ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

৫ লাখ মানুষকে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টের সহায়তা

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৭:৩৩ পিএম, ৪ মে ২০১৯ শনিবার

 

ইসলামের পাঁচটি মূলনীতির অন্যতম হচ্ছে যাকাত। আধুনিক অর্থনীতিতেও যাকাত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্বীকৃত। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে শোষন ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় যাকাতের বিকল্প নেই এমন কথা অর্থনীতিবিদরা স্বীকার করলেও অধিকাংশ মুসলিম দেশেই আল্লাহর নির্দেশিত বাধ্যতামূলক এই ইবাদতটি সঠিকভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে না। এর ফলে বিভিন্ন দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়ছে অসমতা। ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় যাকাত দিয়ে সমাজের দরিদ্র বঞ্চিত মানুষের উন্নয়নে বিশেষ কোন পরিবর্তন রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। সেই চিন্তা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে যাকাত তহবিল গঠন করে তাতে সকলকে অংশগ্রহনের আহবান জানিয়ে আসছে। ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করা সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট নামক প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ৫ লাখ মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে।

এদেশে সে লক্ষে কাজ করছে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট ( সিজেডএম)। যাকাত ব্যবস্থাপনা প্রাতিষ্ঠানিকীকরন,  ধর্মীয় দিক থেকে যাকাতের তাৎপর্য সকলের কাছে তুলে ধরা, যাকাত সংগ্রহ করা এবং তা থেকে পরিকল্পিত উপায়ে দু:স্থ ও বিপন্ন মানুষকে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে জীবন মান উন্নয়নে কাজ করছে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট - সিজেডএম।

ইসলামের বিধি বিধান অনুসারে যাকাত আদায়ের বিষয়ে বিত্তবান মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা, কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে যাকাত তহবিল সংগ্রহ এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তার বিতরন ও সদ্ব্যাবহার নিশ্চিত করা, যাকাতকে দারিদ্র বিমোচনের অন্যতম কার্যকর কর্মকৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত আদায়, বিতরণ ও সদ্ব্যবহারের উদ্দেশ্যে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার লক্ষেও কাজ করছে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দিলে তা টেকসই হয় না। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দিলে আশা করা যায় তা টেকসই হয়। সেই জায়গা থেকে সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট অনন্য ভূমিকা রাখছে।

২০০৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সোসাইটিজ রেজিষ্ট্রেশন অ্যাক্টের অধীনে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানীজ এন্ড ফার্ম থেকে নিবন্ধিত হয় সিজেডএম। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকৌশলে দেখা যায়, শরীয়াহ ভিত্তিক যাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার লক্ষে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, কর্মকৌশল ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারন করেছে। রয়েছে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা জবাবতিহিতার ব্যবস্থা।

যাকাত তহবিল সংগ্রহ করে তা বঞ্চিত মানুষের প্রয়োজনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিতরন করার কঠিন কাজটি করছে এ সংস্থা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান তাদের যাকাত তহবিল ব্যবহার করে উপযুক্ত ব্যাক্তি ও পরিবারের হাতে  পৌঁছে দেওয়ার জন্য সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টকে দায়িত্ব দিয়েছে। সংস্থাটি তাদের তহবিল ব্যবহার করে বিভিন্ন দরিদ্র বান্ধব প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে তা বিরাট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট  যাকাতকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য যে কাজ করছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। তারা যাকাত ব্যবস্থাপনায় যে কাজ হাতে নিয়েছে তা একটি বিশাল প্রক্রিয়ার ব্যাপার। এবং প্রতিষ্ঠানটি সেক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।

সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট- এর বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায় প্রাথমিক পর্যায়ে জরিপ পরিচালনার মাধ্যমে চিহ্নিত দরিদ্র পরিবারগুলোর পঁচিশ থেকে ত্রিশ জন যাকাত গ্রহণকারীকে নিয়ে এক একটি তৃণমূল সংগঠন গঠন করা হয়। তারা একটি যৌথ ব্যাংক হিসাব খোলে এবং সেখানে পরিবার পিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ যাকাতের অর্থ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি তাদেরকে একটি সঞ্চয় তহবিল গঠনে সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়া হয়।

