ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

যেসব অভ্যাস মানুষের আমল নষ্ট করে

আবূ আবদুর রহমান আস-সুলামী

প্রকাশিত : ১১:৩২ পিএম, ৮ মে ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ১১:৫৯ এএম, ১১ মে ২০১৯ শনিবার

রিযিক নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগা-রিযিক নিয়ে মানুষ খুব বেশি দুশ্চিন্তায় ভোগে। একটা একটা মনোরোগ। অথচ আল্লাহ তাআলা তার জন্য রিযিকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অপর দিকে সে আমলের ব্যাপারে উদাসীন। অথচ আল্লাহ এর দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করেছেন। অন্য কেউ সেটা তার জন্য করে দিলেও হবে না। এই বিষয়টি সংশোধনের জন্য এই কথা জেনে নিতে হবে যে, যেই আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তার রিযিকের দায়িত্বভারও গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, اللَّـهُ الَّذِي خَلَقَكُمْ ثُمَّ رَزَقَكُمْ

“তিনি সেই আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন অতপর তোমাদের রিযিক দান করেছেন।”

সুতরাং আল্লাহর সৃষ্টির ব্যাপারে মানুষ যেমন কোনো সন্দেহ করে না তেমনি (আল্লাহ প্রদত্ত) রিযিকের ব্যাপারেও তার কোনোরূপ সন্দেহ না থাকা উচিত।

আমি মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহকে হাতেম আল-আসম্ম এর সূত্রে বলতে শুনেছি, প্রতিদিন সকালে শয়তান আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আজকে তুমি কী খাবে, কী পরবে আর কোথায় থাকবে?’ আমি উত্তরে বলি, ‘আমি মরণ খাবো, কাফন পরবো আর কবরে থাকবো।’

#. আল্লাহর ছাড়কে গুরুত্ব না দেওয়া-পাপাচার করা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলার ছাড় দেওয়াকে গুরুত্ব না দেওয়া খুবই খারাপ বিষয়। এর সংশোধনের জন্য সবসময় আল্লাহকে ভয় করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখবেন, এই ছাড় আসলে ছাড় নয়। আল্লাহ তাআলা অবশ্যই এই বিষয়ে অদূর ভবিষ্যতে জিজ্ঞাসার কাঠগড়ায় দাড় করাবেন এবং এর প্রতিবিধান করবেন। তবে হ্যাঁ, যার প্রতি তিনি দয়াপরবশ হবেন তার কথা ভিন্ন।

আল্লাহ তাআলা বলেছেন, إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِمَنْ يَخْشَى

“নিশ্চয়ই তাতে শিক্ষা রয়েছে তাদের জন্য, যারা ভয় করে।”

কবি বলেছেন, غرها إمهال خَالِقهَا لَهَا ... لَا تحسبن إمهالها إهمالها

স্রষ্টার ছাড় তাকে বানিয়েছে বোকা এই ছাড়ে যেন সে না খায় ধোঁকা। মানুষের দোষত্রুটি বলে বেড়ানো

ঘুরে ঘুরে বন্ধু-বান্ধব ও ভাইদের দোষত্রুটি বলে বেড়ানো হলো মানব মনের মন্দ ব্যাধি। এর প্রতিকার হলো, নিজেকে নিয়ে চিন্তা-ফিকির করে অন্যের জন্য ঠিক সেটাই পছন্দ করা যা নিজের জন্য পছন্দনীয় বলে মনে হয়।

রাসূল—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—বলেছেন,

مَنْ سَتَرَ عَوْرَةَ أَخِيهِ الْمُسْلِمِ، سَتَرَ اللَّـهُ عَوْرَتَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

“যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন রাখবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামাতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন।” 

#. অন্যকে হেয় করা- অনেকে আছে যারা নিজের মুসলিম ভাইদেরকে হেয় করে, তাদের উপর অহংকার ও উদ্ধতভাবে প্রকাশ করে। এর প্রতিকারের পদ্ধতি হলো, বিনয় অবলম্বনে সচেষ্ট হওয়া। মুসলিমদের ইজ্জত-আব্রুর মূল্য দেওয়া।

আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জবানে বলেছেন,

فَاعْفُ عَنْهُمْ وَاسْتَغْفِرْ لَهُمْ وَشَاوِرْهُمْ فِي الْأَمْرِ

“আপনি তাদের মার্জনা করুন। তাদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করুন এবং কাজেকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন।” 

