জীবনের পথে পথচলা
এএএম জাকারিয়া মিলন
প্রকাশিত : ১১:১৬ পিএম, ১২ মে ২০১৯ রবিবার | আপডেট: ১২:০২ পিএম, ১৬ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার
মানুষের জীবনটা কী? আমাদের এই জীবনটাকে কেন্দ্র করে কত কিছু আমরা করেছি। সারাদিন প্রাণান্তকর পরিশ্রম। সুখ-আনন্দ-স্বাচ্ছন্দ্যের পেছনে আমরা ছুটছি। এই ছোটা অন্তহীন।
কিন্তু সুখের সন্ধান সত্যিকারভাবে আমরা কি পাচ্ছি? সাংসারিক-জাগতিক এই জীবনটা আসলে হল একটা লড়াপেটার জীবন। প্রতিটি মুহূর্তে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে অগ্রসর হতে হচ্ছে। টিকে থাকার জন্য বেঁচে থাকার জন্য নিয়ত আমরা যুদ্ধ করছি। দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা জীবনের নিত্য সাথী। হাসি-আনন্দ ভালো লাগার সময়টা আর কতটুকু?
আমার জানা নেই কোন মানুষ পৃথিবীতে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত কি? নিরবচ্ছিন্ন আনন্দ কেউ ভোগ করতে পারছে কি?
মানুষের মনের কথা আমরা কতটুকুই বা জানতে পারি। একজন তার কতটা সমাজে প্রকাশ করতে পারে।
সমাজ সংস্কারের বেড়াজালে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। লোকলজ্জা সমাজের ভয়ে আমরা কতটুকু প্রকাশ করতে পারি নিজেকে? আর এই অপ্রকাশিতেব্যের যন্ত্রণা অত্যন্ত কষ্টকর, নিন্দনীয়, নিদারুণ পীড়াদায়ক।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা পরীক্ষা দিচ্ছি। জীবন পরীক্ষাগারে আমাদের হাতে একটা প্রবেশপত্র ধরিয়ে দিয়ে আমাদেরকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়। একের পর এক পরীক্ষা আমরা দিয়ে চলেছি। বিরামহীন এই পরীক্ষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কখনও কখনও আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তবুও ছাড় নেই এই পরীক্ষার। কখনও জীবন বিষাদময় হয়ে পড়ে। তবে হ্যা, পরীক্ষায় পাসের আনন্দের মতো ছোটখাট আনন্দবোধ জীবনে আসে না তা নয়। হাসি-আনন্দের স্বাদ পায় তবে তার ভাগটা খুবই সীমিত।
জীবনটাকে একটা পরীক্ষা কেন্দ্র ভেবে নিয়ে এবং নিজেকে ছাত্র মনে করে সিলেবাস অনুযায়ী নিয়মিত পড়াশোনা করা এবং পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া- এটাই আমাদের করণীয়।
আনন্দটা সবার, সবাইকে ভাগ করে উপভোগ করা যায়। দুঃখটা একার কারোর সঙ্গে শেয়ার করা যায় না।
মরিতে চাই না এই সুন্দর ভূবনে। এই উক্তি জ্ঞান হবার পর হতে শুনে আসছি। কিন্তু এই ভূবন সুন্দর না অসুন্দর তার সঠিকভাবে উপলব্ধি করা খুব কঠিন বলে মনে হয়। সামাজিক জীব হিসেবে আমরা পরিবারভুক্ত হয়ে জীবন যাপন করি।
এই পৃথিবীতে মানুষের জীবন মোটেই হাসিখেলার নয়। অত্যন্ত কঠিনভাবে শৃঙ্খলিত। এমনভাবে আমরা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। যার যাতনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। বিশ্লেষকরা হাসি-আনন্দ এবং দুঃখ-বেদনাকে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় এই দুটোর হিসেবে-নিকেশ করলে বেদনার পাল্লাই ভারী হবে। আমরা কয়জন মানুষের কথা জানি? দৃশ্যত সাদামাটাভাবে চলা মানুষের মনের খবর কি জানি? বাহ্যিকভাবে চলাফেরায় কিছুই আঁচ করা যায় না।
