ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোটের ইস্যুগুলো কী?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৯:০৪ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০১৯ শুক্রবার
ভারতে বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে লোকসভা নির্বাচন বা সাধারণ নির্বাচন। সংখ্যার বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম ওই গণতন্ত্রে সাত পর্বের ম্যারাথন ভোটগ্রহণ, আর ৯০ কোটিরও বেশি ভোটারের রায়ে স্থির হতে চলেছে- কোন দল বা জোট ভারতে গড়বে পরবর্তী সরকার। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে এই নির্বাচনে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারছে রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলো?
পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতের বিমান হামলা, নোট বাতিল বা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার মতো বিষয়গুলোই বা কতটা প্রভাব ফেলছে নির্বাচনি প্রচারণায়?
ভারতের নানা প্রান্তে ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে বিজেপির `হর হর মোদি` স্লোগান - কোথাও আবার রাহুল গান্ধীর সঙ্গে জনতা গলা মেলাচ্ছে `চৌকিদার চোর হ্যায়` স্লোগানে। রাজনীতির আগুনের আঁচ পোহাচ্ছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা।
কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার জবাব কীভাবে দেওয়া উচিৎ, অর্থনীতির হাল কী দাঁড়াচ্ছে বা এ দেশে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকতে পারবে কি না- চর্চায় এখন এই বিষয়গুলোই।
দিল্লির বাসিন্দা হরিশ মেহতা বলছিলেন, "কাশ্মীরে প্রায় রোজ এত লোক, এত সেনা মারা যায়- কিন্তু এই প্রথম মনে হল দেশে একজন প্রধানমন্ত্রী অছেন!" যিনি ইঁটের জবাব পাটকেল দিয়ে দিতে জানেন, শত্রুকে বুঝিয়ে দিতে পারেন ভারতের সরকার মোটেও দুর্বল নয়!
বালাকোটে হামলা নিয়ে তিনি যেমন উচ্ছ্বসিত, দিল্লির কর্মজীবী নারীদের কাছে আবার বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হল রাস্তাঘাটে রোজকার সুরক্ষা, যেদিকে নজর দেয় না কোনও দলই।
তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী নেহার কথায়, "আজও মেয়েদেরই তো সবচেয়ে বেশি আক্রমণের নিশানা করা হয়।"
অটোচালক হাবিব খান আবার মনে করেন, দেশের সব মানুষ যাতে শান্তিতে এক সঙ্গে থাকতে পারে ভোটে তার চেয়ে বড় বিষয় কিছুই হতে পারে না। তিনি বলছিলেন, "প্রধানমন্ত্রী হলেন মুলুকের সবার বাদশাহ, তার তো সবাইকে এক নজরে দেখা উচিৎ।"
"বাবাও যদি কোনও এক ছেলের প্রতি বেশি পক্ষপাত করে, অন্য ছেলেরাও কিন্তু বাবার শত্রু হয়ে যায়। ফলে আমি শুধু চাইব দেশের বাদশা সবাইকে নিয়ে চলবেন।" প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও মনে করছে, এই নির্বাচন ভারতের সেই অন্তরাত্মাকে ফিরে পাওয়ার লড়াই - যা সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের কথা বলে।
কংগ্রেসের জাতীয় মুখপাত্র প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী বিবিসিকে বলছিলেন, "সব ধর্ম, সব জাতপাতের মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে চলাটাই ছিল ভারতের আবহমান স্পিরিট।"
"কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গত পাঁচ বছরে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ কিংবা আর্থিক সামর্থ্যের ভিত্তিতে দেশে যে পরিমাণ বৈষম্য হয়েছে তা সম্পূর্ণ নজিরবিহীন।"
"রাহুল গান্ধীও তাই বারবার বলছেন এবারের ভোটই স্থির করে দেবে ভারতের যে প্রগতিশীল, উদার মুখটাকে আমরা এতকাল ধরে চিনতাম সেটাকে ফিরে পাওয়া যাবে কি না!"
ক্ষমতাসীন বিজেপি আবার দাবি করছে, এই নির্বাচন হলো নরেন্দ্র মোদির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভারতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পরের ধাপে উত্তীর্ণ করার লড়াই - দেশে এখন কোনও জোড়াতালি দেওয়া সরকার কিছুতেই কাম্য নয়!
বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলির কথায়, "সবাই বুঝছে যে ভারতবর্ষ এখন এমন একটা পর্যায়ে- যেখান থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বিরাট একটা সুযোগ এসেছে।"
"সেই যাকে আমরা বাংলায় বলতাম, `জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে`, এখন হলো সেই পরিস্থিতি।" "এই পরিস্থিতিতে আমরা কি একটা নড়বড়ে সরকার চাই, যার নেতার দাবিদার অসংখ্য এবং দিশার কোনও ঠিকঠিকানা নেই?" "না কি আমরা এমন সরকার চাইব যার নেতা কে একেবারে পরিষ্কার, যিনি দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে কাজ করবেন?"
"রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা বা প্রতিরক্ষার প্রশ্নে যার অবস্থান সুস্পষ্ট, যিনি সবাইকে নিয়ে চলতে পারবেন- এমন একজন নেতারই এই মুহুর্তে আমাদের প্রয়োজন!", বলছেন ড: গাঙ্গুলি।
কিন্তু বিজেপি যেটাকে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বলছে, তাতে যে দেশের অর্থনীতির সমস্যাগুলো মিটছে না, সেই ইঙ্গিতও কিন্তু পরিষ্কার। ভারতে যেমন এই মুহুর্তে প্রবৃদ্ধির হার বেশ ভালো, কিন্তু মানুষের চাকরি জুটছে না - বিশেষজ্ঞরা অনেকেই যেটাকে বলছেন `জবলেস গ্রোথ`।
অর্থনীতিবিদ সুমিতা কালে-কে প্রশ্ন করেছিলাম, এই কর্মসংস্থানের অভাব নির্বাচনে কি বড় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে? ড. কালে বলছেন, "অবশ্যই পারে। তবে চাকরি ছাড়াই প্রবৃদ্ধির এই বিষয়টাতে অবশ্য বেশ কিছু অস্পষ্টতা আছে, বিশ্বাসযোগ্য উপাত্তেরও অভাব আছে।"
"কিন্তু আমরা যেটা বলছি, তা হল নির্দিষ্ট কিছু খাতে অবশ্যই চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।" "শিল্পের চাহিদা একরকম, কিন্তু আমাদের শ্রমশক্তির স্কিল বা দক্ষতা অন্যরকম - সেই ঘাটতিটা পুষিয়ে নিয়ে পরস্পরের প্রয়োজন মেটানোর কাজটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।"
ভারতে সরকারি নীতি বা পাবলিক পলিসি নিয়ে কাজ করে থাকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পুনে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার বা পিআইসি। সেই পিআইসির ড. প্রশান্ত গির্বানে আবার বলছেন, এবারের নির্বাচনে আসলে অনেকগুলো বিষয়ই খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
তার কথায়, "আজ আমরা যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, তাতে এবারের ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত এমন চার-পাঁচটা ইস্যু নিয়ে আমরা কাজ করেছি, যেগুলোতে ফোকাস থাকবে বলে ধারণা করা যায়।"
"যেমন ম্যাক্রোইকোনমিকস, যেমন গ্রোথ অ্যাক্সিলেটর বা প্রবৃদ্ধি কীভাবে গতি পাবে সেই ফ্যাক্টরগুলো, কিংবা কর কাঠামোর সংস্কার - আয়কর থেকে কর্পোরেট কর সবকিছুই।" "কালো টাকার অর্থনীতির সঙ্গে লড়াই, কিংবা জাতীয় নিরাপত্তা বলতে যে শুধু দেশের প্রতিরক্ষাই বোঝায় না- এই বিষয়গুলোও কিন্তু মানুষ এখন বুঝতে শিখছে।"
গত দু-তিন বছরে বছরে ভারতে অর্থনীতির গতিকে আরও মন্থর করেছে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত, জিএসটি-র মতো নতুন কর। পরিষ্কার বোঝা গেছে, পাঁচ বছর আগে দেশে যে মোদি-ঝড় উঠেছিল তা একেবারেই স্তিমিত - কিন্তু বিজেপির জন্য স্বস্তির কথা হল বিরোধী শিবিরও তেমন একটা সুসংহত নয়।
জনপ্রিয় পলিটিক্যাল স্যাটায়ারিস্ট আকাশ ব্যানার্জি বলছিলেন, "মুডটা বদলেছে কোনও সন্দেহ নেই। মোদিকে নিয়ে মোহভঙ্গও হয়েছে, কারণ প্রত্যাশা ছিল বিপুল। কিন্তু কনভার্সেশনটা এতটা চেঞ্জ হয়ে যায়নি যে রাহুল গান্ধী এখন দারুণ!"
"এই একটা নির্বাচন, যেখানে লোকে দেখছি বলছে, `রাহুলবাবা আর একটু, আর একটু - এবারে ঠিক পারবে। এই তো এখন প্রিয়াঙ্কাও চলে এসেছে, হয়ে যাবে, হয়ে যাবে।` কিন্তু তাতেও কিছু হচ্ছে না।"
"আমি তো বলব, মোদি ভার্সেস রাহুল নয়, লড়াইটা যেন হচ্ছে মোদী ভার্সেস কমন সেন্স - একটা কেউ শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যাবে এই ভরসাটুকু।"
"একশো পঁচিশ কোটির দেশে আমরা জুৎসই কোনও বিরোধী খুঁজে পাচ্ছি না, ট্র্যাজেডিটা এখানেই!"
কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী কিন্তু দাবি করছেন, গরিবদের বছরে ৭২ হাজার রুপি আর্থিক সহায়তার ঘোষণা বিরোধী শিবিরের পালে জোরালো বাতাস এনে দিতে পারে।
তার কথায়, "সামাজিক সম্প্রীতি থাকলে তাহলেই কিন্তু কেবল অর্থনীতির উন্নতি হতে পারে।"
"সমাজের একটা স্যুটেড-বুটেড অংশ দিনে ন`হাজার কোটি টাকারও বেশি কামাবে, অন্যদিকে বেশির ভাগ পরিবার মাসে বারো হাজার টাকাও উপার্জন করতে পারবে না - এভাবে চলতে পারে না।"
"এই ফারাকটা দূর করাও কিন্তু অর্থনীতির কাজ, আর সেখানেই রাহুল গান্ধীর ঘোষিত নীতি একটা গেমচেঞ্জার হয়ে উঠতে পারে।"
"এই নির্বাচন অবশ্যই হবে অর্থনীতি-কেন্দ্রিক, যে অর্থনীতি সমাজের সব শ্রেণির উন্নতির কথা ভাববে, শুধু মুষ্টিমেয় ধনীদের কথা নয়", বলছেন মিস চতুর্বেদী।
অর্থনীতিই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে কিনা - সেটা জানা যাবে খুব শিগগিরি। তবে বিজেপি আবার বলতে চাইছে, শেষ বিচারে এবারের ভোট কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর কাজের ওপরই একটা গণভোট বা রেফারেন্ডাম।
অনির্বাণ গাঙ্গুলি যেমন বলছিলেন, "উনি তো নিজেই সেটা বলছেন, কোনও অজুহাত দিচ্ছেন না কিন্তু!" "মানুষকে মোদীজি বলছেন, গত পাঁচ বছরে আমাকে আপনারা যে সুযোগ দিয়েছেন তাতে এইগুলো করেছি, আগামী পাঁচ বছরে আরও এই জিনিসগুলো করতে চাই।"
"সত্তর বছরে যে কাজগুলো অসমাপ্ত রয়ে গেছে সেগুলোর সব নিষ্পত্তি করব, তাই আর একটা টার্ম চাইছেন।" "গত পাঁচ বছরে ভিত্তিস্থাপন হয়েছে, এখন এই ভিতের ওপরই যেটাকে উনি `নিউ ইন্ডিয়া` বলছেন সেটাকে তিনি এবার তৈরি করবেন।"
দিল্লির রাজনৈতিক পন্ডিতরা এই `নতুন ভারতে`র মন পড়তে পারছেন, তা নিয়ে অবশ্য খুব একটা নিশ্চিত নন আকাশ ব্যানার্জি।
২০০৪-য়ে কেউ ভাবেনি অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার হারবে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলছিলেন, দেশে নতুন সরকার গড়ার চাবিকাঠি কিন্তু থাকবে গ্রামীণ ভারতের হাতেই। ব্যানার্জির কথায়, "কোনও মিডিয়ার এটা জানা নেই যে গ্রামীণ ভারতের ভোটার ঠিক কী ভাবছে, আর তারা কোন বোতামে চাপ দেবেন।"
মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের মতো আঞ্চলিক দলগুলোর ভূমিকাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। "গ্রামীণ ভারত হয়তো ভাবছে কৃষিখাতে দুর্দশার কথা, হয়তো ভাবছে মব লিঞ্চিং কিংবা ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোর রাজনীতির কথা।"
"কথাটা হল, তারা কি এতটাই ক্ষুব্ধ যে মোদীকে ভোট দেবে না? মোদীকে নিয়ে হতাশা আছেই, কংগ্রেসের প্রতিও দুর্বলতার কোনও কারণ নেই - হয়তো দেখা যাবে আঞ্চলিক দলগুলোই খুব ভাল করবে।"
ফলে নির্বাচনী ন্যারেটিভ অনেকগুলোই- নরেন্দ্র মোদি বনাম রাহুল গান্ধী বনাম আঞ্চলিক দলগুলো, বালাকোট, ধর্ম কিংবা অর্থনীতি।
এই জটিল গোলকধাঁধার মধ্যে থেকে ভারতের ভোটাররা কোনও দল বা জোটকে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা দেবেন সেই সম্ভাবনাও বেশ কম বলেই মনে হচ্ছে। যদিও চূড়ান্ত উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে সেই আগামী মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত।
তথ্যসূত্র: বিবিসি।
এসএইচ/