ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

পরিবারের সালাম চর্চা বাড়ায় শান্তি, সুখ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৬:০৭ পিএম, ২৬ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৬:২৫ পিএম, ২৬ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার

আসসালামু আলাইকুম। বাংলায় বললে- আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইংরেজিতে বললে- Peace be upon you! সংস্কৃত ভাষায় বললে আদাব বা নমস্কার। যার অর্থ হলো "প্রণাম করা" বা "সম্মান করা"। যে ভাবেই ভাষায় কথা বলুক না কেন এই বাক্যগুলোর মাধ্যমে আমরা শান্তি চাই। শান্তি চাই। এমন অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে শান্তি কোথায় আছে? শান্তি কীভাবে আসে? কী করলে মেলে শান্তি। প্রতিটি মানুষ শান্তি খুঁজে ফিরছে। কেউ পেয়েছেন, কেউ পেতেও পেতেও হারিয়ে ফেলেছেন শান্তির পথকে।

আমরাও খুঁজতে শুরু করলাম শান্তিকে। খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে এসে অনুভব করলাম, শান্তির আবাস আমাদেরই অন্তর। মন প্রশান্ত হলে সব শান্ত। আর মনে যদি আগুন ধরে তো বাইরে আগুন ধরতে সময় লাগে না। মনকে শান্ত করার জন্যে দরকার ভালো ভালো কথা। আর সব কথার সেরা কথা হলো-আসসালামু আলাইকুম বা আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক-এই কথাটি।

এই কথাটি শুধু শান্তিকামনা করে না, এ কথার মধ্য দিয়ে সুখ সৃষ্টি হয়, পরস্পরের প্রতি সমমর্মিতা বাড়ে। আর শান্তি, সুখ, সমমর্মিতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি পরিবারে। কারণ দিনশেষে আমরা সবাই ফিরি ঘরে, পরিবারের মানুষদের কাছে। পরিবার আছে, আমার মা-বাবা, ভাই-বোন,স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে আছেন-এই যে সবাই পাশে আছেন এই অনুভূতি যার পাশে কেউ নেই তার অনুভূতির সাথে কখনোই মিলবে না।

একবার একজন বলছিলেন তার পরিজনহীন সময়ের কথা। কোনো এক রমজানে তিনি সেহেরি খেতে বসেছেন, তার রুমমেটের মা ফোন করে ছেলেকে বলছেন যে বাবা, ভালো করে খেয়ে নে। কিন্তু তাকে খেতে বলার কেউ ছিল না। মা ছোটবেলায় চলে গেছেন। বাবারও মৃত্যু হয়েছে বছরখানেক আগে। ভাইবোন কেউ নেই। তিনি মাসের পর মাস অপেক্ষা করতেন বন্ধুরা বা আত্মীয়দের কারো ফোনের জন্যে। কিন্তু কেউ ফোন দিতো না। তিনি এই কথাগুলো কান্নাভেজা কণ্ঠে বলছিলেন

আসলে পরিবার খুব শক্ত একটি খুঁটি প্রতিটি মানুষের জীবনে। উচ্চশিক্ষা, ক্যারিয়ার, নিত্যনতুন যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার-এ সবই আমাদের জীবনে কাজের জন্যে প্রয়োজন। কিন্তু শান্তির জন্যে প্রয়োজন পরিবার। প্রয়োজন পারিবারিক সম্পর্ক। আবহমান কাল ধরে প্রাচ্যের, বিশেষত আমাদের একটি বড় গর্বের বিষয় হলো পরিবার। স্থুল ভোগবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনে পড়ে পাশ্চাত্যের পরিবারগুলো বহুকাল ধরেই বিপর্যস্ত। যার ফলাফল ওদের আজকের ক্রমবর্ধমান সামাজিক জটিলতা, হিংস্র অপরাধপ্রবণ মনোবৃত্তি আর স্নায়বিক-মানসিক অসুস্থতা। যে কারণে পাশ্চাত্যের পরিবারগুলো আজ সত্যিকার অর্থেই ভাঙনের মুখে।

