ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

বছর ঘুরে মাহে রমজান

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:২৭ এএম, ১২ মে ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ১১:৫৮ এএম, ১২ মে ২০১৯ রবিবার

মাহে রমজান এলো বছর ঘুরে
মুমেন মুসলমানের ঘরে ঘরে ...

ইসলাম শুধু মাত্র একটি ধর্মই নয় । এটি একটি পরিপূর্ন শাশ্বত জীবন বিধান। এটি বিশ্ব মানবতার মহান মুক্তির সনদ। মানুষের- ব্যক্তিগত,পারিবারিক,সামাজিক,রাজনেতিক,স্বাাংস্কৃতিক,অর্থনেতিক,ধর্মীয়ও আর্ন্তজাতিক তথা - সার্বিক জীবনের সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে, মহান রাব্বুলআলামীনের ঐশি পবিত্র মহাগ্রšথ আল-কোরআনুল কারীমের মধ্যে। এ শাশ্বত জীবন বিধান মানব সমাজে বাস্তবে অনুসরণ ও অনুকরণের জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব,মানবতার মহান মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ ( সা:) কে আল্লাহ ছোবাহানাহু তায়ালা বিশ্ববাসীর জন্য রহমত সরুপ এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন- তেমাদের জন্য রাসুলের জীবনীর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। তাঁর প্রতিটি কথা,কাজ,অনুমোদন,নির্দেশনা, আদেশ,নিষেধ ও উপদেশ দুনিয়া –আখেরাতের কল্যাণের বার্তাবাহী। তাঁকে সমগ্র মানব জাতির শিক্ষক রূপে এ ধরাধমে প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁর সে কালজ্বয়ী আদর্শ ও অমিয়বাণী দ্যুাতি ছড়িয়ে পথপদর্শন করেছে যুগ যুগান্তরে। তাঁর পরশে আলোকিত হয়েছে বর্বর জাহিলি সমাজ। ঘন ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতি পরিণত হয়েছে গোটা বিশ্বের অনুকরণীয় আদর্শে । পরিপূর্ন শাশ্বত জীবন বিধান ইসলাম পাঁচটি মূলভিতিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ১. ঈমান বা বিশ্বাস ২.সালাত বা নামাজ ৩.সাওম বা রোজা ৪.হজ ও ৫. যাকাত। আজকের আলোচ্য বিষয় হলো-ইসলামের পাঁচটি মূলভিতিত্তির তৃতীয় ভিত্তি সাওম বা রোজা।
রোজার উদ্দেশ্য:-
রোজা রাখার উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং নিজেদের কামনা-বাসনা নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ গ্রহনের মাধ্যমে পরহেজগারি বা তাকওয়া বৃদ্ধি করা।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষ্য:
পবিত্রআল-কুরআনে বলা হয়েছে,” হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ঊপর; যাতে তোমরা তাক্ওয়া অর্জন করতে পারো" সূরা বাকারা, আয়াত-(১৮৩)
আরও বলা হয়েছে- "রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।" সূরা বাকারা,- (১৮৫)
রোজার শাব্দিক অর্থ:
রোজা বা রোজা ফার্সি শব্দ, আরবি হলো সাওম বা সিয়াাম। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মূল ভিত্তির তৃতীয়টি সাওম বা সিয়াম। সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল প্রকার পানাহার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। ইসলামী বিধান অনুসারে, প্রতিটি সবল মুসলমানের জন্য রমযান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ, যার অর্থ অবশ্য পালনীয়।

 রোজার ইতিহাস:
(ক) সূর্যাস্তের সময় মুসলমানগণ ইফতারির মাধ্যমের রোজা ভঙ্গ করেন
কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-
"হে হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার"। (সূরা বাকারা: ১৮৩)
(খ) হযরত আদম যখন নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তাওবাহ করেছিলেন তখন ৩০ দিন পর্যন্ত তাঁর তাওবাহ কবুল হয়নি। ৩০ দিন পর তাঁর তাওবাহ কবুল হয়। তারপর তাঁর সন্তানদের উপরে ৩০টি রোযা ফরয করে দেওয়া হয়।
(গ) নূহ (আ.)-এর যুগেও রোজা ছিল। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন:-
হযরত নূহ (আ.) ১ লা শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর রোযা রাখতেন।-( — ইবনে মাজাহ ১৭১৪ সনদ দুর্বল)
(ঘ) হযরত ইবরাহীমের যুগে ৩০টি রোজা ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছেন।
(ঙ) হযরত দাউদ (আ.) এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোজা ,হযরত দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি একদিন রোযা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন।
(চ) আরববাসীরাও ইসলামের পূর্বে রোজা সম্পর্কে কমবেশী ওয়াকিফহাল ছিল। মক্কার কুরাইশগণ অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মুহররম) দিনে এ জন্য রোজা রাখতো যে, এই দিনে খানা কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হত,মদীনায় বসবাসকারী ইহুদীরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করতো,অর্থাৎ ইহুদীরা নিজেদের গণনানুসারে সপ্তম মাসের ১০ম দিনে রোজা রাখতো

