মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিকথা
তোফায়েল আহমেদ :
প্রকাশিত : ১০:১৮ এএম, ১৭ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার
মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে আজ কত কথা আমার মানসপটে ভেসে উঠছে। ’৭১-এর ২৫ মার্চ দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে।
এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির জনকের কাছ থেকে বিদায় নেই।
বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি, সেই নির্দেশিত পথে তোমরা এগিয়ে যেও। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। আমার কথা ভেবো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আমাকে গ্রেফতার করবে। হয়তো ওরা আমাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি, তা যথাযথভাবে পালন করো।’
অসাধারণ দৃঢ়চেতা মহান নেতা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ রাতে মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে আমরা অবস্থান করি। রাত ১২টায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচণ্ড গোলাগুলি। এক রাতেই পাকবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি জাতির জনককে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরও আগেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি।’
২৬ তারিখ থেকে কারফিউ জারি হয়। ২৭ তারিখ ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানীগঞ্জ চলে যাই। কেরানীগঞ্জ পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওতে শুনতে পেলাম, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নানের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ তথা ‘Declaration of Independence’-এর কথা উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’
কেরানীগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাহেব এবং এএইচএম কামরুজ্জামান সাহেব, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমিসহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হল, মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাব। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।
ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ভুট্টো যখন টালবাহানা শুরু করে, তখন সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছিল- পাকিস্তানিরা বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বঙ্গবন্ধু এটা উপলব্ধি করেছিলেন আরও আগেই। বলতে গেলে নির্বাচনের পরপরই তিনি বুঝেছিলেন, ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং তিনিও চাননি ক্ষমতা হস্তান্তর করুক।
সে জন্যই ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ১০ লক্ষাধিক সংগ্রামী মানুষের মহাসমাবেশে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ করিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, ৬ দফা প্রশ্নে তিনি কোনো আপস করবেন না। ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে জাতির জনক জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দান পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’
বলেছিলেন, ‘এখানে থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি।’ ২৯ মার্চ কেরানীগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি বগুড়া হয়ে এপ্রিলের ৪ তারিখ আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।
তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুঁড়ি পৌঁছাই, তখন পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপসহীন, এক কাতারে দণ্ডায়মান।
এপ্রিলের ১০ তারিখ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘Proclamation of Independence’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়; ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’- এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম- ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’
জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে বলতে হয়, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সনদ। এই সনদ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে।
বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি- মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে একটা গাড়িতে করে রাত ৩টায় রওনা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আম্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান বাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে।
মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ এবং ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত।
আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভবকালীন দৃশ্যপট। দিনটি ছিল শনিবার। বেলা ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা গগনবিদারী স্বরে ‘জয়বাংলা’ জয়ধ্বনি দিল। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠানস্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহণ করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের (এসপি মাহবুব, বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকরা পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করে নেতৃবৃন্দকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানান।
সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএ’র (Member of Constituent Assembly) উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সনদ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ।
স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা মায়ের চারজন বীরসন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ উপস্থিত সবাই তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলালাম।
অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজিতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তার পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’
এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি।
তার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল, তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’
মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট-বড় জাতির বন্ধুত্ব।’ ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয়বাংলা।’ মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল, তাই বলেছেন।
আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক ও অনন্য। পাবনার জেলা প্রশাসক জনাব নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক জনাব তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকসহ আরও অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমার কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক হিসেবে ভারত সরকারের সঙ্গে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতাম আমি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা শ্রী দুর্গাপ্রসাদ ধর (যিনি ‘ডিপি ধর’ নামে পরিচিত) মাঝে মাঝে কলকাতাস্থ হোটেল ‘হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনালে’ আমাদের মুজিব বাহিনীর চার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করতেন। মিস্টার ব্যানার্জী (যার ছদ্মনাম ছিল মিস্টার নাথ) নামে ভারত সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন।
সেই ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, ভবানীপুর, কলকাতায় আমাদের সঙ্গে এসে তিনি দেখা করে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এই সাহায্য আমি মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিতাম। দেরাদুনে আমাদের ট্রেনিং হতো। সেখান থেকে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা দমদম বিমানবন্দরে নামার পরে তাদের ব্যারাকপুরে নিয়ে যেতাম। সবাই তখন নিরলস পরিশ্রম করেছি।
দেরাদুনে প্রশিক্ষণ শেষে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনি কোথায় আছেন; কেমন আছেন জানি না। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার নির্দেশিত পথে আমরা এ যুদ্ধ চালিয়ে যাব এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’
অনেকেই বলে যে, মুজিব বাহিনীর সঙ্গে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের ভুল বোঝাবুঝি ছিল। কথাটি মোটেই সত্য নয়। সরকারের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে আমি নিয়মিত ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে সরকারের দফতরে যেতাম। জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে সবকিছু তাদের অবহিত করতাম।
আমরা যে মুজিব বাহিনী গঠন করেছিলাম, তার প্রকৃত নাম ছিল ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’, সংক্ষেপে বিএলএফ। সেটাকেই আমরা বঙ্গবন্ধু মুজিবের নামে ‘মুজিব বাহিনী’ নামকরণ করেছি। শুধু মুজিব বাহিনী না, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা ‘মুজিবনগর’ নামে ইতিহাস হয়ে আছে।
অনেক অজানা ইতিহাস রয়েছে। একদিকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সেই মিয়ানওয়ালী কারাগারে বন্দি। তার বিচার চলছে। বিচার চলাকালে ডিফেন্স ল’ইয়ার হিসেবে এ কে ব্রোহিকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল পাকিস্তান সরকার। বঙ্গবন্ধু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, আই উইল নট ডিফেন্ড মাইসেলফ। বিকজ ইয়াহিয়া খান ইজ দি প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান।
ইয়াহিয়া খান ইজ দি চিফ মার্শাল’ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। হি ইজ দি কনফার্মিং অথরিটি অব মাই ডেথ সেনটেন্স। অলরেডি হি টোল্ড, মুজিব ইজ এ ট্রেইটর। যেহেতু রায় দেয়া হয়ে গেছে। সুতরাং আমি নিজকে ডিফেন্ড করব না।’ পৃ
থিবীতে অনেক নেতা এসেছেন, অনেক নেতা আসবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এরকম বিচক্ষণ, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো নেতা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে আমার জানা নেই। তার জীবনীটা যদি আমরা আলোচনা করি দেখবো, বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্ত ছিল সংগ্রামী। ২০২০-এর ১৭ মার্চ আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চলেছি- যা হবে মুজিববর্ষ। আশা করি, ‘মুজিববর্ষ’ পালনের মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর জীবনী পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হব।
আজ দেশের সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করে। গত বছর ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ জাতীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।
আমি মনে করি, যারা ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করেন না, যারা ১৭ এপ্রিল ‘মুজিবনগর দিবস’ পালন করেন না, তারা মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদী মৃত্যুকে বরণ করেছেন; তাদের রক্তের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দুঃসময়ে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। মিত্রবাহিনী গঠন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সৈনিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছে।
দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনকের অনুরোধে স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ’৭২-এর ১২ মার্চ ভারত তার সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ ভারতের সুমহান আত্মত্যাগকে তাচ্ছিল্য করে আজও যারা ‘দেশ বিক্রির’ কথা বলে; বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সঠিকভাবেই তাদের চিহ্নিত করেন ‘অর্বাচীন’ হিসেবে।
২০১৯’র ১৭ এপ্রিল ৪৮তম মুজিবনগর দিবসে আমাদের প্রত্যাশা- যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক বাংলাদেশকে স্বাধীন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সেই পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলে দেশের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত হবে।
লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
এসএ/