ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

যা হয়েছে ভাল হয়নি যা হচ্ছে ভাল হচ্ছে না

আলী আদনান

প্রকাশিত : ১০:৪৪ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ১২:০৩ পিএম, ১৬ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার

(এক)

নুসরাত জাহান রাফি মারা গেছেন। নিজের সহপাঠীদের দেওয়া আগুনে পোড়া মেয়েটিকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হার মানতে হলো। এই মুহুর্তে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে তার একটি হলো ফেনী`র একটি মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত নিজ সহপাঠীদের হাতে অগ্নিদ্গ্ধ হওয়ার ঘটনা। যে ঘটনার জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন একই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা। পুলিশ ইতোমধ্যে সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে রিমাণ্ডে নিয়েছে। সারাদেশে অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে ঝড় উঠলেও ঐ মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থীকে অভিযুক্ত সিরাদ উদ দৌলা`র মুক্তির দাবিতে মিছিল করতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী ধারণা করা হচ্ছে এর পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারও কারও ইন্ধন থাকতে পারে।

অন্যদিকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে একটি মক্তবের সিঁড়ির নিচ থেকে মনির নামে এক শিশুর জবাই করা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ঘটনার দিন সকালে মনির আরবী পড়তে গেলেও আর বাসায় ফেরেনি। পরক্ষণে মনিরের মায়ের মোবাইলে ফোন করে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। মনিরের মা অনেক কষ্টে একলাখ বিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করে দিলেও নিজের বুকের ধনকে আর ফেরত পান নি। পরে পুলিশ ঐ মসজিদের ইমামকে গ্রেফতার করলে ইমাম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে।

উভয় ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠাণের সাথে সম্পৃক্ত। মানুষের আবেগ ও শ্রদ্ধার বড় জায়গা থেকে এমন ঘটনা ঘটানোয় স্বাভাবিক ভাবেই ধাক্কা খেয়েছে দেশবাসি। তারা একদিকে যেমন অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ফুঁসে উঠেছে তেমনি এটাও আশঙ্কা করছে, অতীতের বিভিন্ন ঘটনার ন্যায় এবারো প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে পার পেয়ে যাবে অন্যায়কারীরা। এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। সব সময় ঘটছে, ঘটে আসছে। কিন্তু নতুন ঘটনার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় পুরনো ঘটনা। এবারো তার পুণরাবৃত্তি হবে না তো?

(দুই)

তৌকির আহমেদ পরিচালিত চলচ্চিত্র `জয়যাত্রা`। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবিটির একটি অন্যতম চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত। যুদ্ধকালীন নানা ঘটনায় তিনি অন্যদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য গীতার সারাংশ আওড়ান।

বলেন, "যা হয়েছে তা ভালই হয়েছে, যা হচ্ছে তা ভালই হচ্ছে, যা হবে তাও ভালই হবে। তোমার কি হারিয়েছে- যে তুমি কাঁদছো? তুমি কি নিয়ে এসেছিলে- যা তুমি হারিয়েছো? তুমি কি সৃষ্টি করেছো- যা নষ্ট হয়ে গেছে? তুমি যা নিয়েছো, এখান থেকেই নিয়েছো। যা দিয়েছো, এখানেই দিয়েছো। তোমার আজ যা আছে, কাল তা অন্য কারো ছিল। পরশু সেটা অন্য কারো হয়ে যাবে। পরিবর্তনই সংসারের নিয়ম।"

কিন্তু ঘটনার একপর্যায়ে আবুল হায়াতের আপন নাতি মারা যায়। তিনি নিজেই যখন পরিস্থিতির শিকার হন, তখন তিনি বলেন, "যা হয়েছে তা ভাল হয়নি, যা হচ্ছে তা ভাল হচ্ছে না, যা হবে তা ভাল হবে না"। অর্থাৎ, আমরা পরিস্থিতি তখনই অনুধাবন করতে পারি যখন আমি-আমরা নিজেরা ঘটনার শিকার হই।

(তিন)

জনপ্রিয় বলিউড সিনেমা থ্রি ইডিয়টস। সেখানে আমীর খান প্রায় একটি সংলাপ দেন। সংলাপটি হলো, all is well. সিনেমায় উচ্চারণটি করা হয় "আল ইজ ওয়েল"। বুকে হাত দিয়ে " আল ইজ ওয়েল" বলে ধরে নেওয়া হয় সব ঠিক আছে। কোথাও কিছু হয় নি, কোথাও কিছু হচ্ছে না। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চলছে।

(চার)

ফেনী`র নুসরাত যখন নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজের শরীরের আশি ভাগ আগুনে পুড়িয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকে তখন আমরা ভাবি, " যা হয়েছে ভালই হয়েছে, যা হচ্ছে ভালই হচ্ছে, যা হবে ভালই হবে"। ছোট শিশু যখন সকালে মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা নিতে গিয়ে শিক্ষকরূপী হায়েনার হাতে প্রাণ হারায়, তখনো আমরা নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলি, " all is well", "all is well".

আমাদের বোধ হবে তখন যখন ঘটনা এসে আমার বা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসবে। জয়যাত্রা ছবিতে আবুল হায়াত বিলাপ করে বলেন, " যা হয়েছে ভাল হয়নি, যা হচ্ছে ভাল হচ্ছে না, যা হবে তা ভাল হবে না"। তবে ততোক্ষণে সব শেষ। সেই ধাক্কা শেষ পর্যন্ত তিনি সামলাতে পারেন না। এই বোধ আমাদেরও হবে তবে তখন কিছুই করার থাকবে না।

আমরা ঠিকই ঘুরে দাঁড়াব। তবে তার আগে নুসরাতের মতো আমাকে আপনাকেও অগ্নিদগ্ধ হতে হবে। যাত্রাবাড়ীর সেই শিশুটি, যে মক্তবে পড়তে গিয়ে লাশ হয়- তার স্বজনদের জায়গায় নিজেকে দাঁড়াতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, বাঙ্গালী তখনই ঘুরে দাঁড়ায় যখন তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়। তখন আমরা all is well (আল ইজ ওয়েল) বলি না, বলব না।

এসি