ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

রক্তদান: অনন্য দান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:৫৮ পিএম, ২৬ মার্চ ২০১৯ মঙ্গলবার

এক সম্রাটের কথা বলি। তার সিংহাসনের প্রতি মোহ এতটাই যে, আপন বড় ভাইকে হত্যা করতেও হাত কাঁপে নি। সিংহাসনে বসে করলেন আরো বহু নির্মম হত্যাযজ্ঞ। সবটাই ক্ষমতার লোভ, নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা আর জোর করে অনুগত দাস বানানোর জন্যে। তার নাম ছিল অশোক। কিন্তু তার এই নিষ্ঠুর হৃদয়হীনতার জন্যে লোকে তাকে বলত চণ্ডাশোক। এই চণ্ডাশোক অশোক-ই একসময় রূপান্তরিত হলেন ধর্মাশোক অশোকে। কীভাবে? সে এক করুণ ঘটনা!

কলিঙ্গের যুদ্ধে অশোকের সৈন্যরা সে দেশের রাজাকে সহ অসংখ্য সৈন্যকে হত্যা করল। আহত ও নিহতে রক্তাক্ত হলো যুদ্ধক্ষেত্র। সম্রাট অশোক হাতির পিঠে চেপে যেতে যেতে দেখলেন দুপাশে কত অসংখ্য মৃতদেহ। কেউ একটু পানির জন্যে ছটফট করছে, কেউ আর্তনাদ করছে, আকাশে শকুনের দল ভিড় করেছে মাংসের জন্যে। যুদ্ধক্ষেত্রের এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখে সম্রাটের মন বিষণ্ণ হয়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন, কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে তার মনটা। ধীরে ধরে নিজের তাবুতে যখন ফিরছেন, দেখলেন এক তরুণ সন্ন্যাসী। কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞেস করায় সন্ন্যাসী বললেন, আমি যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি। আহত সৈনিকদের সেবা করতে। মুহূর্তে অনুতাপের আগুনে দাউ দাউ করে উঠল তার হৃদয়। তার কারণেই এত হত্যা, এত কান্না। আর সে কান্না থামাতে যাচ্ছেন একজন সন্ন্যাসী! তিনি নির্দেশ দিলেন, আর যুদ্ধ নয়। এবার প্রেম দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করতে হবে। প্রজাদের সুখ ও কল্যাণে, তাদের আত্মিক উন্নতির জন্যে তিনি বিলিয়ে দিলেন তার বাকি জীবন। আজকে তার ভালো কাজের জন্যেই ইতিহাস শত মনীষীর তালিকায় তার নাম লিখিয়েছে।  আসলে অন্যের কল্যাণে কাজ করলে মানুষ শ্রদ্ধার সাথে অনন্তকাল বেঁচে থাকেন।

পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদা-র ৩২ নম্বর আয়াতটি  আছে, একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা সমগ্র জাতির জীবন রক্ষা করার মতো মহান কাজ’। ঋগ্‌বেদে বলা হয়েছে ‘নিঃশর্ত দানের জন্যে রয়েছে চমৎকার পুরস্কার। তারা লাভ করে আশীর্বাদধন্য দীর্ঘজীবন ও অমরত্ব’। আর সেটা যদি হয় রক্ত দিয়ে যাব তুলনাই হয় না। অর্থ্যৎ রক্তের কোন বিকল্প নেই।

রক্তদানে রক্তদাতার কল্যাণ তো অবশ্যই হয়। সেইসাথে রক্তগ্রহীতা যিনি তার উপকার তো হয় সরাসরি। এককথায় যদি বলি, তাহলে একটি ব্যগের মধ্যে ৪০০ মিলিলিটার রক্ত দানের মাধ্যমে একটি থেকে অন্তত চারটি জীবন বাঁচে। চারটি জীবন কীভাবে? কোয়ান্টাম ল্যাবে এক ব্যাগ রক্ত থেকে উপাদানগুলো সরাসরি আলাদা করার টেকনোলজি রয়েছে। ফলে কোনো সম্মানিত ডোনার যখন হোল ব্লাড দিচ্ছেন ল্যাবের টেকনিকেল টিমের কর্মীরা তা প্লাটিলেট, আরসিসি, ক্রায়োপ্রিসিপিটেট, ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, কখনোবা ফ্রেশ প্লাজমা-এই রক্ত উপাদানগুলো আলাদা করেন। ফলে যে রোগীর যা প্রয়োজন তা ল্যাব থেকে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। এখানে একজন রক্ত গ্রহীতার একটি চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরছি।   

