জাপায় ক্ষোভের আগুন কেন?
মঈন বকুল
প্রকাশিত : ১০:৪৯ এএম, ১০ মে ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০১:৩১ পিএম, ১৬ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার
ফের অস্থিরতা শুরু হয়েছে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে (জাপা)। অস্থিরতা, নয়া মেরুকরণ জাতীয় পার্টিতে নতুন কিছু নয়। এই অস্থিরতা আর মেরুকরণের চাবিও সব সময় একজনেরই হাতে। তিনি হচ্ছেন পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দলের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এরশাদ একাই সিদ্ধান্ত দেন। আবার একাই আবার তা প্রত্যাহার করেন। অন্য নেতারা হয় দর্শক আর না হয় সমর্থক।
গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় দল নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ। পার্টিতে বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে নাটকীয়তা। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার পর সপ্তাহ না ঘুরতেই দলটির সভাপতিমণ্ডলীতে আটজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গণপদোন্নতিতেও প্রেসিডিয়াম সদস্য হতে না পেরে ক্ষোভে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি। এ অবস্থায় দলে চলছে অস্থিরতা।
গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক চিঠিতে সৈয়দ দিদার বখত, কাজী মামুনুর রশিদ, জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, নাজমা আখতার এমপি, আবদুস সাত্তার মিয়া, আলমগীর সিকদার লোটন, মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল এমপি ও এমরান হোসেন মিয়াকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করেন এরশাদ।
এরআগে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর ছয়জনকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করেছিলেন জাপা চেয়ারম্যান। এই ৮ জন নিয়ে দলটিতে প্রেসিডিয়াম সদস্যের সংখ্যা দাঁড়াল ৫৫।
হঠাৎ করে প্রেসিডিয়াম সদস্য বাড়ানোর কারণ জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, এই সংখ্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নয়। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নিজ ক্ষমতাবলে (পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/১/ক ধারা মোতাবেক) এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমনিতেও প্রেসিডিয়ামের অনেক সদস্যই আসেন না। সামনে পার্টির জাতীয় কাউন্সিল আছে। সব কমিটিতেই সদস্য সংখ্যা আমরা ঠিক করে দেব।
এদিকে গণপদোন্নতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করেছেন নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা। তিনি পদত্যাগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, দল যেভাবে চলার কথা সেভাবে চলছে না। এ কারণে পদত্যাগ করেছি। অযোগ্যদের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়েছে, যাদের দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা নেতৃত্বে চান না। এই এমপির দাবি, এরশাদের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে `এসব বিশৃঙ্খলা` চলছে জাপায়।
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ ছাড়লে দল থেকে পদত্যাগ করেননি লিয়াকত হোসেন খোকা। ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো এমপি যে দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছেন সেই দল থেকে পদত্যাগ করলে সংসদ সদস্য পদ হারাবেন।
লিয়াকত হোসেন বলেন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদ ছাড়লেও আমি এখনো জাপার কর্মী। দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এরশাদের সঙ্গে আছি। ভবিষ্যতেও থাকব। এরশাদ আমার নেতা। এরশাদের কর্মী হিসেবে কাজ করে যাব।
নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত লিয়াকত হোসেন থোকা প্রথমবার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হন। গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি হয়েছেন তিনি।
দলের অভ্যন্তরীণ বিবাদে আকস্মিক জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দেন এরশাদ। এর মাত্র ১৮ ঘণ্টার মাথায় বিরোধী দলের উপনেতা পদ থেকেও তাকে অব্যাহতি দেন বিরোধীদলীয় নেতা এরশাদ। গণমাধ্যমে পাঠানো এক সাংগঠনিক নির্দেশনায় এ অব্যাহতির কথা জানান এরশাদ। এই সময় তিনি স্ত্রী রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে মনোনীত করেন।
এর মধ্য দিয়ে জাপায় সেই পুরনো গৃহবিবাদ আবারও শুরু হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মহাসচিবের পদ থেকে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে এরশাদের জাপায় শুরু হয় অস্থিরতা। সবশেষ নতুন মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পান মশিউর রহমান রাঙ্গা।
এরপর গত ৪মে মধ্যরাতে বারিধারার বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে নিজের ছোট ভাই ও দলের কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
এক সাংগঠনিক নোটিশে তিনি বলেন, আমার শারীরিক অসুস্থতার জন্য পার্টির কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিঘ্ন হচ্ছে। পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত জিএম কাদের পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন।
দায়িত্ব নেওয়ার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদের জানিয়েছিলেন, জাপায় দীর্ঘদিন ধরে চলা কথায় কথায় পদোন্নতি ও বহিষ্কারের রীতি বন্ধ করবেন। দলে যোগ দিয়েই আর কেউ প্রেসিডিয়াম সদস্য হতে পারবেন না। দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে চান তিনি।
জিএম কাদেরের এ ঘোষণার চারদিনের মাথায় গণপদোন্নতির ঘটনা ঘটল জাপায়। জাপা সূত্রের খবর, জিএম কাদেরের সম্মতিতেই এক সঙ্গে আটজনকে প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়েছে। যাদের অনেকেই ছিলেন স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। এক লাফে প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়ে গেছেন।
এরআগে, গত ২১ মার্চ জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যহতি দেন এরশাদ। পরের দিন তাকে বিরোধীদলীয় উপনেতার পদ সরিয়ে রওশন এরশাদকে এ পদে বসান এরশাদ। গত ৪ এপ্রিল রংপুরের নেতাদের চাপে কো-চেয়ারম্যান পদ ফিরে পান জিএম কাদের। তবে উপনেতার পদে এখনো রওশন রয়েছেন।
জাপা সূত্রের খবর, জিএম কাদেরকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করায় ক্ষুব্ধ রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা। তাদের মোকাবেলায় দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের অনুসারীদের নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন জিএম কাদের। তারই অংশ হিসেবে প্রেসিডিয়ামে আটজন নতুন সদস্য যোগ করা হয়েছে। সবমিলিয়ে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে এখন চলছে ক্ষোভের আগুন।