সংগঠনটির কাজ অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, দলের সদস্যরা পরামর্শের ভিত্তিতে নিজস্ব গ্রুপ তহবিল থেকে বিনা চার্জে বিনিয়োগ নিয়ে তা কোন উপযুক্ত ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করে। শরীয়াহ নির্দেশিত পথে ব্যবসা করে সদস্যরা মুনাফার সিংহভাগ পারিবারিক কাজে লাগায় এবং একটি অংশ সঞ্চয় তহবিলে জমা করে। এছাড়াও সমন্বিত এ কর্মসূচীর আওতায় সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবা, পয়ঃসিষ্কাশন ও বিশুদ্ধ পানি, শিশু ও বয়ষ্ক শিক্ষা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি সেবা প্রদান করা হয়।

সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট তাদের কর্মসূচীগুল্রকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছে। কর্মসূচীগুলো হলো জীবিকা, মুদারিব, ফেরদৌসি, ইনসানিয়াত, জিনিয়াস, গুলবাগিচা, নৈপূন্য বিকাশ, দাওয়াহ।

জনপদগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই আর্থ সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে যে কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে তা `জীবিকা`। এই কর্মসূচীতে ৩৬ প্রকল্পের পনের হাজার পরিবারের মধ্যে মূলধন হস্তান্তর সহ নানাবিধ সেবা ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে। এই প্রকল্পে সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সত্তর হাজার।

দু:স্থ নারী ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচীটি হলো `ফেরদৌসি`। দেশের বিভিন্নস্থানে ৪৯ টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দুই হাজার পাঁচশত পরিবারের মোট দেড় লক্ষাধিক মানুষ এই সেবা পেয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার রোহিঙ্গাকে খাদ্য, বস্ত্র, তাবু, নিরাপদ পানি, সাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ও ফুল কোর্স ওষুধ সহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করেছে।

স্নাতক পর্যায়ের অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি কর্মসূচীকে বলা হয় `জিনিয়াস`। এ কর্মসূচীর আওতায় চলমান তিন হাজার চারশ শিক্ষার্থী সহ ছয় হাজার শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাসিক তিন হাজার টাকা করে দুই বছর মেয়াদে বৃত্তি প্রদান করেছে।

সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য শিক্ষা ও পুষ্টি সহায়তা কর্মসূচীর নাম `গুলবাগিচা`। এ কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা লাভের উপযোগী শিশুদের নৈতিক ও শিশুশিক্ষা প্রদান ও তাদের পুষ্টির অভাব পূরণে সহায়তা করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ হাজার শিশু প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা ও পুষ্টি সুবিধা পেয়েছে।

দরিদ্র বেকার যুবকদের জন্যও রয়েছে আলাদা কর্মসূচী। তাদের বৃত্তিমূলক কারিগরি প্রশিক্ষন কর্মসূচীর নাম ` নৈপুন্য বিকাশ`। এই প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে দুই হাজার দুই শত তেত্রিশ জন প্রশিক্ষনার্থী সফলভাবে প্রশিক্ষন সম্পন্ন করেছে।

এছাড়াও সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট আরো কয়েকটি কর্মসূচী নিয়ে কাজ করছে। ইসলামের মৌলিক বিধান যাকাত ও অন্যান্য ইবাদত সম্পর্কে যে কর্মসূচীর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা হয় সেই কর্মসূচীর নাম `দাওয়াহ`। জরুরী মানবিক সহায়তা কর্মসূচীকে বলা হয় `ইনসানিয়াত`। সিজেডেম ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উন্নয়ন নিয়েও কাজ করে। এই কর্মসূচীর নাম `মুদারিব`।

সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট - এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া বলেন, প্রচলিত অর্থনীতিতে দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব নয়। এজন্য এমন কল্যাণমূলক অর্থনীতি দরকার যার মধ্যে ইহকাল ও পরকাল দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। এক্ষেত্রে যাকাত ভিত্তিক অর্থনীতি হতে পারে দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার। আমরা মূলত এই চিন্তা থেকে কাজ করছি। তিনি বলেন, যাকাতের মূল লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচন, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করে তোলা যাতে আজকের যাকাত গ্রহীতা আগামীতে যাকাত দিতে পারে।

সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট- এর শরীয়াহ বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী মুহাম্মদ ইবরাহীম বলেন, সেন্টার ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাকাত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে ।  সমাজের বিত্তবান মুসলমানগন যেন তাদের যাকাত প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রদান করে এবং জাতি যেন তার সুফল পায় মূলত সেই লক্ষেই কাজ করছে সিজেডএম।

আ আ//