টাইম পত্রিকার প্রচ্ছদে মোদীর সমালোচনা
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১০:৩০ এএম, ১১ মে ২০১৯ শনিবার | আপডেট: ১০:৩৫ এএম, ১১ মে ২০১৯ শনিবার
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বর্ষপূর্তিতে নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাৎকার ছেপেছিল মার্কিন পত্রিকা ‘টাইম’। আগামী পাঁচ বছরে বহু স্বপ্নের কথা সেই পত্রিকাকে বলেছিলেন মোদী। ২০১৫-র ১৮ মে সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল মোদীর পূর্ণাবয়ব ছবি। ভেতরে সেই সাক্ষাৎকার। প্রচ্ছদে ‘টাইম’-এর প্রশ্ন ছিল, ‘ক্যান মোদী ডেলিভার?’ মোদী কি পারবেন?
চার বছর পরে ভারতের নির্বাচনের মধ্যে ফের মোদীর মুখচ্ছবি পত্রিকাটির ২০ মে সংখ্যার প্রচ্ছদে। দৃষ্টিতে বিষণ্ণতা, গলায় গেরুয়া চাদর। হেডলাইন— ‘ইন্ডিয়া’জ ডিভাইডার ইন চিফ’ (ভারতে বিভেদের গুরু)।
প্রচ্ছদ নিবন্ধে নরেন্দ্র মোদীকে বিদ্ধ করা হয়েছে দেশে ‘বিষাক্ত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগ তুলে। লেখা হয়েছে, ‘পাঁচ বছর আগে ২০১৪-য় উজ্জ্বল ভারত, শক্তিশালী ভারতের স্বপ্নের এক প্রতিভূ হিসাবে উঠে এসেছিলেন মোদী, যেন এক আস্থার দেবদূত— যার এক হাতে হিন্দুর পুনর্জাগরণ, অন্য হাতে দক্ষিণ কোরিয়ার ধাঁচে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মসূচি।
এখন শুধুই এক ব্যর্থ রাজনীতিক হিসাবে ভোট চাইতে এসেছেন মোদী, যিনি করে দেখাতে পারেননি। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, সেই স্বপ্ন, সেই আস্থা আজ আর তার সঙ্গে নেই।’
প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকার এই প্রচ্ছদ ও নিবন্ধ নিয়ে যেমন রাজনীতিতে ঝড় উঠেছে, তেতে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়াও। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা টুইটে বলেন, ‘ভাগ করে শাসন করার নীতি মোদীরও।
কংগ্রেস ব্রিটিশ শাসকদের ভাগিয়েছে, এ বার মোদীর শাসনকেও তাড়াবে।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ঠিকই লিখেছে ‘টাইম’ পত্রিকা। গোরক্ষা ছাড়া, দাঙ্গা ছাড়া ওর মাথায় কিচ্ছু ঢোকে না।’’
এক নেটিজেন লিখেছেন, মনমোহন জমানার শেষ দিকে ‘টাইম’ পত্রিকা তার ছবি দিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশ করে। তাতে মনমোহনকে বলা হয়েছিল, ‘দ্য আন্ডারঅ্যাচিভার’। আর ফেরেননি মনমোহন।
ওই নেটিজেনের প্রশ্ন—মোদীরও কি সেই পরিণতি হবে? ‘টাইম’-এর এই সংখ্যা বাজারে আসার পরে সামাজিক মাধ্যমে ফিরে এসেছে ৪টি ছবির একটি কোলাজও, যাতে জাপান, ইউরোপ এবং দুবাইয়ের রাস্তার ফুলে ঢাকা ডিভাইডারের পাশে ভারতের ডিভাইডার হিসেবে মোদীর মুখ দেখানো হয়েছে।
নেটিজেনরা এ ব্যাপারে দু’ভাগ। মোদীভক্ত ‘চৌকিদারেরা’ রে রে করে উঠেছেন। প্রচ্ছদ নিবন্ধের লেখক সাংবাদিক আতিশ তাসিরের উইকিপিডিয়া পেজে হানা দিয়ে তার পেশা হিসেবে ‘কংগ্রেসের জনসংযোগ ম্যানেজার’ লিখে দেওয়া হয়। মোদী-বিরোধীরা আবার বলছেন— ঠিকই তো!
‘টাইম’ অভিযোগ করেছে, মোদী সরকারের পাঁচ বছরে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, উদার নীতি ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম— ভারতীয় রাষ্ট্রগঠনের তিনটি প্রধান সুরকেই নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
জওহরলাল নেহরু-মোহনদাস গান্ধীর মতো দেশগঠনে ব্রতী নেতাদের বিরুদ্ধে অনাস্থা তৈরি করা হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তো বটেই, মুক্তমনা, পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও তফসিলিদের পর্যন্ত কোণঠাসা হতে হয়েছে, আক্রমণ নেমে এসেছে তাঁদের ওপর।
সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি সংখ্যালঘুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা এবং তার ফলে দাঙ্গা, গণধোলাই, হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কর্পোরেট হাউস বা সংবাদমাধ্যম— সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রতি দেশজুড়ে ঘোর অনাস্থা তৈরি করা হয়েছে।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘মোদীর অর্থনৈতিক জাদু শুধু যে কাজ করেনি তাই নয়, ভারতে বিষাক্ত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিবেশ ছড়াতে সাহায্য করেছেন তিনি।’
পত্রিকাটিতে মোদীর অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে দ্বিতীয় একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— দেশের বেকার তরুণদের স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১৪-য় ভোট কুড়িয়েছিলেন মোদী। কিন্তু জানুয়ারিতে সরকারেরই এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছে।
ভোটের আগে মোদী সরকার যে এই সমীক্ষার ফল চেপে যেতে চেয়েছে, সে কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও মোদীর অর্থনৈতিক কর্মসূচির ফলাফলকে মিশ্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
কারণ, মোদীর আমলে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বিশ্বের দ্রুততম। (যদিও সূচককে খেয়ালখুশি মতো বদলানোর অভিযোগও মোদী সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে।) তবে প্রশ্ন তোলা হয়েছে মোদীর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ স্লোগান বাস্তবায়ন নিয়ে। অবশ্য এ-ও বলা হয়েছে, তার পরেও দেশে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নে সব চেয়ে বেশি আস্থা রাখা যেতে পারে মোদীর ওপরই।
ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধীদের আক্রমণের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর টুইটের উল্লেখ করেছে পত্রিকাটি, যাতে মোদী বলেন, ‘আমার অপরাধ কি জানেন? গরিব পরিবার থেকে উঠে এসে ওদের সুলতানি সাম্রাজ্যকে চ্যালেঞ্জ করেছি!’
অভিযোগ করা হয়েছে, ভোটের আগে যাবতীয় ব্যর্থতার বিরুদ্ধে বর্ম হিসেবে মোদী তুরস্ক, ব্রিটেন, ব্রাজিল বা আমেরিকার শাসকদের মতো জাতীয়তাবাদকেই বেছে নিয়েছেন। পুলওয়ামায় জঙ্গি হানার জবাবে তিনি পাকিস্তানে বিমান হামলা করিয়েছেন, যাকে হাতিয়ার করে এ বার নির্বাচনে উতরে যেতে চাইছেন মোদী। ২০১৪-য় ‘অচ্ছে দিন’-এর যে অঙ্গীকার তিনি মানুষের কাছে তুলে ধরেছিলেন, এ বারে আর তার কথা বলছেনই না।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার
এমএইচ/