সে বিবেচনায় আমরা এখনো ভাগ্যবান। যদিও অবিদ্যাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি, ভায়োলেন্সপূর্ণ টিভি সিরিয়াল, অসুস্থ বিনোদন, ভার্চুয়াল ভাইরাস আর আর্থ-সামাজিক নানা কারণে আমাদের পরিবারগুলো একটি সংকটকাল অতিক্রম করছে। বাড়ছে স্বামী-স্ত্রী আর অভিভাবক-সন্তানদের মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি আর অকারণ দূরত্ব। এ থেকে মুক্তির জন্যে কিছু একটা তো করতে হবে আমাদের সচেতন কাউকে না কাউকে। পরিবার বাঁচলে সমাজ বাঁচবে, সমাজ বাঁচলে দেশ বাঁচবে। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশকে বাঁচানোর জন্যে আগে আমাদের পরিবারকে বাঁচাতে হবে। আর পরিবারের বন্ধনকে অটুট করতে পারে একমাত্র শান্তি, সুখ আর পারস্পরিক সমমর্মিতা। এজন্যেই নিজে পরিবারের সদসদের আগে সালাম দেয়া। হাসিমুখে দেয়া। এবং সালাম পেলে হাসিমুখে তার উত্তর দেয়া। এতে পারিবারিক বন্দন, আন্তরিকতা বাড়বে।

পরিবারে সালাম চর্চা বাড়ায় শান্তি,সুখ ও সমমর্মিতা। দেখুন, কী চর্চা করলে কী বাড়বে এর উত্তর আছে এ বাক্যটিতে। যে সালাম মানে শান্তি কামনার চর্চা করুন, তাহলে শান্তি বাড়বে। ল’স অফ ন্যাচারাল রিটার্ন বা প্রকৃতির প্রতিদান বলে আমরা যা বুঝি, তার মূল কথাও এটি। আমরা যা দেবো, তা-ই অন্ততপক্ষে আমাদের কাছে ফিরে আসবে, তারচেয়ে বেশিগুণেও আসতে পারে। কিন্তু শর্ত হচ্ছে একটিই যে, আমাদেরকে আগে দিতে হবে এবং যা চাই তা-ই আগে দিতে হবে। শান্তি যেহেতু সবাই চাই, তাই শান্তির কথা নিজের মুখ থেকে বারে বারে বলতে হবে, অন্যের শান্তি কামনা করতে হবে। তাহলেই আমার নিজের কাছে ছুটে আসবে শান্তি! এজন্যেই সবাইকে আগে সালাম দিতে হবে।

এখন কথা হচ্ছে যে, সালাম কে কাকে আগে দেবো? যিনি আগে দেবেন, তিনি এগিয়ে থাকবেন পুণ্যের দিক থেকে। সেই তিনি বয়সে যত বড় বা ছোট হোন না কেন। দাদাভাই, নানাভাই থেকে শুরু করে নাতি-নাতনীর বয়সী যে কেউ যে কাউকে আগে সালাম দিতে পারেন। নবীজী (স) ছোটদেরকে আগে সালাম দিতেন। এজন্যে সবচেয়ে ভালো হয় পরিবারের যে পর্যায়ের সদস্য হই না কেন, বাবা-মা-ভাই-বোন থেকে শুরু করে দাদা-দাদি, নানা-নানী, চাচা-চাচী, মামা-মামী, খালা-খালু, ফুপা-ফুপু যে হই না কেন, আমি আগে সালাম দেবো-এই দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে। আসলে কাউকে না কাউকে তো শুরু করতে হবে। একটি মোমবাতি থেকে যেমন আরো হাজারটি মোমবাতি জ্বলতে পারে। তেমনি, একটি শান্তির বাণী থেকে আরো অনেক অনেক শান্তির বাণী ছড়িয়ে পড়বে চারপাশে। আর তা না হলে কী হবে তা বুঝতে একটি গল্প বলি। যদিও গল্পটি ছোটদের, তারপরও এর শিক্ষাটি ছোট-বড় সবার জন্যে।


