মানুষ মানুষের জন্য
এএএম জাকারিয়া মিলন
প্রকাশিত : ০৫:২০ পিএম, ১৪ মে ২০১৯ মঙ্গলবার | আপডেট: ১১:১৩ এএম, ১৫ মে ২০১৯ বুধবার
আমি যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই তা হলো-মানবিক দিক। এর মূল বক্তব্য হলো অন্যের জন্য কিছু করার আনন্দ। কথায় আছে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে। আর এই বিষয়টি পৃথিবী সৃষ্টির একেবারে শুরু থেকে চলে আসছে। আমি মনে করি যে এটা আদি এবং অক্ষয়। যদিও আমরা অনেক ক্ষেত্রে এর অনুপস্থিতি দেখতে পাই। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমার মাঝে আমি এই বিষয়টি জোরালোভাবে ধারণ করি।
ছোটবেলার কথাই বলি, অনেকগুলো ভাই-বোন নিয়ে আমাদের পরিবার। তখন থেকেই আমরা মিলেমিশে থেকেছি। সব কিছুতেই এক ধরনের আন্তরিক সম্পর্ক পারিবারিক বন্ধন কাজ করেছে। আমাদের এই বড় পরিবারে বন্ধন কাজ করেছে। আমাদের বড় পরিবারে এই কোন ভুল বুঝাবুঝি নেই। এমনকি দূরত্বেরও সৃষ্টি হয়নি। চাকরি বা পেশার জন্য যে দূরত্ব হয়েছে তা শুধু অবস্থানের দিক থেকে, কিন্তু মনের দূরত্বের সৃষ্টি হয়নি। সুন্দর একটি বন্ধনে আমরা জড়িয়ে আছি।
এরপর যখন কৈশোরে পদার্পণ করি, যখন বন্ধু শব্দের আবির্ভাব হয়, তখন বন্ধুপ্রীতি আমার মধ্যে বেশ জোড়ালোভাবে কাজ করে। সহপাঠী ও বন্ধুদের সঙ্গে একটা সুসম্পর্ক নিয়ে আমি থাকি। এমনকি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে অনেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত। কথায়, A friend in need is a friend indeed, সে-ই প্রকৃত বন্ধু যে বিপদের বন্ধু। মানুষের সুদিনে শুধু কাছে থাকা নয় বরং দুর্দিনেও কাছে থাকতে হয়।
আমি মানুষের সুদিনে তেমন যোগাযোগ করি না, কারণ সুদিনে অনেকেই কাছে আসে। কিন্তু যখন সে দুর্দিনে পরে সে সময় আমি তার পাশে থাকার চেষ্টা করি ও থাকি। আমার ছোটবেলায়, পাঠশালায়, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং চাকরি জীবনে যেসব বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে সেই পরিচয়টিই দৃঢ় হয়েছে। যাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছে, তা সুসম্পর্কের সঙ্গে আছে। এমন নয় যে কোন বন্ধুর সঙ্গে আমার খারাপ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বন্ধুদের জন্য অনেক সময় আমি নিজেকে সমস্যায় ফেলেছি, এমনকি শাস্তি পেয়েছি। বন্ধুর জন্য কিছু করতে গিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি। সম্ভবত আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র এবং ক্লাসে আমার অবস্থান প্রথম। আমারই এক বন্ধু খুব গুরুতর অন্যায় করেছিল। শিক্ষক জানতে চাইলেন এ ঘটনাটি কে ঘটিয়েছে। সবাই চুপ, কেউ মুখ খুলছে না। স্বভাবতই, আমি যেহেতু ফার্স্ট বয় স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমি জানি কি না কে এই কাজটি করেছে। আমি মনে মনে ভাবি যে, আমি যদি দোষীর নামটি বলে দেই তাহলে সে অনেক মার খাবে। শিক্ষক সাহেব বেশ ক্ষিপ্ত ছিলেন এমনকি আরো ক্ষিপ্ত হলেন যখন আমি তাঁকে কোন উত্তর দিচ্ছি না। পরিণামস্বরূপ শিক্ষক সাহেব ওই দোষীর ওপর রাগটা আমার ওপর দিয়ে মেটালেন।
আমি ছাত্রজীবনে বরাবরই মেধাবী ছিলাম। আমার যে বন্ধুগুলো পড়ালেখায় দুর্বল ছিল তাদেরকে পরীক্ষার সময় বিভিন্ন ধরনের সাহায্য করেছি। ব্যাপারটি সম্ভবত নৈতিকতার ভেতরে পড়ে না তবুও বন্ধুত্বের খাতিরে করেছি। কারণ তখনো স্টুডেন্ট লাইফ ছিল। অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না, শুধুমাত্র আমার বন্ধুর পাস করা ছাড়া।
