একবিংশ শতাব্দীর যমদূত সুপারবাগ!
মুনীরউদ্দিন আহমদ :
প্রকাশিত : ০৯:০৩ এএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৯ বৃহস্পতিবার
অতিসম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র বা আইসিইউতে মারা যাওয়া রোগীদের ৮০ শতাংশের মৃত্যুর কারণ হলো সুপারবাগ।
টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউর চিকিৎসক ড. সায়েদুর রহমানের মতে, ২০১৮ সালে বিএসএমএমইউর আইসিইউতে ভর্তি হওয়া আনুমানিক ৯০০ রোগীর মধ্যে ৪০০ জনই মারা গেছে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে। দ্য টেলিগ্রাফের এই প্রতিবেদনটি গত সোমবার অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ সালে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব সায়েন্টিফিক রিসার্চের এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ওই জরিপে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি রোগীদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেছে।
গত ৫ এপ্রিল কালের কণ্ঠে ‘অকেজো ওষুধ অজেয় জীবাণু’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এবং করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এবং করণীয় নিয়ে আমি অতীতে অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছি। তবে লেখাই সার হয়েছে, কাজের কাজ তেমন কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না। মনে হয় আমরা জেনে-বুঝেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছি। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু আমার, আপনার ও কারোই বিষয়টি উপলব্ধিতে আসছে না।
কয়েক দিন আগে এক নামকরা হাসপাতালের জীবাণু কালচারের একটি রিপোর্ট আমার হাতে এসেছিল। এক বছরের এক শিশুর ঘায়ের পুঁজ কালচার করে ই. কোলাইয়ের উপস্থিতি পাওয়া যায়। জীবাণু কালচার করে দেখা গেছে, ই. কোলাইয়ের বিরুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। এসব অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে রয়েছে—অ্যামোক্সিসিলিন, সেপ্টাজিডিম, জেন্টামাইসিন, কোট্রাইমোক্সাজল, অ্যামিকাসিন, ন্যালিডিক্সিক অ্যাসিড, সেফুরক্সিম, সেফোটেক্সামিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যাজেট্রোনাম, নেটিলমাইসিন ও সেফট্রিয়াক্সন। শুধু একটি মাত্র অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে; আর তা হলো মেরোপেনেম। আমি রিপোর্টটি দেখে হতভম্ব হয়ে গেছি। ১৩টি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে শুধু একটি অ্যান্টিবায়োটিক ই. কোলাই জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর, আর বাকি ১২টিই রেজিস্ট্যান্ট। এই রিপোর্ট যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা সমূহ বিপদে আছি, যে বিপদের ভয়াবহতা আমাদের কল্পনাশক্তির বাইরে।
১৯৪২ সালের ১৪ মার্চ স্টেফাইলোকক্কাস প্রজাতির জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত প্রথম রোগীর সফল চিকিৎসা হয় মার্ক কম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত পেনিসিলিন দ্বারা। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং কর্তৃক আবিষ্কৃত পেনিসিলিন হলো প্রথম সফল ও কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক, যা দ্বারা বিশ্বের লাখো-কোটি মানুষের চিকিৎসা দেওয়া হয়। পেনিসিলিন-পরবর্তী যুগে আমরা বিভিন্ন গ্রুপের অসংখ্য কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছি, যা হরেক রকম জীবাণু নাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তারপর শুরু হলো আসল বিপর্যয়। এর প্রধান কারণ হলো মেথিসিলিন রেজিস্ট্যান্ট স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস (MRSA) নামক জীবাণুর প্রাদুর্ভাব, যার বিরুদ্ধে পেনিসিলিন গ্রুপের সবচেয়ে কার্যকর ও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক মেথিসিলিনের অকার্যকারিতা। মেথিসিলিন রেজিস্ট্যান্ট স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সংক্রামক রোগ ও অ্যান্টিবায়োটিক যুগের এক মহাবিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়ে গেল। ২০১৩ সালে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ১৮টি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর তালিকা প্রকাশ করে, যা মানবসভ্যতার জন্য এক মহাহুমকি ও অশনিসংকেতের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