একেকজনের একেক ধরনের সমস্যা। সমস্যার ধরন ভিন্ন হতে পারে কিন্তু বেদনাবোধ এক। গভীরভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে আমরা কেউই নিরবচ্ছিন্ন হাসি-আনন্দে নেই। মনের গভীরে লুকিয়ে আছে গভীর যন্ত্রণা, যা প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করছে। কেউ কখন কিছু প্রকাশ করছে জেনে আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু না জানা রয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগের দুঃখবেদনা।
জীবনের চলার পথ মসৃণ সমতল নয়।
আঁকাবাঁকা ভঙ্গুর পথ পেরিয়ে চলতে হয় আমাদের। আঁকাবাঁকা পথে হোঁচট খেতে হয়। ক্ষত-বিক্ষত হই আমরা। কষ্ট পাই, দুঃখবোধ আর কষ্ট নিয়ে নিজের মনের মধ্যে গুমরে মরতে হয়। কোনো কোনো বিষয় আছে নিকটজনের সঙ্গে শেয়ার করে হালকা হওয়া যায়। কিছু কিছু বিষয় থাকে, যা কারোর সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। একান্ত নিজের বিষয়। এগুলোর যাতনা সবচেয়ে বেশি, বলা যায় না আবার সহ্য করা কষ্টকর। মনের নিভৃতে লালন করে গুমরে মরতে হয়।
আশাবাদী মানুষ তার পরেও আশায় আশায় দিনগুণে কখন সুদিন আসবে। দুঃখের দিনের অবসান হবে রাতের আঁধার পেরিয়ে ভোরের সোনালি হাস্যোজ্জ্বল সূর্য উঠবে। স্বপ্ন কখনও কখনও সফল হয়, জীবন আকাশের অন্ধকার কেটে যায়। হাসি-আনন্দময় হয়ে ওঠে জীবন।
রাতের পর দিন, দিনের পর রাত এই চিরন্তন নিয়মাবলি নিয়েই আমাদের জীবন আবর্তিত হয়। একটানা হাসি-আনন্দ অথবা জীবনের প্রতিটি স্তরেই দুঃখ ভোগ করতে হয়। এ রকম সাধারণত ঘটে না।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে নিজের জীবনের পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই আমার ইচ্ছে পরিকল্পনা অনুযায়ী কিছুই ঘটেনি। সবই ঘটেছে বাইরের-নেপথ্যের কোন শক্তির ইচ্ছা মাফিক।
ছোটবেলায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জীবনী পড়ে এবং আইন ব্যবসায়ী পিতার পুত্র হিসেবে মনে স্বপ্ন দেখেছিলাম ব্যারিস্টার হওয়ার। এই স্বপ্নকে লালন করে ধীরে ধীরে বড় হয়েছিলাম। প্রথম হোঁচট খেলাম বৃত্তি পেয়ে অষ্টম শ্রেণি হতে নবম শ্রেণিতে ওঠার পর। Arts-Science গ্রুপে বিভক্ত হওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এই পর্যায়ে আব্বা আমার আইনজীবী হওয়ার বিষয়টি সরাসরি নাকচ করে দিলেন। তাঁর ডাক্তার হতে না পারার ইচ্ছেটা আমাকে পূরণ করার নির্দেশ দিলেন। ক্যারিয়ার নিয়ে এত কষ্ট মনে হয় আর পাইনি। পরবর্তীতে আব্বার ইচ্ছে পূরণ করার জন্য Science-এ ভর্তি হই। ছাত্র রাজনীতিতে জেল-জুলুম খেটে আইএসসি আর পাস করা হলো না। বড় দুলাভাইয়ের চেষ্টায় গোপনে ভর্তি রাখার কারণে আইএ পরীক্ষা দেওয়া হয়েছিল। তখন জেল ফেরত তুখোড় ছাত্রনেতা। অতি মেধাবী হওয়ায় ২ বছর পর কোন ক্লাস না করে শুধু বিভিন্ন Reference বই পড়ে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলাম। ছাত্ররাজনীতি করার জন্য নামকাওয়াস্তে বাংলা অনার্সে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম। আমার বড় বোন খুব হেয় কথা বলেছিলেন। বাংলা মেয়েদের বিষয়, উনি সেই আমলে ইংরেজিতে এমএ। সুতরাং তাঁর এ অহঙ্কার থাকার কথা। ভাইয়েরও জেদ কম নয় তাই অর্থনীতিতে ভর্তি হলাম। ব্যক্তি জীবনে উদ্দেশ্যবিহীন রাজনীতি ধ্যান। রাজনীতি স্বপ্ন। স্বৈরাচার আইয়ুব শাহীর পতন সর্বহারার রাজ কায়েম। কৃষক-শ্রমিকের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা।
