কে এই সিরাজ?
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৭:০২ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে শ্লীলতাহানির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলা। পরে সেই মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদে রিমান্ডেও নেয়া হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় এই অধ্যক্ষ ও তার সহযোগিদের নির্মম হত্যাকান্ডের স্বীকার হন নুসরাত। চরম পাশবিকতার বলি হয়ে নুসরাত দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেও কারাগারে বেচে আছেন সেই সিরাজ।
যাকে নিয়ে আজ জনমনে হাজারো প্রশ্ন। একজন শিক্ষক হয়ে এমন ঝঘন্য কাজে লিপ্ত এই সিরাজ আসলে কে? কি ছিল তার পূর্ব পরিচয়। আরও কত মেয়ে শিক্ষকতার মুখোশধারী এই পাষন্ডের নির্মমতায় স্বীকার হয়েছেন?
জানা গেছে, অভিযুক্ত অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলা একজন জামায়াত নেতা (রুকন)। তবে নিজের সুরক্ষা নিশ্চিতে ২০০১ সাল থেকেই ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সুসম্পর্ক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি ম্যানেজিং কমিটিতে সোনাগাজী পৌর বিএনপির সভাপতি আলাউদ্দিন এবং তার সহযোগী জামায়াত নেতা ও পৌর জামায়াতের সাবেক সভাপতি আবদুল মান্নানকে সদস্য করেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সে বিপাকে পড়ে যায়।
পরে ২০১২ সালে আলাউদ্দিন ও আবদুল মান্নানকে বাদ দিয়ে ম্যানেজিং কমিটিতে সদস্য করেন আওয়ামী লীগের উপজেলা সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আবদুল হালিম মামুনকে। জামায়াত নেতা আবদুল মান্নানকে ম্যানেজিং কমিটি থেকে সরিয়ে দেয়ার কারণে ব্যাপক ক্ষুব্ধ হন জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা।
তখন শেখ মামুনকে হাতে রেখে অন্যদের ঘায়েল করতে ব্যাপক তৎপর হয়ে ওঠেন অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা। ২০১৫ সালে মাদ্রাসার অর্থনৈতিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য শুরু হয় মামুনের। পরে অধ্যক্ষ তার দলে টেনে নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে।
২০১৮ সালে রুহুল আমিনকে মাদ্রাসা ম্যানেজিং কমিটির সহ-সভাপতি ও তার সহযোগী পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমকে ম্যানেজিং কমিটির সদস্যপদ থেকে সরিয়ে দিয়ে রুহুল আমিনকে সদস্য করেন।
আর এভাবেই কৌশলে প্রভাবশালীদের কব্জা করে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলা শিক্ষার্থীদের বছরের পর বছর যৌন হয়রানিসহ নানা অপকর্ম করে পার পেয়ে গেছেন।
এই অধ্যক্ষ নিজে টিকে থাকতে এবং লুটপাট করতে সব সময় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে অপকর্ম চালিয়ে যেতেন।
ফেনী জেলা জামায়াতের আমীর মো. সামছুদ্দিন বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে গণমাধ্যমকে বলেন, অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ দৌলাকে বিভিন্ন অপকর্মের জন্য ২০১৬ সালে জামায়াত থেকে বহিস্কার করা হয়েছে, তিনি বর্তমানে আমাদের কোনো সদস্য নন।
প্রসঙ্গত, গত (৬ এপ্রিল ২০১৯) ৯টার দিকে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে মাদরাসা কেন্দ্রে যায় নুসরাত। পরীক্ষার হলে প্রবেশের কিছুক্ষণ পর তার চার জন সহপাঠী তাকে ডেকে তিনতলা মাদরাসার ছাদে নিয়ে যায়। ওই চার জন সহপাঠী বোরকা ছাড়াও হাত মোজা পরিহিত ছিল। এছাড়া তাদের মুখমন্ডল ঢাকা ছিল। শুধু দুই চোখ অনাবৃত ছিল। তারা দাহ্য পদার্থ ছুড়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। নুসরাত বাঁচার জন্য চিত্কার করলে শিক্ষক ও পরীক্ষার্থী এবং স্থানীয় লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে শরীরের আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, পরে ফেনী আধুনিক সদর হাসপাতালে প্রেরণ করলে উন্নত চিকিত্সার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দগ্ধ নুসরাতকে ভর্তি করার পর ওই ছাত্রীর একটি অডিও রেকর্ড সাংবাদিকদের হাতে এসেছে। রেকর্ডে ওই ছাত্রী বলেন, সকালে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে যান তিনি। মাদরাসায় পৌঁছলে এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারছে বলে ডেকে নেয়। সেখানে আরও চার-পাঁচজন মুখোশধারী ছাত্রী ছিলেন। তারা বলেন, প্রিন্সিপালের উপর যে অভিযোগ করেছিস তা মিথ্যা, বল। আমি বলি না, আমি যা বলেছি সব সত্যি। তারা বলে, তোকে এখনই মেরে ফেলবো। আমরা তোর সব খবর নিছি। তোর প্রেম সম্পর্কিত সব তথ্য আমাদের কাছে আছে। আমি বলি, আমি সব সত্য বলেছি। আমি শিক্ষকদের সম্মান করি, কিন্তু যে শিক্ষক আমার গায়ে হাত দিছে আমি তার প্রতিবাদ করেছি। সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার হাত-পা চেপে ধরে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এর আগে গত ২৭ মার্চ ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা নুসরাতকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এই ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। এই মামলায় পুলিশ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেপ্তার করে। অধ্যক্ষ এখন কারাগারে আছেন। ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। আরেকটি অংশ অধ্যক্ষের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন।
এঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৪/৫ জনকে আসামি করে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা (নম্বর ১০) দায়ের করেন।
আরকে//