ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

বাংলা বর্ষবরণ আমাদের কালে

ড. সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১১:৩২ পিএম, ১৫ এপ্রিল ২০১৯ সোমবার

জয়তু ১৪২৬। নতুন বছরের পহেলা বৈশাখ এসেছে আমাদের দোরগোড়ায়। জানি, বাংলাদেশের আনাচ-কানাচ রঙ আর রেখায় ভরে গেছে। রঙ উঠে এসেছে মেয়েদের শাড়িতে, ছেলেদের পাঞ্জাবিতে, নানান ফুলের সমাহারে, তোরণের বর্ণচ্ছটায়। রেখা তার স্থান করে নিয়েছে আলপনায়, দেয়ালে, প্রতিচিত্রে। ওই তো দেখতে পাই আর্ট কলেজের ছেলেমেয়েরা সারা রাত জেগে ঢাকার রাস্তায় আলপনা এঁকেছে, দেয়ালচিত্র শেষ করেছে, নানান রঙের আর ঢঙের মুখোশ বানিয়েছে, রঙিন কাগজের প্রতিমূর্তি গড়েছে প্রভাতের শোভাযাত্রার জন্য। কী উন্মাদনা, কী উৎসাহ চারদিকে—আনন্দ, স্ফূর্তি আর উৎসবের আমেজ আকাশে-বাতাসে।

আজ বরণ করে নেয়া হয়েছে নতুন বছরকে প্রীতি-সম্ভাষণে, গানে, আমোদে আর মুখরোচক খাদ্যে। সব শহরের মতো ঢাকা শহরেও মেলা বসেছে নানান জায়গায়, রমনার বটমূলে বসেছে গানের আসর, চিরায়ত বাঙালি খাবার উঠে এসেছে আমাদের রসনায়। নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো, শিশুদের কলকাকলিতে ঘন হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস।

কিন্তু এসব চালচিত্র পেরিয়ে মন কখন যেন চলে যায় অনেক দূরে, প্রায় ৬০ বছর আগে। ছবির মতো বরিশাল শহরের বেশির ভাগ ভবনই ছিল লাল সুরকির। ব্রজমোহন কলেজসংলগ্ন আমাদের দোতলা কাঠের বাড়ির ধার ঘেঁষে যে পথটি চলে গেছে, তা শহর পেরিয়ে কাশীপুর হয়ে চলে গেছে। ওই পথ ধরেই বাস যেত রহমতপুর, ভূরঘাটা, গৌরনদী, চাখার আরো কত জায়গায়। যতবার বাস যেত, ততবারই একটি লাল ধুলোর ঘূর্ণি উঠত রাস্তার ওপর ক্ষণিকের জন্য। তারপর তা মিলিয়ে যেত।

কিন্তু একদিন সেই লাল ধুলোর ঘূর্ণি ঘন হয়ে বসে যেত বাতাসে এবং সেটা ওই পহেলা বৈশাখেই। সারা বরিশাল শহরের মানুষ ওই পথ ধরে রওনা হতো পশ্চিমে বেলা ৩টায় শুরু হওয়া কাশীপুরের বৈশাখী মেলার দিকে। রিকশায়, সাইকেলে, পদব্রজে লোকের যাত্রা শুরু হয়ে যেত সেই দুপুর ১২টা থেকেই। সে জনস্রোতের একটা বিরাট অংশই ছিল শিশুরা, ওই যে মেলার মাটির পুতুলের জন্য। গরুর ক্ষুরের সৃষ্ট ধূলি থেকে ‘গোধূলি’ শব্দটি এসেছে, কিন্তু আমাদের বরিশালে পহেলা বৈশাখে হেঁটে চলা পায়ে পায়ে যে মনুষ্যধূলির সৃষ্টি হতো, তার কাছে গোধূলি তো নস্যি।

বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় বড় কারো হাত ধরে আমরা দুই ভাই-বোন প্রতি বছরই যেতাম সেই বৈশাখী মেলায়। বাবা না যেতে পারলেও পাঠিয়ে দিতেন বড় কারো সঙ্গে। আমাদের দুজনের হাতে দেয়া হতো একটি করে টাকা পুতুল বা যা খুশি তা কেনার জন্য। সেই সঙ্গে মিলত মাটির বটুয়ায় জমানো আমাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়। মায়ের নিষেধাজ্ঞা ছিল বাইরের খাবার না কেনার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মেলার ধূলিমিশ্রিত নকুল দানা কিংবা চৌকো করে কাটা তিলের খাজা অথবা ঝুরঝুরে ঝুরিভাজার স্বর্গীয় স্বাদ কি ঘরের বানানো খাবারে হয়? সুতরাং মায়ের নিষেধাজ্ঞা তত্ত্বেই থাকত, বাস্তবে নয়।

মেলায় গিয়ে পড়তে হতো এক কঠিন সমস্যায়। এত সব সুন্দর মাটির পুতুল-ঘোড়া, বর-বউ, গরু, হাতি, পাখি—কোনটা ছেড়ে কোনটা নিই। পোড়ামাটির ওপর সুন্দর উজ্জ্বল রঙের চোখ-মুখ আঁকা ওইসব পুতুলের দিকে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকতাম। মনে হতো দুহাতে আঁকড়ে ধরে সব পুতুল নিয়ে নিই, কিন্তু সাধ আর সাধ্যে যে বিরাট ফারাক। তারই মধ্যে ছোট্ট মাথা খাটিয়ে পছন্দ করতাম কিছু পুতুল। কুমোরেরা যখন তাদের ডালি থেকে পুতুলগুলো আমাদের কচি হাতে তুলে দিতেন, তখন মনে হতো হাতে স্বর্গ পাওয়া গেল।

