ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

হৃদরোগ প্রতিরোধে প্রয়োজন সুস্থ জীবনধারা

জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক

প্রকাশিত : ০১:২৬ পিএম, ২৬ এপ্রিল ২০১৯ শুক্রবার

মানুষ সৃষ্টির সেরা। মানুষের জন্মরহস্যও বেশ সূক্ষ্ম আর জটিল। মায়ের গর্ভে যে ভ্রূণ থাকে, তা প্রথমে থাকে একটি কোষ, তারপর সেটি বিভক্ত হয়ে একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি, এভাবে কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠে। হৃৎপিন্ড গড়ে ওঠে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসে। একসময় পূর্ণাঙ্গ মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয়। সে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে।

মানবদেহ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেবল কিছু বস্ত্ত নয়, শরীরের প্রত্যেক কোষেই রয়েছে একটি চেতনা এবং প্রতিনিয়ত এতে ভাঙা-গড়া চলছে। আর এভাবেই হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, পাকস্থলী, কিডনি, লিভার প্রত্যেকেই সুশৃঙ্খল ও সমন্বিতভাবে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। সে কারণেই সম্ভব হচ্ছে আমাদের সুস্থ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা।

বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে সংক্রামক ব্যাধির পরিমাণ কমে যাওয়ার সাথে সাথে অসংক্রামক ব্যাধি, বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার মারাত্মক স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৫৩ ভাগ মৃত্যুর কারণ হলো এসব অসংক্রামক ব্যাধি, যার অন্যতম হচ্ছে করোনারি হৃদরোগ এবং এটি শতকরা প্রায় ২৭ ভাগ মৃত্যুর কারণ।

গত ২০ বছরে বাংলাদেশে হৃদরোগে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে শতকরা ২০-২৫ জন উচ্চ রক্তচাপে এবং শতকরা ১০ জন করোনারি হৃদরোগে ভুগছেন।

মাতৃগর্ভ থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যে অঙ্গটি নিরলস কাজ করে আমাদের কর্মক্ষম রাখে তা হলো আমাদের হৃৎপিন্ড। আমরা জানি, রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টি আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে, এমনকি প্রতিটি কোষে পৌঁছে যায়। আবার, হৃৎপিন্ডে প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছে দিতে রয়েছে করোনারি আর্টারি।

আমরা যখন ক্রমাগত ভুল খাদ্যাভ্যাস ও ভ্রান্ত জীবনাচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি তখন এই করোনারি আর্টারিতে কোলেস্টেরল জমে জমে রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে হৃৎপিন্ডে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হয়। একসময় বুকে ব্যথা অনুভূত হয়, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয় এনজাইনা। এরই পরিণতিতে দেখা দিতে পারে হার্ট অ্যাটাক (Myocardial Infarction)।

ছোটবেলা থেকেই রক্তনালীতে কোলেস্টেরল জমা শুরু হয় এবং একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর উপসর্গ দেখা দেয়। করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলো হলো-ধূমপান, ভুল খাদ্যাভ্যাস, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস, রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য, অতিরিক্ত ওজন, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব এবং মানসিক চাপ ইত্যাদি।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে হৃদরোগ এবং স্ট্রোক অন্যতম ঘাতক ব্যাধি এবং অকাল মৃত্যুর জন্যে দায়ী। বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটি ৭৩ লাখ মানুষ এ রোগে মারা যায় এবং এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে দুই কোটি ৩০ লাখ মৃত্যু ঘটবে শুধু হৃদরোগেই। এটি সত্যিই খুব দুঃখজনক। কারণ, হৃদরোগসহ এ ধরনের ভুল জীবনাচারজনিত অসুখে যারা মারা যায় তাদের অধিকাংশেরই বয়স থাকে ৪০ থেকে ৬০-এর মধ্যে। আর এ সময়টি হলো জীবনের সুন্দরতম একটি সময়, যখন তারা পরিবার, সমাজ এবং জাতির জন্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখতে পারতেন।

