন হয়ে যাওয়া নারী-পুরুষ-শিশুর লাশ দেখে জাতীয় সংসদে এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তানসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপপ্রচারের কঠোর সমালোচনা করে দীর্ঘ ২৫ মিনিট আবেগাপ্লুত বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, `যত অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আরও উন্নত হচ্ছে। কোনো অপশক্তির কাছে আমরা মাথা নত করব না।` অতঃপর সর্বসম্মতিক্রমে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ `গণহত্যা দিবস` পালনের সিদ্ধান্ত মহান জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়।

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বা তার দোসররা স্বাধীন বাংলাদেশে `৭১-এর গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা দীর্ঘকাল ধরে বিতর্কিত ও বিকৃত করে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে বিএনপি নামক দলটি যে রাজনৈতিক পাপ করেছে, তাতে দলটির অস্তিত্ব আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ জেল-জুলুম-হুলিয়ার মুখেও অবিচল থেকে ইতিহাসের সত্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে রেখেছে বলেই আজ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে গণহত্যায় লিপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারিক প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চ `গণহত্যা দিবস` হিসেবে পালিত হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতা, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

টিআর/