সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে চায় বেদে সম্প্রদায়
গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত : ১১:৩০ পিএম, ৩০ মার্চ ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ১১:৩৩ পিএম, ৩০ মার্চ ২০১৯ শনিবার
যাযাবর বেদে জীবন, নদীর কোল ঘেঁষে খোলা আকাশের নিচে পলিথিন আর ছেঁড়া কাপড়ের তাঁবু বানিয়ে যাযাবরের মতো জীবন কাটাতে অভ্যস্থ বেদে সম্প্রদায়রা। বেদে সম্প্রদায় বলে আমরাও সবাই মুসলমান, সাধারণ মানুষরা আমাদের খোটা দেয়। তাই এ পেশা ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়।
এ বিষয়ে মাওনা পেয়ার আলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল খায়ের ও আব্দুল আউয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম বলেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে তাদের বাচ্চাদের লেখাপড়া শিক্ষিত করতে হলে, তাদের এ পেশা অবশ্যই ছাড়তে হবে। মানবিক দিক বিবেচনায় রেখে বেদে সম্প্রদায়ের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।
এই সম্প্রদায়ের লোকেরা জীবিকার তাগিদে বছরের অর্ধেক সময়ই নৌকা নিয়ে ছুটে বেড়ায় দেশের নানা প্রাণন্তে। সাপ খেলা ও তাবিজ বিক্রিই তাদের আয়ের উৎস। এ আয় দিয়ে সংসার চালাতে হয় তাদের।
৩০ মার্চ শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,কাওরাইদ কালীবাড়ি এলাকায় সুতিয়া নদীর পার ঘেঁষে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের পলিথিন ও ছেড়া কাপর দিয়ে বানানো ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। প্রতিটি ঝুপড়ি ঘরে রয়েছে সোলার আর টিভির ব্যবস্থা। বাপ-দাদার পুরোনো পেশাটি তারা আঁকড়ে ধরে আছেন যুগ যুগ ধরে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে এ পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
বেদে সরদার আসকর আলী বলেন, আয়ের প্রধান উৎস গাছ গাছালির তাবিজ বিক্রি, সাপ ধরা ও সাপের খেলা দেখানো। ছয় মাসের জন্য আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। এই ছয় মাস প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে সর্দার হিসেবে আমাকে প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর এক দিনের আয় আনুমানিক ৭-৮ হাজার টাকা দিতে হয়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য আমরাও আর এ পেশায় থাকতে চাই না। শুধুমাত্র বাপ-দাদার ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করছি। আমাদের দলের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য ইচ্ছা হয়।
বেদে আল-আমিন বলেন, আমাদের এ পেশা থাকতে আর ভালো লাগে না। বেদে সম্প্রদায় বলে সাধারণ মানুষরা আমাদের খোটা দেয়। আমরা সবাই মুসলমান। তাই এ পেশা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাই।
বেদেরা এখন সড়ক পথে এসে পথ থেকে প্রান্তরে জনগুরুত্বপূর্ণ হাট-বাজারের সংলগ্নে ছোট-ছোট ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করে। সাপ খেলার পাশাপাশি বেদেনীরা তাবিজ-কবজ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গাঁয়ের মেঠো পথে। তবে দিন দিন এ বেদে স¤প্রদায়ের সাপ ধরার নেশা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নানা পণ্য এখন তাদের হাতে উঠেছে। বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামেই আজ তাদের ভিন্ন পথে চলা। তারপরও যারা এ পেশাকে আগলে রেখেছে তাদের জীবন চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
বেদেরা আরও বলেন,আগের মতো এখন আর নদী নেই, নদীতে পানি নেই, বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য এসে নদীর পানি নষ্ট ও দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এসব পানি দিয়েই আমরা গোসলসহ সকল প্রকার কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে। কারণ আমরা যাযাবর, সরকার আসে সরকার যায়, আমাদের মিলছে না কোনো ঠিকানা। আজ এখানে, কাল ওখানে, এভাবেই চলছে আমাদের জীবন। প্রতিটি বেদে বহর এক একটি রাজ্যের মতো কল্পনা করে এরা। সর্দার এদের রাজা। তার নিয়ন্ত্রণে চলতে হয় বহরের সবাইকে। বেদে বহরের মেয়েরাই আয়ের জন্য দল বেঁধে বের হয়। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ায়। পাড়া মহল্লা ঘুরে মানুষের নানা কথা শুনে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে। পুরুষরা সারাদিন বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। অভাব অনটনের কারণে পুরুষরাও ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে শুরু করেছে, কেউ দিচ্ছে বিভিন্ন রোগের ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ। শাড়ি, চুড়িসহ বিক্রি করছে নানা প্রসাধনী। কেউ কেউ ভানুমতি খেলা ও জাদুমন্ত্র নিয়ে হাজির হচ্ছে। নানা সমস্যা-সঙ্কট এদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। এরা কয়েক’শ বছরের পুরনো পেশা হলেও এদের নেই কোনো প্রকার নাগরিক অধিকার। নেহাত কচুরিপানা কিংবা নদীর জলে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতোই আজীবন নদীর পানিতে ভেসে বেড়ায়।
এ সম্প্রদায়ের নাম স্বাক্ষর করতে পারে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা খুবই কম। শিশুদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় এবং ভূমি সমস্যায় এ সম্প্রদায়ের মানুষের মানবতার জীবন যাপনে বাধ্য। এ সম্প্রদায়ের মানুষের মৃত্যু হলে আগেকার দিনে কলা গাছের ভেলায় লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হতো। আজকের দিনেও নদীর পাড়ে বা কোনো ভূ-স্বামীর পরিত্যক্ত ভিটের দানকৃত ভূমিতে ঠাঁই মিলে তাদের লাশের।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা আকতার বলেন, বর্তমান সরকার, পিছিয়ে পড়া এ জনগোষ্ঠির জন্য কাজ করছে। ঠিকানাবিহীন এই যাযাবর বেদে সম্প্রদায়রা নিজ ভূমে বাস করেও পরবাসী। সাপ নিয়ে খেলা, সাপ নিয়েই তাদের বসবাস। এক সময় নৌকা নিয়ে নৌপথে চলাচল করত। এখন নৌপথে বাধ, সুইসগেটের কারণে নৌকা নিয়ে চলাচল একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে তাদের।
কেআই/