ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

কৃষকদের নিয়ে ভাবতে হবে এখনই

শামসুল হক

প্রকাশিত : ০৭:১৭ পিএম, ১৩ মে ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৫:৩০ পিএম, ১৪ মে ২০১৯ মঙ্গলবার

কয়েক দিন আগে ধান ক্ষেতে আগুন দিয়েছেন এক কৃষক। টাঙ্গাইলে এই কৃষক ধানের দাম কম হওয়ায় ধান ক্ষেতে আগুন দেন বলে দেশের প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমগুলোয় উঠে এসেছে। ওই কৃষক অভিযোগ তুলেছেন, ধানের দাম কম এবং ধান কাটার জন্য কৃষাণের মূল্য বেশি হওয়ায় তিনি মাঠ থেকে ধান না কেটে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, এক মন ধানের দাম ৫০০ টাকা আর একটি কৃষি মজুরির মূল্য ৫০০ থেকে ৮৫০ টাকা এলাকা ভেদে। ফলে মাঠ থেকে ধান কেটে নিয়ে আসলে তার লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে বলে তিনি মনে করছেন।

এটা শুধু টাঙ্গাইল জেলার চিত্র নয়, এটা সারা বাংলাদেশের খণ্ড চিত্র বলে অনেকেই মনে করছেন। সব সময় একটা কথা বলা হয়ে থাকে কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। এক অর্থে অনেকেই মনে করেন, কথাটি সত্য। বিশ্বের সব দেশের কৃষকদের কদর করা হয়। কারণ তারাই মুলত খাদ্যের যোগান দিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই অধিকাংশ মানুষ বলে থাকেন কৃষককের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করা দরকার। আমাদের দেশের নেতাকর্মীরা প্রায় সময় সভা-সমাবেশে কৃষকদের উন্নয়নের কথা বলে থাকে। আসলে কতটা উন্নয়ন করেছেন বা করার জন্য আগ্রহী এটা নিয়ে যতেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মনেই। প্রকৃত পক্ষে কি নেতাকর্মীরা কি দেশের কৃসকদের উন্নয়ন চান? চাইলে কি ধরনের উন্নয়ন চান? এটা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। কৃষকদের কথা তুলে ধরছেন অনেকেই। কৃষকদের দুর্দশার কথা তুলে ধরছেন। তাদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করছেন ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হয় প্রায় প্রতিবছর। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বোনাস নিয়ে বেশ মাতামাথি দেখা যায়। বেতন ছাড়াও বিভিন্ন সময় তাদের বোনাস দেওয়া হয়। দুই ঈদে সরকারি চাকরিজীবীদের বোনাস দেওয়া হয়। এছাড়াও বৈশাখী ভাতাও দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষকদের জন্য সরকার বা সংশ্লিষ্টরা কি করছেন? তাদের জন্য কি কোনো ব্যবস্থা করতে পারে না সংশ্লিষ্টরা।

দেশের কয়েকটি সংবাদ পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের কল্যাণে জানা যায়, টাঙ্গাইলের ওই ঘটনা।

ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতীর আব্দুল মালেক সিকদার নামের এক কৃষক নিজের পাকা ধানে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

ওই জেলার উপজেলার পাইকড়া ইউনিয়নের বানকিনা এলাকায় তিনি ধান ক্ষেতে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। মালেক সিকদারের এই প্রতিবাদে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন এলাকার অধিকাংশ কৃষক। পাকা ধানে আগুন দেখে অনেকেই ছুটে আসেন।

এ বিষয়ে মালেক সিকদার বলেন, প্রতি মণ ধানের দাম থেকে প্রতি শ্রমিকের মজুরীর দাম দ্বিগুণ। এবার ধান আবাদ করে আমরা মাঠে মারা পড়েছি। তাই মনের দুঃখে পাকা ধানে আগুন দিয়েছি।

এদিকে কালিহাতীর আউলটিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান মজনু নামের আরেক কৃষক তার ক্ষেতের পাকা ধান এলাকাবাসীকে বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছেন। এলাকাবাসী ধান কেটে অর্ধেক অংশ নিজে এবং বাকি অর্ধেক অংশ ক্ষেত মালিককে দিয়ে দিচ্ছেন।

এটা শুধু টাঙ্গাইল জেলার নয়, এই চিত্র সারাদেশের কৃষকদের। এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে দেশের কৃষকরা বলে কৃষকরা অভিযোগ করছেন। কৃষকরা দাবি করছেন, তাদের দিকে কেউ নজর দেয় না। তারা রোধে-বৃষ্টিতে পুড়ে ফসল ফলান কিন্তু তারা সুখে নেই। তারা তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে পারছেন না। তারা তিন বেলা ভালোভাবে খেতে পারেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সম্প্রতি এক কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর এক  মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। ফলে এক মণ ধান বিক্রি করে এক কেজি মাংসও কিনতে পারছেন না একজন কৃষক। অনেক কৃষক ইলিশ মাছের স্বাদ ভুলে গেছেন বলে মনে  করেন অনেকেই। একটা বড় ইলিশ এক থেকে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে তা একজন প্রান্তীক কৃষকের পক্ষে কেনা সম্ভব নয়। কৃষকরা ভালো খাবার না খেতে পেরে পুষ্টিহীন জাতিতে পরিণত হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

