ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বাবা-মায়ের ছবিতে প্রণাম করে দিন শুরু করেন ডা. সামন্ত লাল

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:২৩ এএম, ১৩ মে ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ১০:২৬ এএম, ১৩ মে ২০১৯ সোমবার

ডা. সামন্ত লাল সেন

ডা. সামন্ত লাল সেন

বাবা-মায়ের ছবিতে প্রতিদিন সকালে প্রণাম করে দিন শুরু করেন ডা. সামন্ত লাল সেন। বাবা-মায়ের ছবি রাখেন নিজের মানিব্যাগের পকেটে। নিজের অফিস রুমেও টেবিলের উপর রেখেছেন বাবা-মায়ের ছবি।

যখনই মন খারাপ হয় তখন ছবিখানা বুকে জড়িয়ে ধরেন। তাতে ভেতর থেকে শক্তি পান। যখন কোনো বড় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন বা বড় সমস্যায় পড়েন তখনো হাতে তুলে নেন বাবা মায়ের ছবি। ফলে সমস্যা অতিক্রম করার শক্তি পান তিনি।

ডা. সামন্ত লাল সেন শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির প্রধান সমন্বয়কারী। বাংলাদেশের বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি প্রকল্পের সমন্বয়কারীও তিনি।

তিনি বলেন, মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া আমি সামন্ত লাল সেন আজকের সামন্ত লাল সেন হতে পারতাম না। ছোট বেলা থেকে মায়ের আশীর্বাদ আমাকে আগলে রেখেছিল। এখনো মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে পথ চলি। তিনি আমার আজকের এ অবস্থা দেখে যেতে পারেন নি। তবে আমি বিশ্বাস করি, তিনি আমাকে উপর থেকে দেখছেন। আমার যা কিছু অর্জন, যা কিছু কর্ম সব বাবা-মায়ের আশীর্বাদের ফসল।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনের কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডা. সামন্ত লাল সেন এসব কথা বলেন।

মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার মা একজন সাধারণ নারী ছিলেন। খুব বেশি পড়াশুনা তার ছিল না। তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, "বাবা তুমি যদি গরীব মানুষের জন্য কিছু কর তাহলে আমার আত্মা শান্তি পাবে।" মায়ের সেই কথা আমাকে অনুপ্রাণিত করে মানুষের জন্য কিছু করতে।

ডা. সামন্ত লাল সেন আলাপকালে বলেন, যারা বাবা মাকে সম্মান করে, তারা কখনো কোথাও আটকাবে না। তাদের জীবন সম্মানের হবে। তাদের জীবন মহিমান্বিত হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের প্রধান ডা. সামন্ত লাল সেন। নবগঠিত শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়কারী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও তার বিভাগ বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি কিন্তু চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে যে কেউ তার কাছে গেলে পাশে দাঁড়ান তিনি।

দেশের চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর খুব আস্থাভাজন ডা. সামন্ত লাল সেন। সাম্প্রতিক সময়ে প্রয়াত শিল্পী সুবীর নন্দীর চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দেখভাল করেছিলেন তিনি। তাছাড়া চলচ্চিত্রভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানেরও দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সেই দেখভালের সর্বশেষ অবস্থা প্রতি মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করার দায়িত্বও পালন করছেন ডা. সামন্ত লাল সেন।

১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছিলেন ডা. সামন্ত লাল সেন। ইন্টার্নশীপ করার পর পার করেছেন দীর্ঘ যাত্রা।

ডা. সামন্ত বলেন, আমরা যখন এ পেশা শুরু করি তখন খালি চোখে অপারেশন করতে হতো। এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে অপারেশন হয়।  এখন ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতির সাপোর্ট অনেক বেশি। সব এখন আধুনিক। ডাক্তারি করাটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। আমাদের সময়ে অনেক কঠিন ছিল। ম্যানুয়েলের উপর নির্ভর করতাম তখন।

আগে আমরা হাত দিয়ে ব্লাড প্রেসার দেখতাম, নাড়ী দেখতাম। এখন সব কম্পিউটারাইজড। সব কম্পিউটারে দেখা যায়।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আমাদের সময়ে চাপ খুব কম ছিল। যেহেতু মানুষ বেড়েছে ফলে রোগীও বেড়েছে। এখন চাপ খুব বেশি। নিজের পরিচালনাধীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এখানে ছয়-সাতশ রোগী। কিন্তু বিকালে ডাক্তার থাকে মাত্র দু`জন। মাত্র দু`জন ডাক্তার দিয়ে এতোগুলো রোগী দেখা খুব কঠিন কাজ। ফলে না চাইতেও অনেক সময় রোগীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতি হয়ে যায়। তবু আমি আমার ডাক্তারদের বলি, আমরা ডাক্তার। আমরা যদি একটু ধৈর্য্য ধরি, মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করি তাহলে মানুষ আমাদের মাথায় তুলে রাখবে।

দেশের ডাক্তারদের গুণগত মান প্রসঙ্গে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, শিক্ষাগত মান বা দক্ষতা কোন দিক দিয়েই আমাদের দেশের ডাক্তাররা অন্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে নেই বলেও মনে করেন ডা. সামন্ত লাল সেন।