বাড়ি ফিরে সেই সব ঘোড়া, হাতি আর পাখিকে উল্টেপাল্টে কতবার যে দেখা হতো! রাতে ঘুমোনো হতো ওইসব পুতুলকে বালিশের পাশে সাজিয়ে। দুটি ঘটনার কথা মনে আছে। একবার নিজের সঞ্চয় থেকে মায়ের জন্য একটা শিশু কোলে মা-পুতুল নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন মায়ের মুখে যে খুশির আভা দেখেছিলাম, তা কখনো ভুলব না। আর একবার আমার হাত থেকে আমার ঘোড়া পুতুলটা ভেঙে গিয়েছিল। আমার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বোন তার ঘোড়াটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। তার মূল্য তখন হয়তো বুঝিনি, আজ বুঝি।

সন্ধ্যের দিকে আবার শুরু হতো আরেক পালা—হালখাতা। বাবা আমাকে নিয়ে বেরুতেন মাখন কাকা আর হারাধন জেঠার বইয়ের দোকানে, জহুর চাচার কাপড়ের প্রতিষ্ঠান চিটাগং বস্ত্রালয়ে, অশ্বিনীদার কাঠের কারখানায়। সুবেশ বিপণি মালিকরা আমাদের যত্ন করে বসাতেন, সুস্বাদু সব খাবার আসত। তাকিয়ে দেখতাম লাল রঙের নতুন হালখাতা। যতদূর মনে পড়ে, বাবা একটা টাকা প্রতীকী হিসেবে তাদের হাতে তুলে দিতেন।

সেইসব কর্মকাণ্ডে আমার যে কী যত্ন-আত্তি! কাকা-দাদারা হাঁক দিচ্ছেন তাদের কর্মচারীদের গরম গরম রসালো মিষ্টান্ন আনার জন্য, পরম যত্নে তুলে দিচ্ছেন আমার পাতে, জোর করছেন এটা-ওটা খাওয়ার জন্য। তারই ফাঁকে ফাঁকে বাবার কাছে আশীর্বাদ চাইছেন, যাতে সারা বছরটা ভালো যায়। খাওয়া শেষে পিতলের ঘটি-গ্লাসে জল আসত, বাবা একটি পান তুলে নিতেন হাতে, বিপণি মালিকরা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন।

কিন্তু সবসময় যা আমার দৃষ্টি কাড়ত, তা হচ্ছে ওই হালখাতা। সাদা সুতোয় বাঁধা লাল খাতাটা এলিয়ে থাকত টাকা-পয়সার বাক্সের পাশে। অদূরেই পিতলের ঘটিতে জলে পাঁচটি আমপাতা মুখ উঁচিয়ে থাকত। তার পাশেই কলম আর দোয়াত হিসাব লেখার জন্য। আমি প্রায়ই ওই লাল খাতার ওপর হাত বুলোতাম। লাল সালুর ওই খাতাটি দেখতে দেখতে কেমন যেন ঘোর লেগে যেত।

তারপর সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসত। বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নেমে চোখে পড়ত পাশের বাড়ির বন্দনা মাসিমা তাদের উঠোনের মাঝখানে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে। সামনে মাটির প্রদীপ জ্বলছে আর তার আভায় সিঁদুর রাঙা সিঁথি আর জ্বলজ্বলে টিপে মাসিমাকে দেবীর মতো মনে হতো। তার গলায় জড়ানো লাল-সাদা শাড়ির আঁচলে আর তার নিমগ্নতায় কী যে সুন্দর লাগত তাকে। বাবা খুব নরম করে বলতেন, ‘যাও, মাসিকে প্রণাম করে এসো।’

আমি তাদের উঠোনের দিকে যেতে যেতে মনে হতো কাল রাতে আমার ঘরের জানালা থেকে দেখেছি, বন্দনা মাসি তাদের তুলসীতলা নিকিয়েছেন, বারান্দায় আলপনা এঁকেছেন চালের গুঁড়োর, মঙ্গলঘট বসিয়েছেন সিঁড়ির দুধারে। আজ খুব ভোরে ঘুমচোখে দেখেছি, তাদের বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুরটা এক ডুবে পার হয়ে ওপাড়ে ছোট্ট আম গাছটা থেকে দুটি কচি আম তুলে আবার এক ডুবে ফিরে এসেছেন এ পাড়ের ঘাটে।

আমার পায়ের সাড়া পেয়ে বন্দনা মাসির তন্ময়তা ভেঙে যেত। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘কি রে, বাবার সঙ্গে গিয়ে পেট পূজা সেরে এলি?’ আমি কিছু না বলে বন্দনা মাসিমার পায়ের কাছে প্রণত হই। টের পেতাম মাসিমার স্নেহময় হাত আমার পিঠে। আজ মনে হয়, ওই আশীর্বাদ, ওই মমতা আর মায়াই তো ঘিরে রেখেছে আমাকে, শুধু বছরের প্রথম দিনে নয়, সারা বছর এবং সারা জীবনও বটে।

 

লেখক: ভূতপূর্ব পরিচালক

মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং

দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।