এক জঙ্গলে ছিল অনেক টিয়া। তারা খোঁজ করছিল বাসা বানানো যায় এমন একটা উঁচু গাছের। ঘুরতে ঘুরতে তারা পেয়েও গেল। বাসা বানালো একটা উঁচু ডালে। বড় গাছ। অনেকগুলো ডালপালা। টিয়েরা মহা আনন্দে বাসা বানালো। ছোট ছোট ছানা নিয়ে দারুণ সুখে বাস করতে লাগল। কিন্তু একদিন টিয়েদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ যে সে সবাইকে ডাকল। বলল, দেখো তোমরা সুখে দিন কাটাচ্ছো এটা ঠিক। কিন্তু এই সুখ কতদিন থাকবে তা নিয়ে আমি চিন্তিত। কেন কেন? বাকি টিয়েরা জানতে চাইল। প্রবীণ টিয়া বলল, নিচে দেখো। একটা আগাছা। এটি বড় হচ্ছে। এখনই যদি একে না তোলো তো পরে পস্তাতে হবে। কেন কেন? বাকি টিয়েরা আবার জানতে চাইল। প্রবীণ টিয়া বলল, সেটা সময় হলেই জানতে পারবে। আমি তোমাদের বলব না। শুধু বলছি তুলে ফেলো সময় থাকতেই। তা না হলে দুঃখ আছে।


বাকি টিয়েরা এই কথাকে গুরুত্ব দিলো না তেমন। আচ্ছা তুলব, এ আর এমন কী, হবে হবে পরে পরে-এ ধরনের চিন্তা করে আবার তারা তাদের মতো দিন কাটাতে লাগল। এদিকে দিন যায়, সেই আগাছাও বাড়তে থাকে, শক্ত হতে থাকে। একসময় আগাছা শক্ত দড়ির মতো বেড়ে উঠে ঠেকল গাছের উঁচু ডালগুলোর খুব কাছে। একদিন এক শিকারি এলো গাছটির নিচে। উপরে টিয়ের ছানাদের দেখতে পেয়ে তার হলো লোভ। কীভাবে ছানাদের ধরবে ভাবতে ভাবতে সে দেখল সেই আগাছা যা এখন শক্ত দড়ির মতো হয়েছে। খুশিমনে দড়ি বেয়ে উঠে সে সব ছানাকে ভরে ফেলল ব্যাগে। আর আদরের ছানাগুলোকে হারিয়ে টিয়েদের মাঝে শুরু হলো কান্নার রোল। তাদের সব শান্তি সেদিন থেকে চলে গেল। আর প্রবীণ টিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখল।

গল্পটি বিয়োগাত্মক। তবে গল্পের শিক্ষাটি মনে রাখতে পারলে জীবনে সংযোগায়ন হতে পারে অনেক কিছু। সেটি হলো-শুরু করা। কাউকে না কাউকে। আর আসলে তাকেই শুরু করতে হয় যিনি সে কাজের গুরুত্ব বোঝেন। গল্পের প্রবীণ টিয়া যদি নিজে আগাছা সরানোর কাজটি শুরু করে দিতেন, তাহলে বাকিরাও তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসত। এতে নিশ্চয়ই কাজটি হয়ে যেত। কিন্তু তিনি নিজে অংশগ্রহণ করেন নি বলে কাজটিও গুরুত্ব পায় নি।

এজন্যেই আমরা নিজেরা আগে সালাম দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করতে চাই। যার সাথেই দেখা হোক, ছোট-বড় নির্বিশেষে আমরা আগে সালাম দিতে সচেষ্ট থাকব। শুদ্ধভাবে হাসিমুখে বলব-আসসালামু আলাইকুম।
সালামের উত্তরও দেবো স্পষ্ট করে। বলব-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কারণ ভালো কথা বললেও শান্তি, শুনলেও শান্তি। আর তার উল্টোটা যদি হয় তাহলে কেমন হয় এ নিয়ে একটি গল্প বলি।