হৃদরোগ একবার হয়ে গেলে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা জটিল এবং চিকিৎসাও বেশ ব্যয়বহুল। এজন্যে প্রথম থেকেই প্রতিরোধের দিকে জোর দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ডা. ডিন অরনিশ প্রমাণ করেছেন যে, সুস্থ জীবনযাপন, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রম ও ব্যায়াম, মেডিটেশন বা ধ্যানের মাধ্যমে অনেক হৃদরোগী অপারেশন বা এনজিওপ্লাস্টি ছাড়া সুস্থ রয়েছেন। আর আমাদের মনে রাখা উচিত যে, অপারেশন বা এনজিওপ্লাস্টি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। সুস্থ থাকতে চাইলে সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত জীবনযাপনের কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে আবারও হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে রোগ প্রতিরোধ এবং নিরাময়ের এক অসাধারণ ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ডাক্তার এবং ওষুধ এখানে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। দেহ এবং আত্মা-এ দুয়ের সমন্বয়ে একজন মানুষ। দেহ বস্ত্ত জগতের, এটি স্থান-কালে সীমাবদ্ধ; আর আত্মা অপার্থিব জগতের, যা মুক্ত, বন্ধনহীন এবং স্থান-কালে সীমাবদ্ধ নয়। এই আত্মা ভালো থাকলে মানুষের শরীরও ভালো থাকে। তাই প্রয়োজন স্রষ্টার প্রতি মানুষের পরিপূর্ণ ঈমান বা বিশ্বাস, প্রকৃত জ্ঞান অর্জন এবং সবসময় সৎ কর্ম করা।

সুখ-শান্তি চাইলে এটি অর্জনের উপায়ও জানতে হবে। শুধু পার্থিব সম্পদ সব সুখ-শান্তি দিতে পারে না। এজন্যে শরীর এবং আত্মাকেও সুস্থ রাখতে হবে। শরীর সুস্থ রাখতে হলে সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে। আত্মার সুস্থতার জন্যে তাই স্রষ্টায় বিশ্বাসের পাশাপাশি পরিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী হতে হবে। ধর্মের মূল শিক্ষার অনুশীলন, নিয়মিত প্রার্থনা ও মেডিটেশন করলে আত্মায় প্রশান্তি আসে। এগুলো রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে চমৎকার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

মানুষের মন তার অতীতের সুখ-দুঃখ কিংবা ভবিষ্যতের চিন্তা-আশঙ্কা নিয়ে সবসময় অস্থির থাকে। এই অস্থির মনকে স্থিরতা, শান্তি ও কল্যাণের পথে আনতে হলে মেডিটেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। চঞ্চল মনকে শান্ত ও সংযত করে তুলতে পারলে বিশ্বব্রহ্মান্ড নিয়ন্ত্রণকারী মহাচেতনার সাথে যোগাযোগ সম্ভব। সত্যে পৌঁছার জন্যেও মনকে শান্ত করা চাই। এজন্যেই মেডিটেশন।

মেডিটেশন আমাদের মনকে শান্ত করে, বর্তমানে নিয়ে আসে, নিজের প্রতি মনোযোগ দিতে শেখায়। টেনশন ও চাপমুক্তি তখন সহজ হয়। এর পাশাপাশি জীবনধারা পরিবর্তন এবং জীবনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করাও অত্যন্ত জরুরি। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এ বিষয়গুলোর প্রতি মানুষকে সচেতন করে তুলছে, কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাবের মতো একটি সময়োপযোগী উদ্যোগের মাধ্যমে হৃদরোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ে কাজ করে যাচ্ছে। সেজন্যে আমি তাদের ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাই।

হৃদরোগ থেকে মুক্ত থাকতে প্রতিরোধের ব্যবস্থাই মূল বিষয়, এজন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানসিক চাপমুক্ত জীবনযাপন, সুষম খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম। তার ‘জীবনের কিছু কথা’ গ্রন্থে খুব সুন্দরভাবে লিখেছেন- মনের প্রভাব শরীরের ওপর পড়ে। কাজেই আমাদের যতদূর সম্ভব দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা উচিত। এজন্যে নামাজ, প্রার্থনা, মেডিটেশন ও রিলাক্সেশন করা উচিত। তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত ‘আলোর পথ’ গ্রন্থেও তিনি মেডিটেশনের গুরুত্বকে তুলে ধরে বলেন, পরিশুদ্ধ আত্মা, বিশ্বাস, কল্পনা এবং ইতিবাচক মনছবি নিয়ে কিছু পাওয়ার আশা করলে পাওয়া সম্ভব হয়। জটিল অবস্থাও সহজ হয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় এবং কল্পনা স্বপ্ন বা ইচ্ছা বাস্তবে রূপ নেয়।

(ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের সভাপতি, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।)