ঢাকা, রবিবার   ০৩ নভেম্বর ২০২৪,   কার্তিক ১৮ ১৪৩১

ঐতিহ্যের হালখাতায় প্রযুক্তির ছোঁয়া

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:০০ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০১৯ রবিবার

আজ ১৪ এপ্রিল- রোববার, পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ উপলক্ষে বর্ণিল আয়োজনেও কোনো কমতি নেই বাঙালিদের মধ্যে। কিন্তু ডিজিটালের ভিড়ে বাঙালির ঐতিহ্য হালখাতা যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি দোকান সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, চিরচেনা হাতে লেখা খাতার ব্যবহার বেশি একটা দেখা যায়নি। দোকানে কম্পিউটার বা মোবাইলের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনার হিসাব রাখা হচ্ছে।

ফলে ক্যাশিয়ারের পাশে থাকা চিরচেনা লাল কাগজে মোড়ানো হিসাবের হালখাতার বইটিও যেন আর চোখে পড়েনি। তবে এর ব্যতিক্রম দেখা যায় পুরান ঢাকা এলাকায়।

সময়ে ব্যবধানে সংস্কৃতির অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও সে হাওয়ায় খুব একটা প্রভাব পড়েনি পুরান ঢাকারা ব্যবসায়ীদের। তাই নতুন বছরে হিসাব নিকাশের শুভ সূচনা করতে হালখাতা উৎসবের আয়োজন চলছে পুরোদমে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, হালখাতা আয়োজনের সঠিক দিন নিয়ে বিভ্রান্তি থাকায় প্রতি বছরই আনন্দ উৎসবে কিছুটা হলেও ভাটা পড়ে। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা এ দ্বিমত দূর করতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান তাদের।

প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে ছোট্ট এই দোকানেই স্বর্ণের ব্যবসা শুরু করেছিলেন রাজধানীর তাতি বাজারের চন্দন দেবনাথের বাবা। কয়েক বছর আগে তার বাবা প্রয়াত হয়েছেন। তবে শক্ত হাতেই পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া ব্যবসা আগলে রেখেছেন দু`ভাই।

প্রতিবছরই চৈত্রের শেষ সময়ে নিজেদের হাতে দোকানটিকে ধুয়ে-মুছে এভাবে নতুন রূপ দেয়ার চেষ্টা করেন তারা। পাশাপাশি চলে পুরো বছরের লেনদেনের হিসেব-নিকেশ হালনাগাদের কাজ।

পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার পাশাপাশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে খোলা হবে নতুন হিসাবের খাতা।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এদিন দোকানে আসতে থাকেন দেনাদার ও পাওনাদাররা। আমন্ত্রিতদের মিষ্টি ও ফল দিয়ে এ দিন আপ্যায়ন করা হয়।

পুরনো ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারি বাজার, ইসলামপুর, চকবাজার ও শ্যাম বাজারের ব্যবসায়ীরা এখনও ধুমধাম করে পুরনো দেনা-পাওনা হিসেবে চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন। এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পহেলা বৈশাখের হালখাতা উৎসব পালন করার জন্য ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান পাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন। তবে হিন্দু ব্যবসায়ীরা পঞ্জিকা অনুযায়ী হালখাতা পালন করে থাকেন।

শাখারি বাজারের শ্রী শ্রী মা ভাণ্ডার জুয়েলারীর স্বত্ত্বাধিকারী স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ কর্মকার বলেন,‘আমরা প্রতিবছরের মত এবারও দোকানপাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছি নতুন বছরের হালখাতা করবো বলে। আর যারা সারা বছর আমাদের দোকানের ক্রেতা তাদের আমন্ত্রণ করেছি। তাদের জন্য মিষ্টিমুখ করার আয়োজন রয়েছে। আমারা প্রতিবারের মত একইভাবে আমাদের ক্রেতাদের আপ্যায়ন করাবো এ দিনটিতে।

এভাবেই সব ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাট ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছেন। ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করানোর মধ্য দিয়ে খুলবেন নতুন খাতা। তারা জানান, ব্যবসায়ীদের জন্য বৈশাখের শুরুটা হালখাতার উৎসব দিয়েই হয়। ব্যবসায়ীরাও অপেক্ষা করেন এ সময়টার জন্য।

হালখাতার প্রস্তুতি সম্পর্কে কথা হয় তাঁতীবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও অমিত জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী কমল বসাকের সঙ্গে। তার কাছে হালখাতায় ক্রেতাদের যে সব খাবার পরিবেশন করা হয় সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘এলাকা ভেদে খাবারের পরিবেশনটা হয়ে থাকে। আমাদের এ অঞ্চলটায় মিষ্টি খাবারের পাশাপাশি বিরিয়ানির আয়োজনটাও থাকে।

হালখাতা আয়োজনের ধরনেও বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। মুসলমান ব্যবসায়ীরা হালখাতার দিনে ‘বিসমিল্লাহ’কিংবা ‘এলাহি ভরসা’ লিখে তাদের নতুন হিসাবের খাতা খুলবেন। অন্যদিকে হিন্দু ব্যবসায়ীরা গনেশ পূজা করে তাদের হালখাতার উৎসব শুরু করেন। ব্যবসায় সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্যে বছরের শুরুর দিন তাদের দোকান কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দোয়া অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে থাকে অনেক ব্যবসায়ীরা। এভাবেই বছরের প্রথম দিনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজ শুরুর একটা আনুষ্ঠানিকতা ঘোষিত হয় যার যার রীতিতে।

এদিকে হালখাতা যে বৈশাখের প্রথম তারিখেই করতে হবে এমন কোনো ধরা বাধা নিয়ম নাই; বরং যার যার সুবিধা মতো বছরের প্রথম এই মাসের যে কোনো তারিখেই হালখাতা করতে পারেন।

হালখাতা উৎসবের প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে জীবন-যাপনের ধরন পরিবর্তনের সঙ্গে পুরনো সেই হালখাতার ধরনও বদলে গেছে। একটা সময় ছিল শহরের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতা করা হলেও কালে বির্বতনে এখন আর আগের মতো এই রেওয়াজ পালন করা হয় না।

তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় পুরনো এই ঐতিহ্য দিনদিন জৌলুস হারাচ্ছে। ব্যবসায়িক মন্দা ও প্রতারণা এ জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। নগরীতে সাড়ে তিন হাজারের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে প্রতিদিন লেনদেন হয় দুই হাজার কোটি টাকার মত।

টিআর/