আমি তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র যখন আমাকে ফোর্স টিসি দেয়া হয়েছিল। এটা আমার কোন অকৃতকর্মের জন্য নয়। আমার বন্ধুর জন্য। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে প্রভাষকের কথা কাটাকাটির রেশ ধরে আমি বন্ধুর পক্ষ নেওয়ায় প্রভাষকের সঙ্গে আরো ঘটনার সৃষ্টি হয়। তার পক্ষ নিয়ে আমি জোরালো পদক্ষেপ নেয়ায় তিনি আরও ক্ষুব্ধ হন। শেষ পর্যন্ত আমাকে ও আমার বন্ধুকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হলো। আমার বাড়ির সন্নিকটের কলেজ ত্যাগ করে আমাকে চুয়াডাঙ্গায় ভর্তি হতে হলো।
আমার স্কুল জীবন থেকেই আমি বন্ধুদের জন্য হেল্পফুল ছিলাম। আর্থিক অসচ্ছলতা বা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা আমার বন্ধুদেরকে নানাবিধভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছি। আমি আমার টিফিনের পয়সা থেকে জমিয়ে কখনো বা তাদের পড়ার জন্য বই কিনে দিয়েছি। কারও টিউশন ফি দিতে সমস্যা হলে আমার সাধ্যের মধ্যে থেকে আমি সহায়তা করেছি। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল কলেজ, তাই মাঝে মধ্যে খাওয়ার সময় তাদের সঙ্গে শেয়ার করেছি আমার খাবার। আমার চেনা কোন বন্ধুর সমস্যার কথা শুনলে আমি ঠিক থাকতে পারতাম না। মনে হতো যেন আমিই বিপদে পড়েছি। গভীর রাতেও যদি কারো বিপদের কথা শুনেছি তার কাছে ছুটে গিয়েছি। সকল বাধা-বিপত্তি পাড়ি দিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।
মানুষ মনের দিক দিয়ে খুব দুর্বল থাকে, যখন কেউ অসুস্থ হয়। আমার একটি অভ্যাসের মধ্যে পড়ে যে আমি অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াই। তাদেরকে দেখতে যাই, কথা বলে সাহস দেই। তার কোন রকম সাহায্য-সহযোগিতার দরকার হলে আমি সাহায্য করি। একসময় আমি রুটিন করার মতো করে ছুটির দিনে আমার পরিচিত অসুস্থ মানুষের সঙ্গে দেখা করতাম।
আমার এই দীর্ঘ জীবনে অনেক ধরনের চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতার লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এই জীবনে কর্মরত অবস্থায় এবং তার বাইরে যে লোকজনের সঙ্গে চলেছি, বসেছি, উঠেছি কখনো কারও সঙ্গে মনোমালিন্য হয়নি। কাউকে পছন্দ না হলে তার উপর কোন ধরনের প্রভাব ফেলিনি। হয়তো বা মনে মনে কষ্ট পেয়েছি। তাই দেখা গেছে তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে এড়িয়ে গিয়েছি।
আমি কখনো কারো কোন ধরনের ক্ষতি হোক চাইনি। কাউকে অপছন্দ হলেও তার কোন ক্ষতি চাইনি, করিওনি। আমার সমগ্র জীবনে আমি এই বিষয়টি পালন করেছি।
আমি আমার ছাত্র রাজনীতি জীবনে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি করতাম। আমি কমিউনিস্ট পার্টির সংশ্রবে ছিলাম। কমিউনিস্টদের যে নীতি, আত্মকেন্দ্রহীন, সবার জন্য মানুষের জন্য কাজ করা। সেখানে ব্যক্তিস্বার্থ খুবই তুচ্ছ বিষয়। ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। হৃদয়কে উন্মুক্ত করা, মানুষকে ভালোবাসা- এই বিষয়গুলো ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যে কাজ করত। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে আমার জীবনে।