আমি থ্যালাসেমিয়া রোগী। আমার বয়স ১৫ বছর। আমি এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমরা দুই ভাইবোন এই রোগে আক্রান্ত। আমার ভাই কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিএসসি করছে।

আমার যখন একবছর বয়স তখন এ রোগ ধরা পড়ে। প্রথমে আমরা কুষ্টিয়াতে ছিলাম। কুষ্টিয়াতে নিরাপদ রক্ত পাওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ল। আমাদের দুই ভাইবোনের রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে আমার বাবা প্রায় বেকার হয়ে পড়লেন। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের আপন মানুষেরা রক্তের বন্ধন ছিন্ন করেছিল শুধু এই রোগটির কারণে। অবশেষে নিরুপায় হয়ে চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় আসি। কোয়ান্টাম ল্যাবের ঠিকানা জানতে পারি। ২০০১ সাল থেকে কোয়ান্টাম ল্যাবের মাধ্যমে নিরাপদ রক্ত নিতে পারছি। এবং এখান থেকে আমি সম্পূর্ণ ফ্রি-তে রক্ত নিতে পারছি।

প্রতি মাসে রক্ত নেয়াটা আমার জন্যে খুবই কষ্টকর। মাঝে মাঝে মনে হয়, কোন অপরাধে স্রষ্টা আমাকে এমন শাস্তি দিচ্ছেন। আমার স্বপ্ন আমি বড় ডাক্তার হবো। আমার মতো যারা অসহায় তাদের পাশে দাঁড়াব। কিন্তু এই রোগ আমার স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা। আর এটা অনেক ব্যয়বহুলও। তবুও বলব, কোয়ান্টাম ল্যাব আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। আমাদের পাশে যখন কেউ ছিল না, তখন রক্ত নিয়ে কোয়ান্টাম ল্যাবই আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

সম্মানিত ডোনারদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনাদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। আপনারা রক্ত দিয়েছেন বলেই আজ আমার মতো হাজার হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী এই পৃথিবীর আলো বাতাসে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারছে।

আমার আত্মীয়রা কখনো একব্যাগ রক্ত দিয়ে সাহায্য করে নি, সেখানে আপনাদের দানে আজ আমি বেঁচে আছি। রক্ত ছাড়া আমরা বাঁচব না, এই কথাটা যেমন সত্য, তেমন সত্য হলো আপনাদের এই ঋণশোধ করার সামর্থ্য স্রষ্টা আমাদের দেন নি। তবে পরম করুণাময়ের নিকট আপনাদের জন্যে অন্তর থেকে দোয়া করি। তিনি আপনাদের উত্তম প্রতিদান দিন।

গত বছর রক্তদাতা সম্মাননা অনুষ্ঠানে এসে মেয়েটি সম্মানিত ডোনারদের উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো পড়ে শোনান। সেইসাথে আবৃত্তি করেন স্বরচিত একটি কবিতা। মেয়েটি বয়সে ছোট হলেও লেখার গাঁথুনি বেশ সুন্দর।

আসলে এটি শুধু কবিতা নয়, রক্তদাতাদের প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে তাদের জন্যে একটি সুন্দর প্রার্থনা। রক্তদাতাদের জন্যে এভাবে প্রার্থনা করা ছাড়া আসলে এই শিশুবয়সী থ্যালাসেমিক রোগীদের আর কিছুই করার নেই। আপনাদের শুনলে ভালো লাগবে যে, কোয়ান্টাম ল্যাব প্রায় ৪০০টি ডোনার কার্ড করে দেয়া হয়েছে এরকম থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুসহ হিমোফিলিয়া, ডায়ালাইসিস এবং এমন রোগীদের জন্যে যাদের নিয়মিত রক্ত লাগে। এরফলে কোয়ান্টাম ল্যাবে এসে কার্ড দেখালেই তাদের যে পরিমাণ রক্তের প্রয়োজন বিনামূল্যে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।

গত বছর ২০১৮ সাল শেষ হতে না হতেই এক লক্ষ ইউনিট ছাড়িয়ে আরো ৮,১১৪ ইউনিট রক্ত ও রক্ত উপাদান সরবরাহ করেছে কোয়ান্টাম ল্যাব।

রক্তদানের রয়েছে শারীরিক উপকারিতা :

