ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পানি ফোটাতে ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস অপচয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:০৪ পিএম, ১৭ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার

ঢাকা ওয়াসার পানির নিম্নমানের কারণে ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে পানি পানের উপযোগী করে। এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সেদ্ধ করে পান করে। গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়।

আজ বুধবার ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলে টিআইবি। রাজধানীর ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা ও নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।

টিআইবির গবেষণায় বলা হয়, বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রাহক সেবা কার্যক্রমে গতিশীলতা আনার চেষ্টা করলেও ঢাকা ওয়াসার পানি ও পয়নিষ্কাশন সেবায় এখনো ব্যাপক সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশেষ করে, সার্বিকভাবে পানি ও পয়নিষ্কাশন সেবার নিম্নমানের কারণে এক তৃতীয়াংশেরও বেশি সেবাগ্রহীতার অসন্তুষ্টির প্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে অধিকতর কার্যকর ও সেবাধর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে ১৩ দফা সুপারিশ দিয়েছে টিআইবি।

গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক শহিদুল ইসলাম ও শাহনূর রহমান। গবেষণার জন্য টিআইবি একটি জরিপ করে। সেবার মান, দুর্নীতি, গ্রাহক সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি, অনিয়ম, সীমাবদ্ধতা, চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।

সার্বিকভাবে ঢাকা ওয়াসার সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায় অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই গবেষণার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসমূহ হলো: ঢাকা ওয়াসা সংশ্লিষ্ট নীতি ও আইন পর্যালোচনা করা; পানি ও পয়নিষ্কাশন সেবা নিশ্চিতকল্পে ঢাকা ওয়াসার প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা, সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত করা; এবং ঢাকা ওয়াসার সেবা সম্পর্কে সেবাগ্রহীতাদের অভিজ্ঞতা ও সন্তুষ্টির মাত্রা নিরূপণ করা। গবেষণাটিতে ঢাকা ওয়াসার আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক নানা সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করার পাশাপাশি পানি সেবা, পয়ঃনিষ্কাশন সেবা, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা ও কার্যকরতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এছাড়া জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনে সুপারিশ করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা যায়, আগের তুলনায় ঢাকা ওয়াসার উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক অর্জন ও উদ্যোগ রয়েছে। যেমন: সিস্টেম লস কমিয়ে আনা; রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি; ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিলের তথ্য জানা এবং মোবাইল ফোন ও ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে বিল পরিশোধ ব্যবস্থার পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবে ডিজিটাল বিলিং সিস্টেম চালু করা; সার্বক্ষণিক অভিযোগ গ্রহণে হটলাইন স্থাপন; কমিউনিটি প্রোগ্রাম ও কনজ্যুমার রিলেশন বিভাগ গঠন; ৮০টি ওয়াটার এটিএম বুথের মাধ্যমে খুচরা পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা; ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে ও জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নানা কার্যক্রম পরিচালনায় এখনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ওয়াসা বোর্ডের কার্যকারিতায়ও ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিতে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি আইনের কার্যকর প্রয়োগেও ঘাটতি লক্ষণীয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার পানির চাহিদা পূরণ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পানি উৎপাদন এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতে সক্ষমতার ঘাটতিও বিদ্যমান।

গবেষণায় দেখা যায়, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পানির উৎপাদন ব্যবস্থায় ঘাটতির কারণে গত ১০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে পাম্পের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৪৮২টি থেকে ৯০০টিতে উত্তীর্ণ হয়েছে।

গবেষণা মতে, চাহিদা অনুযায়ী পানি সরবরাহে ঘাটতি থাকায় সেবাগ্রহীতাদের ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ চাহিদা অনুযায়ী পানি পান না। জরিপে অংশ নেওয়া ২০ দশমিক ৬ শতাংশ সেবাগ্রহীতা সারাবছর এবং ৯৪ শতাংশ সেবাগ্রহীতা গ্রীষ্মকালে পানি ঘাটতির সমস্যার কথা জানিয়েছেন। ওয়াসার পানি সরবরাহ ও বিলিং ব্যবস্থায় ন্যায্যতার ঘাটতি যেমন রয়েছে তেমনি পানির মান নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। সেবাগ্রহীতাদের ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ সরবরাহকৃত পানি অপরিষ্কার এবং ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ সরবরাহকৃত পানি দুর্গন্ধযুক্ত বলে অভিযোগ করেছেন। জরিপে অংশ নেওয়া সেবাগ্রহীতাদের মতে, তাদের পরিবারের ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ সদস্য কোনো না কোনো পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

