ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধিতে ভারত-পাকিস্তানকে টপকেছে বাংলাদেশ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৩৬ পিএম, ১৪ এপ্রিল ২০১৯ রবিবার

প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের বড় অংশই কাজ করছেন মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ অর্থনীতির বিভিন্ন দেশে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তেলের মূল্যে মন্দাবস্থা কেটে ওঠায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে এসব দেশের অর্থনীতিও। এর প্রভাব পড়েছে সেখানে শ্রমিক পাঠানো দেশগুলোর রেমিট্যান্সপ্রবাহে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, যা প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়েও বেশি। অভিবাসন ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড রেমিট্যান্সেস: রিসেন্ট ডেভেলপমেন্টস অ্যান্ড আউটলুক’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে গত সপ্তাহে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্সপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পর রয়েছে ভারত। দেশটিতে গত বছর রেমিট্যান্সপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। এছাড়া পাকিস্তানে ৬ দশমিক ৭ ও শ্রীলংকায় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রেমিট্যান্সপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিতে শীর্ষে রয়েছে নেপাল। গত বছর দেশটিতে আসা রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

তবে প্রবৃদ্ধির বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ বিবেচনায় তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে ভারত ও পাকিস্তানে রেমিট্যান্স এসেছে যথাক্রমে ৭৮ দশমিক ৬ ও ২১ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে নেপালে রেমিট্যান্স এসেছে ৮ দশমিক ১ ও শ্রীলংকায় ৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যেই সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। তেলের দাম কমে যাওয়ায় দেশগুলো সংকটে পড়েছিল। এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বেশকিছু বিধিনিষেধও শিথিল করা হয়েছে দেশগুলোয়। আর অবৈধ পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ রোধ করতে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এসবের প্রভাব দেখা যাচ্ছে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধিতে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে বিএমইটি থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ কর্মী কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যান। এ সংখ্যা আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ছিল ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫। ২০১৬ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন মোট ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৭৩১ জন বাংলাদেশী। ২০১৫ সালে যান ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন। ২০১৪ সালে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৪ জন এবং ২০১৩ সালে বিদেশগামী বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৯ হাজার ২৫৩।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন। গত এক দশকে বাংলাদেশীদের জন্য নতুন কিছু শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে। দক্ষ জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়ছে। গ্রামাঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে যাওয়ায় বৈধ পন্থায় রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রবাসীরা উৎসাহিত হচ্ছেন। ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকলে আগামীতে দেশের জিডিপিতে প্রবাসীরা আরো বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৮ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় সার্বিকভাবে রেমিট্যান্সের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। আগের বছর এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। মূলত শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলোর শক্তিশালী অর্থনৈতিক অবস্থা ও তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মন্দা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। এ কারণে এসব দেশ থেকে রেমিট্যান্সপ্রবাহ আগের তুলনায় বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রবাসীরা ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ হাজার ১৬৫ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৮৪ কোটি ৩৪ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৪৬ কোটি ১১ লাখ ও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৪২২ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। ওই বছর প্রবাসীরা ১ হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি ১১ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭৬ কোটি ৯৪ লাখ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে। আর চলতি অর্থবছরের নয় মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ১৮৬ কোটি ডলার।

দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্সপ্রবাহ ১০ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে ২০০৯-১০ অর্থবছরে। বছরটিতে ১ হাজার ৯৮ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স দেশে আসে।

রেমিট্যান্সপ্রবাহে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অস্বাভাবিক বিপর্যয়ের পর বিভিন্নমুখী উদ্যোগ নেয় সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক। কড়াকড়ি আরোপ করা হয় বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ওপর। হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন ও মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহে বেশ অগ্রগতি আসে। বিদায়ী অর্থবছরে প্রবাসী আয় ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি ১৬ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধির এ ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল। পরিস্থিতির উন্নতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিরুৎসাহিত হয়েছে। এর প্রভাবে বৈধ পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি রেমিট্যান্স সংগ্রাহক দেশের মধ্যে বাংলাদেশ নবম। ২০১৮ সালে ৭৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স নিয়ে তালিকার শীর্ষ দেশ ভারত। ৬৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স নিয়ে চীন রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। শীর্ষ রেমিট্যান্স সংগ্রাহক হিসেবে এর পরের দেশগুলো হলো মেক্সিকো (৩৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন), ফিলিপাইন (৩৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন), মিসর (২৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন), নাইজেরিয়া (২৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন), পাকিস্তান (২১ বিলিয়ন) ও ভিয়েতনাম (১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন)। নবম স্থানে থাকা বাংলাদেশের পরে ১৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স নিয়ে তালিকায় স্থান পেয়েছে ইউক্রেন।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় জিডিপি বিবেচনায় ২০১৮ সালে রেমিট্যান্সের অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল নেপালে। দেশটির জিডিপির ২৮ শতাংশই এসেছে রেমিট্যান্স থেকে। এছাড়া শ্রীলংকার জিডিপির ৮ দশমিক ১ শতাংশ, পাকিস্তানের ৬ দশমিক ৮, বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৪, ভারতের ২ দশমিক ৯, ভুটানের ১ দশমিক ৮ ও মালদ্বীপের জিডিপির শূন্য দশমিক ১ শতাংশ এসেছে রেমিট্যান্স থেকে।

আরকে//