ছাত্রজীবনে রাজনীতি করাকালীন ব্যক্তি জীবনের কথা ভাবতাম না। ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা, প্রতিষ্ঠা অর্জন সংসার ধর্ম-এগুলো ছিল চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে। খুব সতর্কতায় এগুলো পরিহার করার চেষ্টা করেছি। সহপাঠিনী পার্টির মেয়ে নেত্রীদেরকে নিজের বোন ভেবেছি। সেভাবে দূরত্ব বজায় রেখেছি। হ্যাংলামোপনা অপছন্দ করেছি। ভেবেছি ঘর সংসারী হব না, জীবন বিসর্জন দেব সাধারণ মানুষের জন্য।
সেখানেও ওপর আল্লাহর ইচ্ছে উল্টো খাতে প্রভাবিত হয়েছে। আমার সংকল্পে বিধাতা বিদ্রুপের হাসি হেসেছেন। সংসারী শুধু হতে হয়েছে তাই নয় অনেক আগে।
তারপরে দল, ব্যক্তি জীবন, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতা সামগ্রিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সব কিছু মিলিয়ে একদিন আবার সেই প্রিয় রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিতে হয়েছে। এখানেও নিজের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে। যে রাজনীতির জন্য মৃত্যুশয্যায় শায়িত বাবার কাছে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করেছি। ভাল ছাত্র হয়েও লেখাপড়ায় ছেদ পড়েছে। জেল-জুলুম-নির্যাতন অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। সেই সাধের রাজনীতি করা হলো না। তখন মনে করলাম পাস করে যশোরে গিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করব। কারোর অধীনে চাকরি করার কথা কোনদিন ভাবিনি। B.C.S ফরম হাতে পেয়েও জমা দিলাম না।
সেখানেও ওপরওয়ালার ইচ্ছে অন্য রকম। অনেকটা জেদের বশে Banking Recruitment-এর একটা ফরম জমা দিয়েছিলাম। একবারই চাকরির দরখাস্ত সরাসরি Senior Officer নিয়োগ। গুরুজনের পরামর্শে অনেকটা Test Case-এ মতো চাকরিতে যোগদান। সেখানে ওপরওয়ালার পূর্ণ সহযোগিতায় সুদীর্ঘ ৩৭ বছর কাটিয়ে দিলাম এবং স্রষ্টার অনুগ্রহে চাকরির সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছি।
একসময় প্রগতিশীল রাজনীতি করার কারণে বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলাম। ধর্মেকর্মে আস্থা ছিল না। অর্থনীতিতে পড়ার সময়ে খুব আগ্রহে সমাজতন্ত্রের বই পড়াশোনা করতাম। তখন ভাগ্য বিশ্বাস করতাম না। বলতাম মানুষ নিজের ভাগ্যের নির্মাতা।
বিশ বছর পূর্বে যখন আবার ধর্মে বিশ্বাস ফিরে আসতে থাকে তখন মনে হয়েছে আমার জীবনে যা কিছু ঘটছে তা নিয়তির লিখন। দোষে-গুণে মানুষ। আমাদের প্রত্যেকের কিছু দোষ, কিছু গুণ আছে। কারোর দোষ বেশি আবার কারোর বা গুণ বেশি। এর বাইরের আমরা কেউ নই।
সুতরাং মানুষকে বিচার করতে হলে আপেক্ষিক শব্দটার ব্যবহার এসে যাবে।
ধর্মে যখন পরিপূর্ণ বিশ্বাসে কাজ করছি তখন ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব সাইফুল আলম মাসুদ সাহেব অনেকভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত-পরিশ্রমী ধর্মপরায়ণ এই মানুষটির ব্যবহার সর্বজনবিদিত। এত সাধারণ জীবন যাপনকারী নিরহঙ্কার মানুষ খুব কমই দেখা যায়। বুদ্ধির গভীরতার কারণে তাঁর মনের সঠিকতা অনুধাবন করা যায় না বলে একেক সময়ে তাকে একেক আঙ্গিকে আবির্ভূত হয়েছেন বলে মনে হয়। এ প্রসঙ্গে অপর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি অধ্যাপক (ডা.) আব্দুল ওহাবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। উনার কাছ থেকে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের নানা বিষয়ে জেনেছি। ২০০১ সালে প্রথম যখন হজব্রত পালন করতে যাই ওহাব ভাই নিজে ইহরাম বাঁধা শেখানোসহ নানা পরামর্শ দিয়েছেন।
পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ দিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনে আমার একজন ঘনিষ্ঠ সুহৃদ। এই ওহাব ভাইও এক সময় ফুল বাবু ছিলেন স্যুটেড ব্যুটেড। তাঁর জীবনেও বড় পরিবর্তন এক সময়ে এসেছে এবং আস্তে আস্তে সব কিছু ছেড়ে জুব্বা পড়েছেন এবং ধর্মীয়ভাবে জীবন কঠোরভাবে অনুশীলন করছেন। তার অতীত জীবনের নানা অধ্যায়ের সঙ্গে আমি পরিচিত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হয়ে প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার ধারক হয়ে সর্বহারা রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী হয়েছিলাম। কমিউনিস্ট হওয়ার বাসনায় ত্যাগকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। সে জন্য জীবনে অনেক ঘটনা দুর্ঘটনায় জড়াতে হয়েছে, সে এক লম্বা ইতিহাস। মেধাবী ছাত্র হয়েও পড়াশোনায় ছেদ পড়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে যেখানে-সেখানে ঘুমিয়েছি যা পেয়েছি, তা খাওয়ার অভ্যাস করেছি। সাধারণ কাপড়-চোপড় পড়েছি, আমাদের বাড়ির কামলার ঘরে তার বিছানায় শুয়েছি। অতি দরিদ্র ক্ষেত মজুর নিঃস্ব-বিত্তহীন মানুষের নিত্যসঙ্গী হওয়ার জন্য কত প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছি। সমাজ পরিবারের ছেলে হয়ে জোতদারের গোলার ধান ছিনিয়ে নেবার জন্য কৃষকদের, দিন-মজুরদেরকে উৎসাহিত করতে কত জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছি।
ঘরের জিনিস মানুষকে দিয়েছি। লোকের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেয়েছি, বিশ্রাম-ঘুম হারাম করে সর্বহারা রাজনীতির দীক্ষায় উজ্জ্বীবিত হয়ে সাধারণ মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলাম। ভোগে নয়, ত্যাগেই মুক্তি। এ আদর্শই ছিল তখনকার জীবন। সাধারণ মানুষের কাতারে মেশার জন্য, শামিল হবার জন্য কত পরিশ্রম করেছি, শ্রেণিচ্যুত হবার লড়াই করেছি। নিজেকে বুর্জোয়া সমাজের ভোগবিলাস থেকে মুক্ত করার জন্য প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে লড়াই করেছি।
একদিকে সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অপরদিকে নিজের মনের বিরুদ্ধে লড়েছি। পড়াশোনার ক্ষতি, সুযোগ-সুবিধা পরিহার এমনকি জেল-জুলুম-নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করেছিলাম। রূপালী ব্যাংক বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম। ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণের দাবিতে ১৯৬৯ সালে আন্দোলন করেছি। সঙ্গত কারণে আশির দশকে বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলেও কখনও চাকরি করতে উৎসাহিত হইনি। অথচ সেই বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করলাম দীর্ঘ সময়। ভাবতেও অবাক লাগে, হিসাব মেলাতে পারি না। নিজেকে অচেনা লাগে নিজের কাছে।
বড়ই বিচিত্র আমাদের এই জীবন। জীবনের বৈচিত্র্যতা পরতে পরতে উপলব্ধি করা যায়। নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা। কত ঘটনাবহুল এই জীবন আমাদের। মনের আয়নায় দেখলে ভেসে ওঠে ঘটনার পর ঘটনা। ঘটনাগুলি সাজালে নিজেরই বিস্ময় লাগে। কখনও কখনও ঘটনার ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায় আবার কোন কোন সময় পরস্পরের বৈপরিত্য দেখতে হয়। অবাক লাগে নিজেকে মনের দর্পণে অচেনা লাগে এ যেন এক অচেনা আগন্তুক, যার সঙ্গে আমার আজই পরিচয় হচ্ছে। এই আমি যেন অন্য কেউ, আমার সঙ্গে এর মিল নেই। ভাবতে থাকি এ তো আমি নই। আমার ছদ্মাবরণে অন্য কারোর উপস্থিতি টের পাই।