►প্রতিবার রক্তদানের পর রক্তদাতার অস্থিমজ্জা (Bone marrow) নতুন রক্তকণিকা তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। ফলে রক্তদানের দুই সপ্তাহের মধ্যে সে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়।

►শরীরের রক্ত কণিকাগুলোর মধ্যে লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১২০ দিন। তাই চার মাস অর্থাৎ ১২০ দিন পর পর রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি নেই।

►রক্তদাতার রক্তে HIV, Hepatitis-B, Hepatitis-C, Syphilis & Malarial Parasite এর উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। রক্তদাতা রক্তদানের ফলে এ টেস্টগুলো বিনামূল্যে করার সুযোগ পাচ্ছেন।

►রক্তদানের ফলে রক্তে Cholesterol-এর পরিমাণ কমে, ফলে হৃদরোগের সম্ভাবনা ৩৩ ভাগ কমে যায়।

►রক্তদানে শরীরের Free radicals-এর পরিমাণ কমে যায়। তাই বার্ধক্যজনিত জটিলতা দেরিতে আসে।

►স্বেচ্ছায় রক্তদানে মানসিক প্রশান্তি আসে। কারণ প্রতি দুই সেকেন্ডে বিশ্বে এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। আপনার দেয়া রক্তই একজন মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে পারে।

►সম্প্রতি ইংল্যান্ডের এক গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত রক্তদান ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।

 

আসলে যারা নিয়মিত রক্তদান করেন তারা তো এগিয়ে আছেনই। আর যারা প্রথমবারের মতো দিতে চাচ্ছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ যে, একবার শুরু করে ফেললেই হলো। তারপর দেখা যাবে যে, এই দান তার নিজের গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। গত ২ ডিসেম্বর ২০১৮ শত আজীবন রক্তদাতা সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট, রম্যসাহিত্যিক ও মাসিক উন্মাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আহসান হাবীব স্যার। তিনি নিজেও অনেকবার রক্ত দিয়েছেন। তার প্রথমবার রক্তদানের অভিজ্ঞতা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলছিলেন-(সম্মানিত বাণীবাহক, এ অংশটুকু দেখে দেখে পড়তে পারেন) ‘তখন কলেজে পড়তাম। জানতে পারলাম, পরিচিত একজনের অপারেশন হবে। সেজন্যে রক্তের প্রয়োজন। আমার এক বন্ধু রক্ত দিতে চাইল। আমিও তার সাথে পিজি হাসপাতালে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) গেলাম। আমার যাওয়ার মূল কারণ ছিল বন্ধুকে সাহস দেয়া, নিজে রক্ত দেবো এ চিন্তা করে যাই নি। তখন অবশ্য রক্ত দিতে হলে হাসপাতালে গিয়ে দিতে হতো। এখনকার মতো স্বেচ্ছা রক্তদানের কার্যক্রমগুলো সেসময় ছিল না। এদিকে আমার বন্ধু রক্ত দেয়ার জন্যে প্রস্তুত। তাকে যেই বিছানায় শোয়ানো হবে, এমনভাবে পড়ে গেল যে, মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত পড়তে শুরু করল। তখন তাকেই বুঝি রক্ত দিতে হয়! আমাদের এমন অবস্থা দেখে ডাক্তার বললেন, তোমার বন্ধুর বদলে তুমিই একব্যাগ রক্ত দাও। আমি যদিও ভয়ে ভয়ে রক্ত দিলাম। কিন্তু এরপর থেকেই আমার রক্ত দেয়া শুরু। এজন্যে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।’ অর্থাৎ প্রথমবার সাহস করে শুরু করে দিলেই পরেরবার কাজটার আনন্দ এত হয়ে যায় যে, সেটা করতেই ইচ্ছা করে।

রক্ত কোনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট না যে, অর্ডার করলেই তৈরি করে দেয়া যায়। এর প্রয়োজন কেবল রক্ত দ্বারাই পূরণ করা সম্ভব, অন্যথায় না। একবার জাপানের কিছু বিজ্ঞানী গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে রক্ত উৎপাদনের প্রয়াস নিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, এমন রক্ত তারা তৈরি করলেন যা মানবদেহের রক্তের মতো হয় নি। সে কারণে রক্তদান সবচেয়ে বেশি সম্মানের এবং মর্যাদার। তাই আসুন, অঙ্গীকার করি- “রক্ত দেই জীবন বাঁচাই”।