জীবনে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি সার্থকতা হচ্ছে নিজের কথা বলতে পারা এবং অপরপক্ষকে তা বোঝাতে পারা। তাই কেউ সালাম দিলে তার উত্তর মাথা দুলিয়ে বা চোখের পাপড়ি নামিয়ে দেবো না। বা হু জাতীয় কোনো শব্দ করব না। কিংবা একটু হেসে তাকাবো না। হাসিমুখ অবশ্যই যেন থাকে, সেইসাথে বলব-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কারণ, তিনি আমার শান্তিকামনা করলে আমার দায়িত্ব হয়ে যায় তারও শান্তিকামনা করা।

আমরা আলোচনার শুরুতে বলছিলাম যে, পারিবারিক ভুল বোঝাবুঝি আর অকারণ দূরত্ব ঘোচানোর জন্যে দরকার সমমর্মিতাপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ। আর এ পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে, বহমান ও অটুট থাকতে পারে প্রতিদিন পারস্পরিক কল্যাণকামনার মধ্য দিয়ে। পরিবারে সালাম আদান-প্রদানের চর্চার অভ্যাসের মধ্য দিয়েই হতে পারে সবচেয়ে বড় কল্যাণকামনা।

আসলে জীবনের কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে শক্তি প্রয়োগের বদলে কৌশল, বুদ্ধি প্রয়োগ করাটাই উত্তম। সব কাপড় কিন্তু মাটিতে সজোরে আছাড় দিয়ে ধোয়া যায় না। কিছু কিছু কাপড় আস্তে আস্তে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হয়। পরিবারের পরিজনরাও এরকম। আস্তে আস্তে সুসম্পর্ক করতে হয়। এই সুসম্পর্ক গড়ে তোলার একটি শক্ত ভিত্তি হতে পারে সালাম বিনিময়। পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। সামাজিক পরিমণ্ডলে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে কারো সাথে দেখা হলে আমরা সালাম দেই সাধারণত। সাধারণভাবে কুশল বিনিময় শুরুই হয় সালাম বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পারস্পরিক সুখ-শান্তি-সাফল্য কামনার এ শুভচর্চা আমাদের পরিবারগুলোতে কতটা হয়? অথচ একটি সুখী মমতাময় পারিবারিক আবহ সৃষ্টির জন্যে একটি অনবদ্য উপায় হতে পারে এই কল্যাণ কামনা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সালাম বিনিময় হতে পারে একটি সুন্দর পারিবারিক সংস্কৃতি।

পরিবারের ছোট-বড় সবার সাথেই আমরা সালাম বিনিময় করতে পারি। ঘুম থেকে উঠে, ঘর থেকে বের হওয়ার আগে, ঘরে ফিরে আমরা চেষ্টা করব নিজে আগে সালাম দিতে। পরিবারের বড়দের দেখাদেখি ছোটরাও একসময় সালাম দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। দেখা যাবে, তারা আমাদের আগে সালাম দিয়ে ফেলছে। শিশুদের মধ্যে, ভাইবোনদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিযোগিতাও করা যায় যে, কে কার আগে সালাম দিতে পারি আজকে দেখব। আমরা যারা এ চর্চা করে আসছি তাদেরকে অভিনন্দন। এর সুফল আমরা দেখছি। কারণ সব ভালো কথারই শুভ প্রভাব আছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রতিদিন হাসিমুখে এই কল্যাণকামনা যদি চলতে থাকে তাহলে আমাদের পরিবারগুলোতে আসবে ইতিবাচক পরিবর্তন। পরিবারই হবে আমাদের সুখের নীড়, শান্তির উৎস।