বর্তমানে এক মণ ধান উৎপাদন করতে যে পরিমান খরচ হয় তা বিক্রি করে উঠে না। ফলে ধান উৎপাদন করা থেকে বিরত রয়েছেন ইতোমধ্যে অনেক কৃষক। কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলছেন অনেকেই। ইতোমধ্যে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে যেটা খুবই সামান্য। আর এই প্রণোদনার অর্থ মুলত প্রান্তীক কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না বলে অনেক কৃষক অভিযোগ করছেন।

কয়েকজন কৃষকরে সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে পরিমাণ প্রণোদনা দেওয়া হয় তা সরকারি আমলাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে  শেষে কৃষকদের হাতে পৌঁছে যতসামান্য। তাদের সরাসরি দিতে হবে।

অনেক কৃষক অভিযোগ করছেন, তাদের সন্তানদের ভালোভাবে লেখাপড়া করাতে পারছেন না। যারা লেখা পড়া করছেন তারাও চাকরি পাচ্ছেন না। এখন সরকারি চাকরি যেন সোনার হরিণ হয়ে গেছে।  আর এই সোনার হরিণ জয় করার জন্য কৃষকের সন্তানরা হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি চাকরিতে ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় খুব কম বলেই মনে করেন দেশের সিংহভাগ মানুষ। কিন্তু কষ্ট করে পড়াখেলা করার পর কৃষকদের সন্তানরা চাকরি না পেলেও কৃষি ক্ষেত্রেও তারা আত্মনিয়োগ করতে পারছে না। এখন কথায় কথায় বলা হচ্ছে প্রযুক্তির উন্নয়নে উদ্যোক্তা হওেয়ার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে । কিন্তু কৃষি পণ্যের এই দাম কমের জন্য অনেকেই কৃষি ক্ষেত্রে কাজ করতে চাইবে না। কৃষির যদিও কোনো কৃষিপণ্যের দাম রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে বেশ চড়া কিন্তু প্রান্তীক কৃষক দাম পান না। মধ্যস্বত্য ভোগীরাই লাভবান হচ্ছে বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন। আর গ্রাম থেকে কৃষি পণ্য রাজধানী ঢাকা বা বিভাগীয় শহরে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন রুটে দিতে হয় চাঁদা। এটা ফুটে উঠেছে কয়েকদিন আগে একটি সহযোগী টেলিভিশন চ্যানেলের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। এছাড়া দেশের একটি অন্যতম দৈনিকে কয়েকদিন আগে ফুটে উঠেছে দেশের চাঁদাবাজির দৃশ্য। ফলে পণ্যের দাম বাড়লেও কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বরাবরই এটা যেন দেখার কেউ নেই।

দেশের শুধু শোনা যাচ্ছে উন্নয়ন আর উন্নয়ন। হ্যাঁ উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে সবকিছুর বিচার করা মনে হয় ঠিক হবে না। বড় বড় দালান কোটা, বড় বড় ফ্লাইওয়ার, বা ব্রিজ নির্মাণ করে দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যেতে চাওয়া মনে হয় এক অর্থে বোকামিই হবে। দেশের মানুষের উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে হবে। দেশের বড় একটা জনগোষ্ঠীকে পুষ্টিহীন মেধাহীন জাতি তৈরি করে উন্নয়নের শিখরে যাওয়া যাবে না। কৃষক ও তাদের সন্তানদের কথা চিন্তা করতে হবে। দেশের সার্বিক উন্নয়েনের জন্য- কৃষকদের উন্নয়নের কথা চিন্তা করতে হবে। কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নকে বাদ দিয়ে অন্য উন্নয়ন চিন্তা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না।  কৃষকদের জন্য মঙ্গলের জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

যাতে কৃষকরা আর ধান ক্ষেতে আগুন না দেয়। সে ব্যবস্থা করতে হবে সরকার বা সংশ্লিষ্টদের। কৃষকদের তালিকা তৈরি করে তাদের মাসিক কোনো ভাতা দেওয়া যায় কি না, এটা নিয়ে সরকার বা সংশিষ্টরা ভাবতে পারেন এখনই। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে বা সরকারি চাকরিতে কৃষককের সন্তানদের জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা নিয়েও ভাবা যেতে পারে। কৃষকদের কল্যাণে তাদের নগদ কোনো প্রণোদনা দেওয়া যায়ি কি, তাও ভাবা যেতে পারে না। সরকারের উন্নয়নের অংশ করে নিতে হবে কৃষকদের। কৃষকদের উন্নয়ন করতে পারলে, তবে সুষম উন্নয়ন হবে বলেই মনে হয়। তাই কৃষকদের উন্নয়ন নিয়ে সংশ্লিষ্টরা এখনই ভাববেন এমনটাই প্রত্যাশা থাকলো।

 

লেখক: সাংবাদিক।

 

এসএইচ/