রোজার প্রকারভেদ:
রোজা পাঁচ প্রকার---
১.ফরজ রোজা:
যা আবার চার প্রকার-
(ক) রমজান মাসের রোজা।
(খ) কোন কারণ বশত রমজানের রোজা ভঙ্গহয়ে গেলে তার কাযা আদায়ের রোজা।
(গ)শরীয়তে স্বীকৃত কারণ ব্যতিত রমজানের রোজা ছেড়ে দিলে কাফ্ফারা হিসেবে ৬০টি রোজা রাখা।
(ঘ) রোজার মান্নত করলে তা আদায় করা।
২. ওয়াজিব রোজা: নফল রোজা রেখে ভঙ্গ করলে পরবর্তীতে তা আদায় করা ওয়াজিব।
৩. সুন্নত রোজা: মহরম মাসের নয় এবং দশ তারিখে রোজা রাখা।
৪. মোস্তাহাব রোজা: প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, এবং ১৫ তারিখে, প্রতি সাপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবারে, কোন কোন ইমামের মতে শাওয়াল মাসে পৃথক পৃথক প্রতি সপ্তাহে দুটো করে ছয়টি রোজা রাখা মোস্তাহাব। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে এক সাথে হোক কিংবা পৃথক পৃথক হোক শাওয়ালের ছয়টি রোজা মুস্তাহাব।
৫.নফল রোজা: মোস্তাহাব আর নফল খুব কাছাকাছির ইবাদত। সহজ অর্থে নফল হলো যা ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত নয় এমন ইবাদত পূণ্যের নিয়তে করা। রোজার ক্ষেত্রেও তাই।
রোজার ফযিলত:
রমজানের একটি বিশেষ ফজিলত বা মাহাত্ম হচ্ছে,এই পবিত্র রমজান মাসে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। রমজান মাসের রোজা মানুষকে পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি দেয়,মানুষের কুপ্রবৃত্তি ধুয়ে মুছে দেয় এবং আত্মাকে দহন করে ঈমানের শাখা প্রশাখা সঞ্জিবীত করে। সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। এই মর্মে মহানবী (সা:) ইরশাদ করেছেন,
"রোজাদারের জন্য দুটি খুশি। একটি হলো তার ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।"-(বুখারী ও মুসলিম)
সর্বাধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি হযরত আবু হুরাইরা (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি কারণ (অর্থাৎ সফর অসুস্থতা ইত্যাদি) ব্যতীত রমজানের একটা রোজা রাখলোনা, সে যদি তা পূরণের জন্য জীবনভর রোজা রোজা রাখে, তাহলেও ঐ একটি রোজার ক্ষতি পূরণ হবেনা।-(তিরমিজ,আবু দাউদ)
রোজার শর্ত:
রোজার কিছু মৌলিক আচার আছে। যা ফরজ বলে চিহ্নিত। সুস্থ-সবল প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। কিন্তু শারীরিক অসমর্থতার কারণে সে এ দায়িত্ব থেকে আপাতভাবে মুক্তি পেতে পারে। এর প্রতিবিধানে রয়েছে কাজা ও কাফফারার বিধান। নিচে রোজার ফরজ ও শর্তগুলো দেওয়া হলো-
রোজার ৩ ফরজ-
১. নিয়ত করা
২. সব ধরনের পানাহার থেকে বিরত থাকা
৩. যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা।
রোজা রাখার ৪ শর্ত-
১. মুসলিম হওয়া
২. বালেগ হওয়া
৩. অক্ষম না হওয়া
৪. ঋতুস্রাব থেকে বিরত থাকা নারী।

রোজার আাদব:

= সর্বাধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি হযরত আবু হুরাইরা (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: কেবল আহারাদি থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। অশ্লীল কথাবার্তা ্ও অশালীন আলোচনা থেকে দূওে থাকাই আসল রোজা । অতএব, হে রোজাদার, আমি রোজাদার(অর্থ্যাৎ উত্তেজিত হয়ে জবাব দ্ওি না।-(ইবনে খোয়ামা ্ও হিব্বান)

