ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

কৌতুক অভিনেতা সংকটে ঢাকাই সিনেমা

সোহাগ আশরাফ :

প্রকাশিত : ০২:০০ পিএম, ৯ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:২৪ পিএম, ৯ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার

বিনোদনের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে মানুষকে আনন্দ দেওয়া। আর চলচ্চিত্র হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিনোদনের মাধ্যম। বাংলা চলচ্চিত্রে, বিশেষ করে ঢাকাই সিনেমার স্বার্ণালী যুগে সিনেমার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতো ‘কৌতুক’ পর্ব। একটা সময় ছিল যখন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য অংশ ছিল ‘কৌতুক’। আমাদের নিত্য দিনের জটিলতায় জীবন যখন নাভিশ্বাসে উঠে যায় ঠিক তখন একটু হাসি এনে দিতে পারে প্রশান্তি ও আনন্দ। সিনেমায় সেই কাজটি করেন একজন কৌতুক অভিনেতা।

একজন কৌতুক অভিনেতা একজন হিরো বা খলঅভিনেতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। শুধু বাংলাদেশের সিনেমাতেই নয়, বিশ্বের সব চলচ্চিত্রের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে কৌতুক পর্ব। ঢালিউডের  সূচনালগ্ন থেকে বাংলা সিনেমায় কৌতুককে খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু নির্মম সত্য যে- ঢাকাই সিনেমা আজ তার জৌলুস হারিয়েছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে কৌতুকের মত বড় চরিত্রগুলো। এক কথায় ‘চরম সংকটে পড়েছে ঢালিউড সিনেমার কৌতুক’,। অথবা ভিন্ন ভাবে যদি বলি- ‘কৌতুক অভিনেতা সংকটে ঢাকাই সিনেমা’।

সাধারণত একটি সিনেমায় সুন্দর একটি গল্প থাকে। আর সেই গল্পের কেন্দ্রে থাকে কয়েকটি চরিত্র। যে চরিত্রগুলো পুরো সিনেমাটিকে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু এই চরিত্রগুলোর মধ্যে এমন কিছু চরিত্র থাকে যাদের উপস্থিতিতে দর্শক নড়ে চড়ে বসেন। বিনোদিত হন তাদের কথা ও অভিনয়ে। আর তারা হলেন ‘কৌতুক অভিনেতা’।

ঢালিউডের  সূচনালগ্নে যারা আমাদের চলচ্চিত্রে দর্শকদের হাসির খোরাক জুগিয়েছেন তাদের অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই। কেউ চলে গেছেন না ফেরার দেশে, আবার কেউ অভিমানে সরে গেছেন। এমনকি নতুন করে জন্ম নিচ্ছে না- সোনা মিয়া, ফ্যাটি মহসিন, সাইফুদ্দিন, হাসমত, পরান বাবু, মতি, বেবী জামান, ব্ল্যাক আনোয়ার, খান জয়নুল, রবিউল, আনিস, টেলি সামাদ, দিলদার, কাজল, সুরুজ বাঙালী, আফজাল শরীফ, ববি, জ্যাকি আলমগীরের মত কৌতুক অভিনেতা।

বাংলাদেশের সিনেমায় দাপুটে কৌতুক অভিনেতা হিসেবে তাঁরা এক চেটিয়া অভিনয় করে গেছেন। পর্দায় তাদের উপস্থিতি মানেই দম ফাটানো হাসির রোল। শুধু কথা দিয়ে নয়, দর্শক পর্দায় তাদের অঙ্গভঙ্গি দেখেও হেসে গড়াগড়ি খেতো। মুহূর্তে কাঁদিয়েও ফেলতে পারতেন এইসব জাত অভিনেতারা। চরিত্রের বৈচিত্রময়তা প্রবল ছিল এই গুণী অভিনেতাদের মধ্যে।

আশি ও নব্বইয়ের দশকের বাংলা সিনেমায় কৌতুক অভিনেতা মানেই ছিল দিলদার। অঘোষিতভাবে তিনি বাংলা কমেডির রাজপুত্র বনে গেয়েছিলেন।

কৌতুক অভিনেতা হিসেবে দিলদার জনপ্রিয়তার এমন উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, তাকে নায়ক করে ‘আব্দুল্লাহ’ নামে একটি সিনেমাও নির্মাণ করা হয়। ওই সিনেমাতে একজন লোক হাসানো মানুষের খোলস ছেড়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন অন্যরূপে। সিনেমাতে দর্শক তার অভিনয় দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছেন, তেমনি চরিত্রের বৈচিত্রও দেখিয়েছেন অভিনেতা দিলদার। কিন্তু এই অভিনেতার মৃত্যুর পর যে শূণ্যতা দেখা দিয়েছিল তা আজও পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। বরং এই প্রধনতম অংশটি এখন বিলুপ্তির পথে।

বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের প্রথম দিকের সফল কৌতুক অভিনেতা ছিলেন রবিউল। শতাধিক সিনেমাতে তার হাস্যরস সৃষ্টির প্রতিভা আর্কাইভে পাওয়া যায়। তার অন্যতম গুণ ছিল তিনি কুলোর মতো কান দুটোকে তালে তালে নাচাতে পারতেন।

আমাদের চলচ্চিত্রের প্রাথমিক লগ্ন থেকে যে সকল কৌতুক অভিনেতা ছিলেন তাদের মধ্যে সাইফুদ্দীন, আনিস, খান জয়নুল, আলতাফ, হাসমত এদের সকলেই এখন পরলোকগত। সব শেষ চলে গেলেন শক্তিমান কৌতুক অভিনেতা টেলিসামাদ ও আনিস। কোনোরকম ভাঁড়ামো নয়, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, ডায়লগ এবং এক্সপ্রেশনের মাধ্যমে দর্শককে এক ধরনের নির্মল আনন্দদানে তাঁরা ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

এতো সব কৌতুক অভিনেতাদের মধ্যে একটি নাম এখন না বললেই নয়। তিনি হচ্ছেন এ টি এম শামসুজ্জামান। একটা সময় ছিল তিনি খল অভিনেতা হিসেবে পর্দায় উপস্থিত হতেন। কিন্তু এরপর এখন পর্যন্ত তিনি এই কৌতুক চরিত্রটিকেই বেছে নিয়েছেন। কারণ দর্শককে নির্মল বিনোদন এই চরিত্র দিয়েই দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কষ্টের কথা হচ্ছে- তিনিও বয়সের কাছে পরাজিত। এখন তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

এই অভিনেতার মত খল চরিত্র থেকে বেড়িয়ে এসে মাঝে মাঝে নিজেকে কমেডি চরিত্রে ফুটিয়ে তুলতেন হুমায়ুন ফরীদিও। কিন্তু তিনিও চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

দেখতে যতোই ছোট চরিত্র হোক, কৌতুক অভিনেতার কাজটি বেশ কঠিন। একজন অসার মানুষের মুখে খিলখিল করে হাসি ফোটানোর ক্ষমতা সবার থাকে না। অথচ আমাদের চলচ্চিত্রে কৌতুকশিল্পীর চরিত্র রূপায়ণের মাধ্যমে দর্শক মনে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন অসংখ্য অভিনেতা। এমনকি আমজাদ হোসেন, দিলীপ বিশ্বাস, সুভাষ দত্তের মতো বিখ্যাত নির্মাতারাও সিনেমার পর্দায় ক্যারিয়ার শুরু করেন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে। সেই নব্বই দশকের কথা। সেই সময় পর্যন্ত ঢাকার চলচ্চিত্রে কৌতুক অভিনেতাদের অবস্থান ছিল জমজমাট। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ছিল কৌতুক অভিনেতাদের। শুধু তাই নয়- টেলি সামাদ ও দিলদারকে নায়ক করে একসময় চলচ্চিত্রও নির্মাণ হয়েছে। আর সেই সব সিনেমা রীতিমতো সুপারহিট হয়েছে। বিষয়টি এমন ছিল যে, কৌতুক ছাড়া সিনেমা নির্মাণ এক কথায় অসম্ভব ছিল। অথচ বর্তমান সময়ে সিনেমার এই অঙ্গটি রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে। সিনেমায় আগের মতো দেখা যায় না কোন কৌতুক অভিনেতাকে অথবা কোন কৌতুকেরদৃশ্য।

আসলে চলচ্চিত্র মানে পূর্ণ বিনোদন আর বাণী। কঠিন কোনো বিষয়কে গুরুগম্ভীর না করে হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারলে তা দর্শকহৃদয়ে সহজে পৌঁছে যায়। মানুষ বিনোদন পেতে সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যায়। কৌতুক হচ্ছে বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ। কৌতুক ছাড়া সিনেমা পূর্ণতা পেতে পারে না।

এখনকার দর্শক বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম আগের মতো আলাদা করে কৌতুক দেখে না। তা ছাড়া কৌতুকের মতো কঠিন একটি কাজ সহজে সব শিল্পী আয়ত্তে আনতেও পারে না। ফলে এই চরিত্রে কেউ বেশিদিন টিকতে পারছে না। এখন অন্য চরিত্রের চেয়ে নায়ক-নায়িকা হওয়ার প্রতি সবার ঝোঁক বেশি। এ ছাড়া নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে বলে অনেকে আলাদা করে কৌতুকের দৃশ্য বা কৌতুকশিল্পী নিতে চায় না। তবে এ কথা মানতেই হবে যে- দর্শককে পূর্ণ বিনোদন দিতে কৌতুক বা কৌতুক অভিনেতার বিকল্প নেই।

এসএ/