জেনে রাখুন, অহংকারই ইবলিশ শয়তানকে বিপদে ফেলেছিলো। কারণ সে দম্ভভরে বলেছিলো,

أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ

“আমি তার (আদম) থেকে উত্তম। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে।”

রাসূল—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—কাবার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,

مَا أَعْظَمَ حُرْمَتَكِ، وَالْمُسْلِمُ أَعْظَمُ حُرْمَةً مِنْكِ، حَرَّمَ اللَّـهُ مَالَهُ، وَحَرَّمَ دَمَهُ، وَحَرَّمَ عِرْضَهُ

তোমার সম্মান কতোই না বেশি! অথচ মুমিনের সম্মান আল্লাহর কাছে তোমার থেকেও বেশি। আল্লাহ তাআলা তার সম্পদ, তার রক্ত ও ইজ্জতকে (বিনষ্ট করা) হারাম করেছেন।” 

#. মিথ্যা কথা বলা- মনুষ্য স্বভাবের একটি জটিল রোগ হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা ৷ এটি দূর করার উপায় হচ্ছে নিজেকে সত্যবাদিতার উপর অভ্যস্ত করে তোলা এবং মানুষের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টিকে পাত্তা না দেওয়া। কারণ একজন মিথ্যাবাদীকে মিথ্যার উপর প্ররোচিত করে থাকে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের লোভ। তাদের সামনে নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন এবং তাদের কাছে পদ-পদবী কামনা করতে গিয়েই দেখা যায় সে মিথ্যায় লিপ্ত হয়।

রাসূলুল্লাহ—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—বলেছেন, إِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى البِرِّ، وَإِنَّ البِرَّ يَهْدِي إِلَى الجَنَّةِ وَإِنَّ الكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الفُجُورِ، وَإِنَّ الفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ

“সততা মানুষকে সৎকাজের পথ প্রদর্শন করে আর সৎকাজ জান্নাতে নিয়ে যায়। মিথ্যা মানুষকে পাপাচারের পথ প্রদর্শন করে। আর পাপাচার জাহান্নামে নিয়ে যায়।”

#. কৃপণতা করা

মানুষের একটি মনোরোগ হলো কৃপণতা করা। এটি দুনিয়ার প্রতি আসক্তি থেকে সৃষ্ট। একে দূর করতে হলে এই কথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে যে, দুনিয়া অতি নগণ্য বস্তু। এটি একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে। দুনিয়ার হালাল বস্তুসমূহের হিসাব নেওয়া হবে। হারাম বস্তুসমূহের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে।

রাসূল—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,

حُبُّ الدُّنْيَا رَأْسُ كُلِّ خَطِيئَةٍ “দুনিয়ার ভালোবাসা সকল পাপের উৎস।”

আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ

“দুনিয়ার জীবন হলো কেবলই ধোকার বস্তু।”

সুতরাং দুনিয়ার ব্যাপারে কৃপণতা করবেন না। বরং দান-খায়রাত করতে সচেষ্ট থাকবেন। নিজ সময়ের প্রয়োজন মিটানোর জন্য যতোটুকু পরিমাণ দরকার ঠিক ততোটুকু জিনিসই রাখবেন। কারণ নবি—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—বলেছেন,

أَنْفِقْ يَا بِلَالُ، وَلَا تَخْشَ مِنْ ذِي الْعَرْشِ إِقْلَالًا

‘হে বেলাল, তুমি খরচ কোরো এবং আরশের অধিপতির ব্যাপারে কমিয়ে দেওয়ার ভয় কোরো না৷’

#. হিংসা পোষণ করা

মনের ভেতর হিংসা পোষণ করা একটি আত্মিক ব্যাধি। এর প্রতিকারের জন্য এ কথা মানতে হবে যে, হিংসুক ব্যক্তি আল্লাহর নিয়ামতের শত্রু। নবি—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—বলেছেন,

لَا تَحَاسَدُوا، وَلَا تَبَاغَضُوا، وَلَا تَقَاطَعُوا، وَكُونُوا عِبَادَ اللهِ إِخْوَانًا

“তোমরা পরস্পর হিংসা কোরো না। বিদ্বেষ পোষণ কোরো না। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন কোরো না। আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে থেকো।”