তিনি বলেন, ইন্টারনেটের যুগে এখন চর্চার সুযোগ বেশি। ফলে কাউকে ছোট করে দেখার বা পিছিয়ে আছে ভাবার সুযোগ নেই। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের ডাক্তাররা এগিয়ে আছে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সাথে আলাপকালে ডা. সামন্ত লাল সেন আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের সমস্যাটা হলো আমরা পারিপার্শ্বিক সহযোগিতা পাই না। আমাদের লজিস্টিক সাপোর্ট নেই। প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী সুবীর নন্দীর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, সুবীর নন্দীর হার্টের অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিল বাংলাদেশি ডাক্তাররা আমাকে স্পষ্ট বলেছেন, তাকে কিছু করার জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতির যে সাপোর্ট দরকার তা আমাদের দেশে নেই। ডা. সামন্ত বলেন, আমরা যদি লজিস্টিকস সাপোর্ট ম্যানেজ করতে পারি তাহলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক এগিয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ব্যাপারে আন্তরিক এমন প্রসঙ্গ টেনে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার চোখের অপারেশন দেশে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা ( ডাক্তার) নার্ভাস হয়ে যাওয়ায় তিনি তা করেন নি। ওনার কখনো শরীর খারাপ করলে বা যে কোন চিকিৎসার ব্যাপারে ওনার মায়ের নামে যে হাসপাতাল তিনি সেখানে যান। আমি যেটা বিশ্বাস করি, তিনি এদেশের ডাক্তারদের উপর আস্থাশীল।

এদেশের রোগীদের চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। সিঙ্গাপুর যাওয়ারও প্রবণতা আছে। এমন প্রসঙ্গে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আমাদের ( ডাক্তার) প্রতি রোগীদের বিশ্বাস কম। এটা বাড়াতে হবে। আর বাড়াতে হলে রোগীকে সময় দিতে হবে। কিন্তু রোগীর এতো চাপ সরকারী হাসপাতালে সময় দেওয়া কষ্টসাধ্য। বেসরকারী হাসপাতালগুলোও যদি এ ব্যাপারে ভাবে তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ডাক্তার যদি রোগীকে সময় দেয়, তার কথা শুনে,  ভাল ব্যবহার করে তাহলে রোগীরা চিকিৎসার জন্য দেশের হাসপাতালেই যাবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সাথে আলাপের এক পর্যায়ে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের রোগীরা চিকিৎসার জন্য সবাই ঢাকামুখী। সামান্য একটা গলব্লাডার অপারেশনের জন্য সবাই ঢাকা মেডিকেলে ভীড় করে। আজকাল ফুটো করে যেসব অপারেশন হয় সেগুলো উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও করা যায়। কিন্তু মানুষ টাকা পয়সা সময় খরচ করে ঢাকায় ছোটে। আমি মনে করি, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর দরকার আস্থা ফিরিয়ে আনা। রোগীদের বিশ্বাস অর্জন করা। তবে শুধুমাত্র ডাক্তার একা এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে না।  এখানে প্যারামেডিকস বা নার্সদের বড় ভূমিকা আছে। প্রশাসনের ভূমিকা আছে। এমনকী যে সুইপার তারও ভূমিকা আছে।

শত সমস্যার মাঝেও আশার আলো দেখেন ডা. সামন্ত লাল সেন। তিনি বলেন, আমার চিকিৎসক জীবন যখন শুরু হচ্ছিল, তখন পাঁচটি বেড ছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে তখন ডা. ক্রাস্ট এসেছিলেন। তিনি একজন প্লাস্টিক সার্জন নিয়ে এসেছিলেন। আমরা তখন ছোট একটা রুমে বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট শুরু করেছিলাম। সেই পাঁচ থেকে পঞ্চাশ, তারপর একশ, এরপর ধীরে ধীরে পাঁচশ। আমি প্রায়ই বলি বাবার হাতে পাঁচ, মেয়ের হাতে পাঁচশ। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর হাতে পাঁচ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে পাঁচশ।

পাঁচ থেকে পাঁচশ - এই অবস্থানে বার্ণ ইউনিটকে পৌঁছাতে ডা. সামন্ত লাল সেনকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। মুখ বুঁজে সইতে হয়েছে অপমান। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি যখন ফাইল নিয়ে এ টেবিল থেকে ও টেবিলে দৌড়াদৌড়ি করতাম, তখন অনেকে বলেছিল, "ওনি এসব ধান্ধা করছেন। সব টাকা পয়সা নিয়ে এক সময় ইন্ডিয়া চলে যাবেন"।

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আজ আমি তৃপ্ত। পরিশ্রম বৃথা যায়নি। আজ যেখানে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন অব বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়েছে জায়গাগুলো এক সময় বস্তি ছিল। সেই বস্তি সরিয়ে সেখানে হাসপাতাল করা হয়েছে।

চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ডা. সামন্ত বলেন, এর প্রতিষ্ঠার পেছনে তাদের ভূমিকা আছে। তারাই জায়গাটা খালি করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু চাকরিটা এখনো স্থায়ী হয়নি। আমি চেষ্টা করছি তাদের চাকরিটা স্থায়ী করানোর জন্য।

আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা নিয়ে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ বার্ণ অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতাল। পাঁচশ শয্যার এ হাসপাতালটি আগামী মাসের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে নবগঠিত চালু হবে বলে জানালেন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন।

তিনি বলেন, পুরোপুরো হয়তো একসঙ্গে চালু করা সম্ভব হবে না। প্রথমে আউটডোর ও তারপরে ইনডোর এভাবে আস্তে আস্তে চালু হবে। নবগঠিত এই হাসপাতালে বারোটি আধুনিক মডিউলের অপারেশন থিয়েটার ও স্কীন ব্যাংক থাকবে বলেও জানান ডা. সামন্ত লাল সেন।

আআ//