রোজা একটি ঢাল:
= হযরত উসমান ইবনে আবুল আস (রা :) বর্ণনা করেছেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ্ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, যুদ্ধেও সময় তোমাদের কাছে যেমন ঢাল থাকে তোমাদেও শত্রুর আক্রমন থেকে রক্ষার জন্য, রোজা তোমাদের জন্য তেমনি ঢাল যা জাহান্নাম থেকে তোমাদের রক্ষা করবে। -(তারগীব ্ও তারহীব)

রোজা শরীরের যাকাত:

= সর্বাধিক সংখ্যক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি হযরত আবু হুরাইরা (রা:) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ্ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ প্রতিটি জিনিষের অপবিত্রতা দূও করার জন্য কোনো না কোনো বস্তু সৃষ্টি করেছেন । শরীরকে পরিশুদ্ধ করার বস্তু হলো রোজা, আর রোজা হলো অর্ধেক সবর।
-(ইবনে মাজাহ)

রোজা ভঙ্গ হলে-
বিনা কারণে রোজা ভঙ্গ করলে তাকে অবশ্যই কাজা-কাফফারা উভয়ই আদায় করা ওয়াজিব। যতটি রোজা ভঙ্গ হবে, ততটি রোজা আদায় করতে হবে। কাজা রোজা একটির পরিবর্তে একটি অর্থাৎ রোজার কাজা হিসেবে শুধু একটি রোজাই যথেষ্ট। কাফফারা আদায় করার তিনটি বিধান রয়েছে।
১. একটি রোজা ভঙ্গের জন্য একাধারে ৬০টি রোজা রাখতে হবে। কাফফারা ধারাবাহিকভাবে ৬০টি রোজার মাঝে কোনো একটি ভঙ্গ হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
২. যদি কারও জন্য ৬০টি রোজা পালন সম্ভব না হয় তবে ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা খাওয়াতে হবে। কেউ অসুস্থতাজনিত কারণে রোজা রাখার ক্ষমতা না থাকলে ৬০ জন ফকির, মিসকিন, গরিব বা অসহায়কে প্রতিদিন দুই বেলা করে পেটভরে খাওয়াতে হবে।
৩. গোলাম বা দাসী আজাদ করে দিতে হবে।

যেসব কারণে রমজান মাসে রোজা ভঙ্গ করা যাবে কিন্তু পরে কাজা করতে হয় তা হচ্ছে -
১. মুসাফির অবস্থায়
২. রোগ-ব্যাধি বৃদ্ধির বেশি আশঙ্কা থাকলে
৩. মাতৃগর্ভে সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে
৪. এমন ক্ষুধা বা তৃষ্ণা হয়, যাতে মৃত্যুর আশঙ্কা থাকতে পারে
৫. শক্তিহীন বৃদ্ধ হলে
৬. কোনো রোজাদারকে সাপে দংশন করলে।
৭. মহিলাদের মাসিক হায়েজ-নেফাসকালীন রোজা ভঙ্গ করা যায়

যেসব কারণে শুধু কাজা আদায় করতে হয়-
১. স্ত্রীকে চুম্বন বা স্পর্শ করার কারণে যদি বীর্যপাত হয়
২. ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে
৩. পাথরের কণা, লোহার টুকরা, ফলের বিচি গিলে ফেললে
৪. ডুশ গ্রহণ করলে
৫. বিন্দু পরিমান কোন খাবার খেলে তবে অনিচ্ছাকৃত ভাবে বা মনের ভুলে খেলেও রোজা ভাংবে না তবে মনে আসা মাত্রই খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে
৬. নাকে বা কানে ওষুধ দিলে (যদি তা পেটে পৌঁছে)
৭. মাথার ক্ষতস্থানে ওষুধ দেওয়ার পর তা যদি মস্তিষ্কে বা পেটে পৌঁছে
৮. যোনিপথ ব্যতীত অন্য কোনোভাবে সহবাস করার ফলে বীর্য নির্গত হলে
৯ স্ত্রী লোকের যোনিপথে ওষুধ দিলে
আধুনিক গবেষনার আলোকে সম¯ত মুসলিম ্ও অমুসলিম ডাক্তার এ ব্যাপারে একমত যে, ইসলামী পদ্ধতিতে রোজা রাখার ফলে অনেক মারাতœক রোগের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় । রোজা হলো এমন ইবাদত যা অন্য ইবাদত অপেক্ষা খাঁটি ও (রিয়ার) অহংকার সন্দেহ থেকে পবিত্র। তাই লোভ-লালসা আয়াত্বে রাখার যে ক্ষমতা এর মাধ্যমে অর্জিত হয়। তা অন্যান্য ইবাদত দ্বারা লব্দ ক্ষমতার অর্ধেক হবে।
// আনোয়ারুল কাইয়ূম কাজল