নতুন নতুন সংক্রামক রোগের উৎপত্তি, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের সূত্রপাত ও ছড়িয়ে পড়া নিয়ে এত লেখালেখি ও সতর্কতা জারির পরও বিশ্বের মানুষ ব্যাপারটির ভয়াবহতা বুঝতে পারছে না এবং গুরুত্বসহকারে নিচ্ছে না। এ ধরনের অজ্ঞতা, স্বেচ্ছাচারিতা, অবহেলা, অসতর্কতা ও যুক্তিহীন আচরণ আমাদের জন্য আরো বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করছে। এই অদ্ভুত আচরণের সম্ভাব্য কারণ নিহিত রয়েছে মানুষের মনোস্তাত্ত্বিক আচরণে। মানুষ মনে করে, ব্যথা, বেদনা, ডায়রিয়া, আমাশয়, অ্যান্টাসিড, হৃদরোগ বা স্ট্রোকের ওষুধের মতো অ্যান্টিবায়োটিকও এক ধরনের ওষুধ। সুতরাং অ্যান্টিবায়োটিক কোন দিক থেকে আলাদা যে তাকে নিয়ে সংযত, সতর্ক ও যুক্তিসংগত আচরণ করতে হবে। কিন্তু এই তুলনার মধ্যে বিরাট একটি গলদ থেকে যাচ্ছে, যা কারো নজরে পড়ছে না। অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া অন্য সব ওষুধ কাজ করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও সিস্টেমের ওপর। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে শরীর আক্রমণকারী বহিরাগত মারণঘাতী বিভিন্ন জীবাণুর বিরুদ্ধে। জীবাণু যদি শরীর আক্রমণ করে, তবে শরীরকে অবশ্যই সব জীবাণু ধ্বংস করতে হবে। নতুবা জীবাণু শরীরকে ধ্বংস করে মৃত্যু ডেকে আনবে। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা জীবাণু বিনাশে সক্ষম না হলে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের মাধ্যমে জীবাণু ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় যুগ যুগ ধরে অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সংক্রামক রোগের চিকিৎসা চলে আসছিল। কিন্তু আমরা অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী ও বেপরোয়া হয়ে অযৌক্তিকভাবে ক্ষুদ্র জীবাণুর অলৌকিক ক্ষমতাকে খাটো করে দেখা শুরু করি। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, সেই প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার ও প্রয়োগের পর থেকেই জীবাণু স্মার্ট হতে শুরু করে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। তারই ফলে আমরা পেলাম অ্যাটম বোমাসম অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু, যাকে সুপারবাগও বলা হয়।
পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিশ্বব্যাপী জ্ঞানী-গুণী, গবেষক ও বিজ্ঞানীরা অসীম ক্ষমতাধর, অপ্রতিরোধ্য ক্ষুদ্র অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু বা সুপারবাগের আতঙ্কে আতঙ্কিত, ছোট-বড় সংক্রামক রোগ চিকিৎসার ব্যর্থতার ভয়ে অসহায় ও আতঙ্কিত। অ্যান্টিবায়োটিকের সূত্রপাত থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যত অ্যান্টিবায়োটিক এসেছে তার বেশির ভাগকে অকার্যকর করে দিয়েছে এই সুপারবাগ। গনোরিয়াসহ কিছু সাধারণ সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় একসময় পেনিসিলিন অত্যন্ত কার্যকর ওষুধ ছিল। পেনিসিলিন যখন অকার্যকর হয়ে গেল, তখন বাজারে এলো সাড়াজাগানো টেট্রাসাইক্লিন। টেট্রাসাইক্লিন অকার্যকর হতেও বেশি সময় লাগল না। তারপর এলো ক্লোরোকুইনোলন গ্রুপের সিপ্রোফ্লক্সাসিন, নালিডিক্সিক অ্যাসিড, ল্যাভোফ্লক্সাসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক। দোর্দণ্ড প্রতাপে জীবাণুকে পরাস্ত করল বেশ কয়েক বছর ধরে এই ডাকসাইটে অ্যান্টিবায়োটিক। জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারিয়ে একসময় এই ক্ষমতাধর ওষুধেরও অপমৃত্যু ঘটল। একসময় ভীষণ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করলেও এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সেফালোস্পোরিন গ্রুপের বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক। এখন কিছু কিছু জীবাণুকে পরাস্ত ও ধ্বংস করা সম্ভব হচ্ছে সেফট্রিয়াক্সন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিন কম্বিনেশন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে। তাও কত দিন কার্যকর থাকবে বলা মুশকিল। এখন রিকশাওয়ালা-হকারের মতো অতিসাধারণ মানুষও জিম্যাক্সের (অ্যাজিথ্রোমাইসিন) নাম জানে, ব্যবহার করে, অন্যকে ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়। আমি তাজ্জব হয়ে যাই। কার্বাপেনেমকে এত দিন একমাত্র নন-রেজিস্ট্যান্ট শতভাগ কার্যকর শেষ অবলম্বন অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে গণ্য করা হতো। এখন জীবন বিপন্নকারী অন্ত্রের জীবাণু ক্লেবসিলা নিউমোনি কার্বাপেনেমের কার্যকারিতাকে ব্যর্থ করে দিয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তার পর? তারপর আপাতত আমাদের থলেতে আর অবশিষ্ট বিশেষ কিছু রইল না।
