ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

একশো বছর আগে যেভাবে শুরু হয়েছিলো জব্বারের বলীখেলা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:০১ এএম, ২৫ এপ্রিল ২০১৯ বৃহস্পতিবার

এবার একশ’ দশ বছর হচ্ছে ‘জব্বারের বলীখেলা’ নামের চট্টগ্রামের বিখ্যাত কুস্তি প্রতিযোগিতাটির। প্রতি বছর মূলত এই সময়েই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে এর আয়োজন হয়।

বলী খেলাকে ঘিরে থাকে বৈশাখী মেলার আয়োজন। গতকাল বুধবার বিকেল চারটার দিকে এই আয়োজনের উদ্বোধন হয়। তিনদিন ধরে চলবে মেলা। তবে মূল কুস্তি প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার থেকে।

যেভাবে শুরু হয়েছিলো এই কুস্তি প্রতিযোগিতা

বলী খেলা মানে কুস্তি প্রতিযোগিতা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তিকে বলী খেলা নামে ডাকা হয়। ১৯০৯ সালে প্রথম এই প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন চট্টগ্রামের জমিদার আব্দুল জব্বার সওদাগর। নামই বলে দেয় স্থানীয় প্রভাবশালী এবং একজন ধনী ব্যক্তি ছিলেন তিনি।

এই বলীখেলার উপর গবেষণা করেছেন চিটাগাং সেন্টার ফর অ্যাডভ্যান্স স্টাডিজের সদস্য সচিব ড. শামসুল হোসাইন।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘সে সময় যখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চলছিলো- রাজনৈতিক একটা আইডিয়া এটার পেছনে এসে তখন দাঁড়িয়ে যায়। তখন তরুণ প্রজন্মকে শারীরিকভাবে সমর্থ করার ধারণা থেকে এই প্রতিযোগিতা প্রথম চালু করেন জব্বার সওদাগর।

‘উদ্দেশ্য ছিল, তারা যেন আন্দোলনে অংশ নিতে পারেন তার জন্য শারীরিকভাবে তাদের প্রস্তুত করা।’

ড. শামসুল হোসাইন বলছিলেন, ‘এর মধ্যে আরেকটি বিষয় ছিল মুসলিম তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। সেই সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের হিন্দুদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল।‘

তিনি আরও বলেন, ‘কুস্তি এই অঞ্চলের অত্যন্ত প্রাচীন সাংস্কৃতিক উপকরণ। মধ্যযুগে সেনাবাহিনীতে যারা চাকরি নিতো তাদের শারীরিক সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য তারা কুস্তি করতেন। সেখান থেকেই এর শুরু।’

আব্দুল জব্বার সওদাগর নিজের নামেই এই বলীখেলার নামকরণ করেছেন। সেখান থেকেই এর নাম জব্বারের বলীখেলা।

স্মৃতিচারণ জব্বার সওদাগরের নাতির

আব্দুল জব্বার সওদাগরের ছেলের ঘরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদলের জন্ম ১৯৫৫ সালে। এই প্রতিযোগিতার শুরুটা না দেখলেও তার বাবার মুখে শুরুর দিককার অনেক গল্প তিনি শুনেছেন।

বিবিসি তিনি বলেন, ‘আমার দাদার মৃত্যুর পর আমার বাবা এর দায়িত্ব নেন। তিনিই এটার আয়োজন করতেন। আমরা যখন দেখেছি, তখন এই প্রতিযোগিতা এতটা প্রসারিত ছিল না। এটি শুধু লালদিঘী এলাকার বলীদের জন্যই আয়োজন করা হতো।’

তিনি সেই সময়কার পরিবেশ বর্ণনা করে বলছিলেন, ‘সে সময় এলাকায় ঢোল বাজত, সঙ্গে থাকতো কুস্তিগীরেরা। আমরা ঢোলের পিছে পিছে ঘুরতাম। এভাবে তারা এসে মাঠে ঢুকত। আমি তখন স্কুলে পড়ি।’

তিনি জানান, তিনি তার বাবার মুখে শুনেছেন খেলাটা কিছুটা প্রচলন হওয়ার পর বলীরা সেই সময় মাস দু’য়েক আগে এসে জড়ো হতেন।