সম্প্রতি আমি আমার ধর্ম নিয়ে মনোনিবেশ করছি। আল্লাহ তায়ালার দরবারে বেশি বেশি ইবাদত করার চেষ্টা করছি। আমাদের ধর্মেও বলা হয়েছে যে, তুমি একা সব কিছু ভোগ করো না, এতে তোমার আত্মীয়-স্বজনের অধিকার রয়েছে। তুমি তোমার নিকট আত্মীয় এবং প্রতিবেশীর হক (অধিকার) মেরে খেয়ো না। অর্থাৎ একার জন্য কিছু নয়। একা ভালো থাকবে আর তোমার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকবে, তা প্রশ্রয় দেয় না ইসলাম। যৌবনে কমিউনিজমের যে চিন্তা ধারণ করেছি তার পরিপূর্ণতা খুঁজে পেয়েছি ইসলামে।
যদি উদাহরণস্বরূপ বলি, আমরা পাঁচ ভাই। ভাইদের মধ্যে আমি ব্যাংকিংয়ে। ব্যাংকের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। এমন যদি হতো আমার কোন এক ভাইয়ের অবস্থা খারাপ, স্বভাবতই আমি ভালো থাকতে পারতাম না। আমি যদি আমার ফ্যামিলির পরিচয় দিতে যাই তখন যেন আমাদের সবার স্থানই ভালো থাকে-এটা আমি চেয়েছি এবং আল্লাহ তায়ালার রহমতে সবাই ভালো আছি। সব মানুষের মধ্যে এই গুণটি থাকা উচিত। আমার মধ্যে এই গুণটি থাকার জন্য আমি ভালো অনুভব করি।
উপকার আমাদের মধ্যে কেউ কারও জন্য করতে পারি না। আমাদের ধর্মের কথা, বান্দা তুমি উপকার করার কে? একমাত্র আল্লাহ তায়ালা উপকার করতে পারেন। আল্লাহর হুকুম ছাড়া উপকার তো দূরের কথা, ক্ষতি করাও অসম্ভব। তবুও উপকার করার যে চেষ্টা আল্লাহতায়ালা আমাদের দ্বারা করান, এই চেষ্টার সঙ্গে শরিক হওয়া খুব বড় আনন্দময়। আমার দ্বারা কারো উপকার সাধিত হলে আমি খুব আনন্দ পাই। ঠিক তেমনিভাবে দেখা গেছে যে, যখন ছাত্র রাজনীতি করেছি তখন সাধারণ ছাত্রদের একটি দাবি বাস্তবায়নের জন্য নিজের ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কাজ করেছি।
ঠিক একইভাবে যখন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সংগঠন করেছি, সেখানে সাধারণ কর্মকর্তাদের ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির জন্য কাজ করেছি। বিভিন্ন ফোরামে যখন কাজ করেছি তখন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যেন বেস্ট বেনিফিট পায় তা নিশ্চিত করেছি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকেই একবার আমাদের বোর্ড বলছে আমার বেতন বৃদ্ধির জন্য। তখন আমি বোর্ডকে বললাম যে,আমি যথেষ্ট টাকা বেতন পাই। আমার বেতন বৃদ্ধি করবেন ভালো কথা, কিন্তু আমার বেতন বৃদ্ধির পূর্বে আমার সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ ব্যাংকের অফিসারদের বেতন বেশি না। তাদের বেতন বৃদ্ধি করা দরকার।
তাদের বেতন বৃদ্ধি করার পর আমি আমার ব্যাপারে আপনাদের জ্ঞাপন করবো তার আগে নয়। বিভিন্ন ব্যাংকে যখন কাজ করেছি তখন সহকর্মীদের যে সব সুযোগ-সুবিধা আছে তারা যেন তা পায় সেজন্য এবং তাদের প্রাপ্য পদোন্নতির জন্য আমি কাজ করেছি। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় যেন আমার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও কোনভাবে কম সুযোগ-সুবিধা না পায় সে বিষয়ে সব সময় লক্ষ্য রেখেছি। আমার সঙ্গে কাজ করেছে তাদের বেশির ভাগেরই গৃহ নির্মাণখাতে যে সুবিধা ব্যাংকাররা পায়, তা যেন সবার জন্য হয় তার চেষ্টা করেছি। মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে গৃহ-বসতি হচ্ছে অন্যতম। অন্তত থাকার মতো একটি আশ্রয়স্থল যেন থাকে। বাস্তবক্ষেত্রে যা হয় আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে, যখন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির কিছু হলো, এমনকি মারা গেল তখন বাড়িওয়ার ফিলিংস কাজ করলেও সেই ভালো ভাড়াটিয়া পরিবারের দিকে তাকালে তার দুশ্চিন্তা হয় যে তারা ভাড়া দিতে পারবে কি না? বাড়িওয়ালা নানারকম অজুহাতে তখন ভাড়াটিয়াদের উঠিয়ে দেয়। অর্থাৎ তার জায়গা থেকে চলে যেতে হচ্ছে। তাই অন্তত একটি নিজের জায়গা থাকার মানে নিশ্চিত বসবাস।