এটা তো হওয়ারই ছিল। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং জীবাণুর বিরুদ্ধে পেনিসিলিনের নাটকীয় কার্যকারিতার পাশাপাশি মানবসভ্যতাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন, সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যখন একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারাবে, এক অসম যুদ্ধে মানুষ পরাজিত হবে এবং মৃত্যুবরণ করবে। গোল্ডম্যান স্যাকসের সাবেক অর্থনীতিবিদ জিম ও নিল ও তাঁর সহকর্মী কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, প্যারাসাইট ও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু সংক্রমণে প্রতিবছর আট লাখ মানুষ মারা যায়। এই প্রবণতা বজায় থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর এক কোটি মানুষ মারা যাবে এবং বিশ্বের মোট জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশ অর্থ এই সমস্যা মোকাবেলায় ব্যয় করতে হবে। এখনই যুক্তরাষ্ট্রকে এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট সংক্রামক রোগ চিকিৎসায় প্রতিবছর ২০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার নয় বলে এই সমস্যাকে আমরা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারছি না। অ্যান্টিবায়োটিক মূলত জীবাণুর কোষপ্রাচীর সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করে এবং জীবাণুর বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় প্রোটিন সংশ্লেষণ বন্ধ করে দেয়। ফলে জীবাণু মারা যায়। অন্যদিকে স্মার্ট জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ধ্বংস করার জন্য বেশ কিছু বিধ্বংসী পন্থা অবলম্বন করে। প্রথমত, জীবাণুর বিশেষ কোনো এনজাইম অ্যান্টিবায়োটিকের গাঠনিক সংকেতে এমন কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, যার কারণে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, অনেক সময় জীবাণু এমন সব এনজাইম তৈরি করে যা অ্যান্টিবায়োটিকের গাঠনিক সংকেতকে ভেঙে দিতে সক্ষম। গাঠনিক সংকেত ভেঙে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, কোনো কোনো জীবাণু আছে, যেগুলো জন্মগতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল নয়। যেমন—গ্রাম-নেগেটিভ জীবাণুগুলোর কোষপ্রাচীর এমন জটিলভাবে তৈরি, যার বিরুদ্ধে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়। চতুর্থত, জেনেটিক মিউটেশনের (জিনের রাসায়নিক পরিবর্তন) মাধ্যমে অনেক জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। কোটি কোটি জীবাণুর মধ্যে যেকোনো একটি জীবাণু যদি মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে যায়, সেই জীবাণু পরবর্তী সময়ে বংশ বৃদ্ধি ও বিস্তারের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এসব জীবাণু পরিবর্তিত জিনকে অন্য জীবাণুতে স্থানান্তর করার মাধ্যমে রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর ব্যাপক বিস্তার ঘটায়। এসব জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত কোনো রোগী তখন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সংক্রমণমুক্ত হয়ে আরোগ্য লাভ করে না। ফলে রোগী অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে।
অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ও অযৌক্তিক ব্যবহারের জন্য অনুন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে মূলত বেশি দায়ী করা হয়। কারণ এসব দেশে মানুষ প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টেবায়োটিক কিনতে ও ব্যবহার করতে পারে। তাই অপব্যবহার হয় বেশি। কিন্তু উন্নত দেশগুলোও অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহার ও অযৌক্তিক ব্যবহারে কম যায় না। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর শ্বাসনালির সংক্রমণে চার কোটি মানুষকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালে জার্নাল অব দ্য অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল কেমোথেরাপিতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, চার কোটির মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষকে অপ্রয়োজনেই অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহীতার বেশির ভাগই হয় মূলত ভাইরাস সংক্রমণের শিকার। এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে অ্যান্টিবায়োটিক ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর নয়। এভাবে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্সের অন্যতম কারণ। সাধারণত হাসপাতালগুলোতে সংক্রামক রোগের উৎপত্তি ও বিস্তারলাভ ঘটে বেশি। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিহত করতে হলে হাসপাতালে সংক্রামক রোগের উৎপত্তি ও বিস্তার বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের মধ্যে আরো একটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। অসংখ্য মানুষ মনে করে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়, জীবাণু নয়। জীবাণু রেজিস্ট্যান্ট হওয়ার ভয় থাকলে মানুষ ওষুধের পূর্ণ কোর্স সমাপ্ত করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিত। জীবাণুর পূর্ণ কোর্স সমাপ্ত না করলে জীবাণুর বেঁচে যাওয়া অবশিষ্টাংশ আবার দ্রুত বংশবিস্তারের মাধ্যমে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার ব্যাপারটি যদি আমরা বুঝতে পারতাম, তাহলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্ক না হয়ে পারতাম না।
নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে ওষুধ কমপানিগুলোর অনীহার কারণ নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করে একটি অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবন করে বেশি মুনাফা করা যায় না। কম্পানিগুলোর মতে, মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে অল্প কয়েক দিনের জন্য। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের ক্ষেত্রে যেমন রোগীকে আজীবন ওষুধ গ্রহণ করতে হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে তেমন ঘটে না। দ্বিতীয়ত, একটি অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হওয়ার পর যদি অল্প কয়েক বছরে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়, তাহলে ওষুধ কম্পানির পুঁজিও উঠে আসে না, মুনাফা তো পরের কথা। এ ছাড়া উদ্ভাবনের পর কোনো অ্যান্টিবায়োটিকের অ্যাপ্রোভাল পেতে কম্পানিগুলোকে অনেক ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে অ্যাপ্রোভাল পাওয়াও যায় না। এসব কারণে ওষুধ কম্পানিগুলো অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে পুঁজি বিনিয়োগে আজকাল আর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোগী, জয়ী হচ্ছে রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এ হলো সত্যিকার অর্থে অশনিসংকেত। তবে ওষুধ কম্পানির মালিকরা কি জানে, কোনো না কোনো সময় তারাও রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার শিকার হতে পারে। তাই নতুন নতুন কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও ওষুধ কম্পানিগুলোকে সময় থাকতে এগিয়ে আসতেই হবে।
দুর্ভাগ্য আমাদের। আমরা অনেক সময়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করি না। আর যখন করি, তখন আর ফিরে আসা বা ফিরে যাওয়ার সময় থাকে না। আর সেই কারণে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ করার জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি সরকার, প্রতিটি চিকিৎসক, রোগী, মানুষ, স্বাস্থ্যকর্মী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে বারবার। কারণ এই মহাবিপর্যয় সৃষ্টিকারী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ঠেকানো না গেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানবসভ্যতাকে চরম মূল্য দিতে হবে।
লেখক : প্রফেসর, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্য্যলয়।
এসএ/