এছাড়া পানির নিম্নমানের কারণে ৯১ শতাংশ সেবাগ্রহীতা পানি ফুটিয়ে পান করায় ঢাকা মহানগরীর খানাসমূহে (পরিবার) ব্যয়কৃত জ্বালানির প্রাক্কলিত অর্থমূল্য প্রায় ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৬২০ টাকা।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, পয়ঃনিষ্কাশন সেবায় সক্ষমতা ও কার্যকারিতার ঘাটতির কারণে প্রতিদিন ১৩ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার অপরিশোধিত পয়ঃবর্জ্য বিভিন্ন খাল হয়ে পার্শ্ববর্তী নদীগুলোতে পতিত হয়। এতে ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী নদী দূষণে ঢাকা ওয়াসারও দায় থেকে যায়। ১৯৯০ সালের পর ঢাকা ওয়াসা নতুন কোনো পয়ঃলাইন তৈরি করেনি। জরিপে অংশ নেওয়া সেবাগ্রহীতাদের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ পয়নিষ্কাশন সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনেও ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা ও কার্যকারিতায় ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, ঢাকা ওয়াসার নিয়োগ, পদায়ন ও বদলি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণসহ ক্রয় প্রক্রিয়া, প্রকল্প বাস্তবায়ন, মিটার রিডিং নেওয়া এবং সর্বোপরি গ্রাহক সেবায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি বিদ্যমান। জুলাই ২০১৭ থেকে জুন ২০১৮ সময়কালে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সংক্রান্ত সেবা বা সমস্যা নিয়ে ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে যোগাযোগ করা জরিপে অংশগ্রহণকারী ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ সেবাগ্রহীতার ৬১ দশমিক ৯ শতাংশই নানা ধরনের অনিয়ম, হয়রানি ও দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।

টিআইবির গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার বিভিন্ন সেবার বিষয়ে নানা অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তিতে অভিযোগ ও পরামর্শ কেন্দ্রসহ হটলাইন ব্যবস্থা চালু থাকলেও তাতে ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। জরিপে অংশ নেওয়া সেবাগ্রহীতাদের ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ নানা সমস্যার বিষয়ে অভিযোগ করলেও মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ হটলাইনের মাধ্যমে অভিযোগ করেছেন। অভিযোগকারীদের মধ্যে আবার ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ বলেছেন, কর্তৃপক্ষ অভিযোগ নিলেও কোনো সমাধান হয়নি। আর ৬ দশমিক ৯ শতাংশ বলেছেন তাদের অভিযোগ গ্রহণই করা হয়নি। ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে বিল প্রদানসহ ঢাকা ওয়াসার নানাবিধ সেবা কার্যক্রম চালু থাকলেও প্রচারের অভাবে জরিপে অংশ নেওয়া সেবাগ্রহীতাদের ৯৮ শতাংশ সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করেন। সেবাগ্রহীতাদের মধ্যে অনলাইনে বিল জমা ও বিল সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার বিষয়ে জানেন না ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ, অনলাইনে পানি ও পয়সংযোগের আবেদন করার বিষয়ে জানেন না ৬২ দশমিক ৪ শতাংশ, ওয়াসার বোতলজাত পানি সেবা সম্পর্কে জানেন না ৭২ শতাংশ, খুচরা পানি সরবরাহে এটিএম বুথ সম্পর্কে জানেন না ৯১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ওয়াসা লিংক (১৬১৬২) সম্পর্কে জানেন না ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ। সার্বিকভাবে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতাই ওয়াসার সেবার মান ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে অসন্তষ্ট বলে গবেষণায় জানা গেছে। এর মধ্যে পানি সরবরাহ ও প্রাপ্যতা নিয়ে ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ, পানির মান নিয়ে ৪৭ শতাংশ, পয়ঃনিষ্কাশন নিয়ে ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি নিয়ে ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অসন্তুষ্ট।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগ ও ঢাকা ওয়াসার বিবেচনার জন্য ১৩ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সেবার মূল্য নির্ধারণে স্বতন্ত্র রেগুলেটরি কমিশন গঠন করতে হবে; ওয়াসা বোর্ডের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিশ্চিত করতে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বোর্ড গঠন করতে হবে; জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ঢাকা মহানগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা একটি একক কর্তৃপক্ষের নিকট ন্যস্ত করতে হবে; শূন্য পদগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ করতে হবে; ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পানির উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিতে বৃষ্টির পানি ধারণ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে; ঢাকা ওয়াসার কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতিরোধে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রণোদনার ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং অসাধু কর্মচারীদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে; সেবার মান যাচাই ও উন্নতিকল্পে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেবার মান মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে, যা নিয়মিত গণশুনানির মাধ্যমে করা যেতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উদ্বেগের বিষয় হলো, ওয়াসা তার ভিশন-মিশন অনুযায়ী এখনো পানির চাহিদা পূরণে সুপেয়, নিরাপদ, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পানির উৎপাদন ও সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সন্তোষজনক অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। আমরা মনে করি, আমাদের এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে ঢাকা ওয়াসার সুশাসন ও শুদ্ধাচারের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হবে।

অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, যে সুপারিশগুলো করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি সেগুলো কার্যকর করতে পারে তাহলে সমস্যাগুলি সমাধানের একটা উপায় বের হয়ে আসবে।

আরকে//