জেনে রাখুন, হিংসা মুসলমানদের উপর দয়া-মায়ার হ্রাস ঘটায়।

#. ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখা- ধন-সম্পদ খরচ না করে পুঞ্জীভূত করে রাখা মানুষের একটি মন্দ স্বভাব। একে সংশোধন করার জন্য জানতে হবে যে, মানুষের জীবন বিনাশ হওয়া থেকে নিরাপদ নয়। তার মৃত্যু অতি সন্নিকটে। যদি এমনটি না হতো তখন মানুষ তার সুনিশ্চিত জীবনের পরিমাণ অনুসারে সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখতে পারতো। এবং তার হায়াতের সীমা অনুপাতে সম্পদ দান করা থেকে বিরত থাকতে পারতো। যে ব্যক্তির সাধারণ একটি নিশ্বাসের নিশ্চয়তা নেই তার জন্য সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখা এক ধরনের ধোঁকাগ্রস্ত হওয়ারই নামান্তর।

অন্যকে সম্পদ দান না করে নিজে কষ্ট করে তা আগলে রাখা এক ধরনের মূর্খতা। অথচ রাসূলে কারীম—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—থেকে বর্ণিত আছে, সাহাবায়ে কিরামকে জিজ্ঞেস করলেন,

أَيُّكُمْ مَالُ وَارِثِهِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ مَالِهِ؟

‘তোমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে নিজের সম্পদের তুলনায় উত্তরাধিকারীর সম্পদকে বেশি ভালোবাসে?’

সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ‘আমাদের সকলের কাছেই উত্তরাধিকারীর সম্পদের তুলনায় নিজের সম্পদ অধিক প্রিয়।’ তখন তিনি বললেন, اعْلَمُوا أَنَّهُ لَيْسَ مِنْكُمْ أَحَدٌ إِلَّا مَالُ وَارِثِهِ أَحَبُّ إِلَيْهِ مِنْ مَالِهِ، مَا لَكَ مِنْ مَالِكَ إِلَّا مَا قَدَّمْتَ، وَمَالُ وَارِثِكِ مَا أَخَّرْتَ

‘জেনে রাখো, তোমাদের প্রত্যেকেই এমন যে, উত্তরাধিকারীর সম্পদই তার কাছে নিজের সম্পদের তুলনায় অধিক প্রিয়। তুমি যা দান করেছো সেটিই কেবল তোমার সম্পদ। আর তোমার উত্তরাধিকারীর সম্পদ হলো তা, যা তুমি (দুনিয়াতে) রেখে গেলে।’ সত্য-বিমুখ লোকদের সাথে চলাফেরা করা

সত্য থেকে যারা বিমুখ থাকে তাদের সঙ্গে চলাফেরা করা মানব মনের মন্দ প্রবণতা। একে দূর করার পদ্ধতি হলো, যারা সত্যকে ভালোবাসে ও সত্যের অনুসারী তাদের সাথে চলাফেরা করা।

রাসূল—সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—বলেছেন,

مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ

“যে ব্যক্তি যাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের দলভুক্ত বলে বিবেচিত হবে।”

কোনো এক সালাফ বলেছেন, ‘মন্দ লোকদের সঙ্গে থাকা ভালো লোকদের ব্যাপারে মন্দ ধারণার জন্ম দেয়।’

অন্য আরেকজন সালাফ বলেছেন, ‘মানুষের অন্তর যখন আল্লাহর থেকে দূরে সরে যায় তখন আল্লাহর বিধান মান্যকারীদের সে ঘৃণা করতে শুরু করে।’

#. নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা-অনেক মানুষ নিজেকে তার সাথি-সঙ্গীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। এটিও মানুষের একটি মনের রোগ। এর চিকিৎসা হলো, নিজের ব্যাপারে ভালো মতো অবগত হওয়া। কারণ নিজের ব্যাপারে তার থেকে বেশি অবগত আর কেউ নাই। পাশাপাশি সাথি-সঙ্গীদের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করা। যাতে করে এর মাধ্যমে নিজেকে ছোট ও তুচ্ছ ভাবার সুযোগ পায় সে।

ভাইদের ও সাথি-সঙ্গীদের শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করে নেওয়া উচিত। আর এটা তখনই কেবল সম্ভব হবে, যখন সে অন্যদের দিকে উন্নত নজরে তাকাবে আর নিজের দিকে তাকাবে সাধারণ নজরে। আমি আমার দাদাকে এমনটি বলতে শুনেছি। তাছাড়া আমি আবূ আবদুল্লাহ সিজযি—রাহিমাহুল্লাহ-কে বলতে শুনেছি, ‘যতোক্ষণ তুমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে না ততোক্ষণ তুমি শ্রেষ্ঠ। আর যখনই তুমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করবে তখন আর তুমি শ্রেষ্ঠ থাকবে না।’

লেখক-আবূ আবদুর রহমান আস-সুলামী এর আত্মশুদ্ধি বই থেকে নেওয়া।