তাদের বাড়িতেই বড় একটা বৈঠকখানা ছিল। সেই ঘরেই থাকতেন। সেখানেই তারা খাওয়াদাওয়া করতেন এবং দিনভর নানা শারীরিক কসরত ও অনুশীলন করতেন, প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতেন।

আনোয়ার ঠিক সময়টা সেভাবে মনে করতে পারেন না ঠিক কবে তার বাবার হাতে এই আয়োজনের দায়িত্ব বর্তায়।

তবে তিনি বাবার মৃত্যুর পর ১৯৮৬ সাল থেকে এই আয়োজনের নানা খুঁটিনাটি বিষয়ের সঙ্গে আরও সরাসরি জড়িয়ে গেছেন।

সারা দেশের বলীরা যেভাবে যোগ দিলেন

শওকত আনোয়ার জানান, ধীরে ধীরে চট্টগ্রামের নানা এলাকার বলী বা কুস্তিগীরেরা এই প্রতিযোগিতায় আসতে শুরু করেন।

আনোয়ার বলেন, ‘আমি যখন লেখাপড়া করি তখন দেখতাম চট্টগ্রামের আশপাশের জেলা - নোয়াখালী, কুমিল্লা এ সব জায়গা থেকেও বলীরা আসতে শুরু করলো। এরপর সারা দেশ থেকে আসতে শুরু করে। এমনকি একবার আমার মনে আছে, ফ্রান্স থেকে দুজন কুস্তিগীর এখানে অংশগ্রহণ করেছিলো।’ সত্তরের দশক থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশের বলীরা আসছেন বলে জানান আনোয়ার।

তিনি বলছেন, এটার যখন প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচার শুরু হয় তখনই এর সম্পর্কে সবাই আরও ভালোভাবে জানতে পারেন। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই প্রথম এর সম্প্রচার করেছিলো।

এরপর এখন সব টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করছে আর গণমাধ্যমের আগ্রহের কারণে জব্বারের বলীখেলা সম্পর্কে আরও প্রচার হয়েছে, জানান আনোয়ার।

এখন যেভাবে হয় এই প্রতিযোগিতা

জব্বারের বলীখেলার বর্তমান চ্যাম্পিয়ন চকোরিয়ার জীবন বলী। তবে এই প্রতিযোগিতার সবচাইতে বেশি পরিচিত নাম কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার দিদারুল আলম বা দিদার বলী, যিনি সব মিলিয়ে সাতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। তিনি অবশ্য বছর দু’য়েক আগে অবসরে গেছেন।

জব্বারের বলীখেলা আয়োজন কমিটির সভাপতি জওহরলাল হাজারী। তিনি জানান, এখনও পর্যন্ত এবারের বলী খেলায় ৬০ জন কুস্তিগীর অংশগ্রহণের জন্য নাম লিখিয়েছেন। তবে সংখ্যাটা আরও বড় হবে। সাধারণত দেড়শ’ জনের মতো কুস্তিগীর এখানে আসেন।

তিনি আরও বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে যত কুস্তিগীর আছেন, যাদের প্রতিভা বিকশিত হওয়ার কোন পন্থা নেই, তাদের এখানে আসতে সহযোগিতা করা হয়। তাদের এই প্রতিযোগিতায় কসরত প্রদর্শন করার সুযোগ দেয়া হয়।’

এখানে পাঁচটি ধাপে প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। প্রথম বাছাইয়ের পরের রাউন্ড পর্বে ৫০ জনকে নিয়ে খেলা হয়। সেখান থেকে ২৫ জন যায় মূল চ্যাম্পিয়ন পর্বে।

এখানে কোন পয়েন্ট ব্যবস্থা নেই। কুস্তি করতে করতে মাটিতে যার পিঠ যে ঠেসে ধরতে পারবে সে-ই বিজয়ী হবে।

এছাড়া বলী খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা চলে। দুর-দূরান্ত থেকে আসা বিক্রেতারা গ্রামীণ নানা সামগ্রী নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন। সেটিও মেলার অন্যতম আকর্ষণ।

জওহরলাল হাজারী আরও বলেন, চট্টগ্রামের বলী খেলাকে আরও প্রসারের চিন্তা করা হচ্ছে। সে রকম সরকারি আশ্বাস রয়েছে। শহরের স্টেডিয়ামের পাশে প্রশিক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রে স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

সূত্র: বিবিসি

একে//