আজ সুদীর্ঘ বছর পাড়ি দিয়ে মনে হয় সেদিনের সে চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত এক মানুষ আমি। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধাভোগী বেসরকারি (ধনিক শ্রেণির) প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, চাকরিজীবী হিসেবে এ দেশে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় তার সবই এখন আমার করায়ত্ব। সময় অবস্থান সবই আমাকে পাল্টে দিয়েছে। সেদিনের তুলনায় আমার আজ আমূল পরিবর্তন হয়েছে। খদ্দরের পাঞ্জাবি-পায়জামার জায়গায় আজ ঝেকে বসেছে স্যুট-কোট-টাই ফলশ্রুতিতে চিন্তা-চেতনারও অনেক পরিবর্তন এসেছে। ত্যাগের পরিবর্তে ভোগ-বাসনার আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে- ক্রমান্বয়ে আগ্রহী হচ্ছি। এখন মনে হয় মানুষের জীবনে অনেক কিছু ঘটে, যাতে তার হাত থাকে না। এক সময় বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলাম। ধর্মে বিশ্বাস ছিল না। এখন পুরোপুরি ভাববাদী দর্শনে পূর্ণ আস্থাশীল মহান স্রষ্টার হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না। মানুষকে রাব্বুল আলামিন চেষ্টা করতে বলেছেন কিন্তু সব কিছু নির্ধারণ-নিয়ন্ত্রণ উনিই করেন। জীবনের অতীত দিনগুলি এখন শুধু স্মৃতিমাত্র। হঠাৎ কখন কখন বিশেষ মুহূর্তে এসব অতীত মনে উঁকি মারে। মুহূর্তে আমাকে সে দিনগুলিতে নিয়ে যায়।
আমাদের শেষ গন্তব্যস্থল কবর। মৃত্যুই জীবনের পরিণতি। ক্ষণিকের আবাসস্থল এই পৃথিবী। অথচ এর মোহ অতি মোহনীয় তাই শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও জীবনে চলতে চাই আমরা। যিনি আমাদেরকে এখানে এনেছেন তিনি একমাত্র জানেন কীভাবে পৃথিবীর সময়গুলি অতিবাহিত হবে। আমরা এত অসহায়, যা ভাবার নয়, বোঝারও নয়। আমার মনে হয় সবচেয়ে কঠিন সময় কাটে এই সংসার জীবনে। বিচিত্র ঘটনাবলি সুখ-দুঃখে গড়া এই জীবন। যেখানে দুঃখ-যাতনা আর কষ্ট ভোগই বেশি।
কিন্তু সব কিছুর পরিসমাপ্তি ঘটে মৃত্যুতেই। সব চিন্তা-ভাবনার অবসান টেনে আনে। বন্ধুরা ২-১ জন ফিরে যাওয়া শুরু করেছে। গত ঈদের পরপরই ছোটবেলার বাল্যবন্ধু সদরুল আলম (ডন) আকস্মিকভাবে চলে গেল কোন জানান না দিয়ে। কয়েক দিন আগে ওমরাহ পালন শেষে ঢাকায় ফেরার পথে প্লেনে পত্রিকায় দেখলাম আমাদের সহপাঠী আব্বাস উদ্দিন আফসারী লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া জরুরি। ঘনিষ্ঠ সহপাঠী বন্ধু বিষ্ণুপদ মালাকার দীর্ঘ রোগভোগের পর পরপারে চলে গেল।
সেও চলে গেল। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইলিয়াসের স্ত্রী পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। সবার খবর সব সময় আমরা পাই না। বাল্যকালের সেই দিনগুলির মতো বন্ধুত্বের বন্ধন আর এখন মনে হয় নেই। জীবনের যান্ত্রিকতা সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কর্মজীবনের পরিধিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছি আমরা।
লেখক : সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফার্স্ট সিকিউরিট ইসলামী ব্যাংক লি.