আমি যখন যেখানে কাজ করেছি সেখানে আমি বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী উপকৃত হতে পারে এ ধরনের প্রকল্প প্রণয়ন করেছি। সহকর্মীদের সর্বাত্মক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন স্থানে কাজের ক্ষেত্রে এর জন্য আমার সঙ্গে অনেকের অনেক লড়াপেটা হয়েছে। এই ব্যাংকেই দায়িত্ব পালনের সময় সর্বোচ্চ সংখ্যক পদোন্নতি দেয়ায় আমাদের বোর্ড অসন্তোষ প্রকাশ করে নিন্দা জ্ঞাপন করেছে বোর্ড রেজুলেশনে। প্রথমে একটু মন খারাপ হয়েছিল কারণ বোর্ড মিটিংয়ে আমার নির্ধারিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে তারা রাজি হয়েছিল। তার পরেও এটা লিখিতভাবে করা, এটা না করলেও পারতো। বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা করে
দেখার পর আমার মন আর খারাপ রইল না। কারণ কাজটি আমি আমার নিজের জন্য করিনি। যাদের পদোন্নতির জন্য কাজটা করেছি তারা উপকৃত হবে। সুতরাং নিন্দিত হলেও সবার স্বার্থে কাজ করতে পেরে আনন্দিত। আমার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের ভালো বা উন্নয়ন করাকে আমি আমার নৈতিক দায়িত্ব বলে ভাবি। নৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য যদি কেউ নিন্দা জ্ঞাপন করে তাহলে আমার দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। আমি মনে করি এটাই আমার পুরস্কার। এই গুণটি সবারই থাকা বাঞ্ছনীয়।
আমার পরিবারের ক্ষেত্রে তাদের ন্যায্য হক, প্রতিবেশীর হক আদায়ের জন্য কাজ করার দরকার- আমার পরিবারে কারো কোন সমস্যা থাকলে তা জেনে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তার উপকারে আসা উচিত। এই ব্যাপারে সব সময়ই একটি বিষয় কাজ করে যে, কাজটি নীরবে-নিভৃতে সাহায্য করতে হবে। আর সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যে কাজ করা দরকার তা সম্পাদন করা। সরকারি ব্যাংক ছেড়ে বেসরকারি ব্যাংকে যোগদান করার পূর্বের তুলনায় এখানে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাই। রোজগারের টাকা-পয়সাকে কিছু ভাগে ভাগ করি। আমার পরিবারের ভাগ, প্রতিবেশীর ভাগ, আত্মীয়-স্বজনদের ভাগগুলো নিজে নিজে করে ফেলি। বিভিন্ন রকমের যে সামাজিক কর্মকাণ্ড বা বিভিন্ন রকম দুস্থ মানুষের জন্য যে সহায়তা করা দরকার আমি আমার সাধ্যের মধ্যে থেকে তা করি।
ছাত্রজীবনে একসময় যখন আমি ছাত্র রাজনীতি করেছি তখন এবং কর্মজীবনে কাজের জন্য অনেকে সমালোচনা করেছে। শুধু তাই নয়, অনেক ধরনের খারাপ কথাও বলেছে কেউ কেউ। কিন্তু তবুও আমি কারো কোন অমঙ্গল কামনা করিনি। একবারকার ঘটনা, আমি রূপালী ব্যাংক ছেড়ে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ শাখায় আছি ম্যানেজার পদে। একদিন আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য রূপালী ব্যাংকের সহকর্মী এলেন। আমার সামনাসামনি কেউ কখনো খারাপ বলেনি। কিন্তু আমি যখন রূপালী ব্যাংকের অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন করেছি, শুনেছি আমার সম্পর্কে তিনি নানা বাজে কথা বলেছেন। আমি তাঁকে বুঝতে না দিয়ে আমার স্বভাবসুলভভাবে তাঁকে বসতে দেই। চা পানে আপ্যায়ন করি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রূপালী ব্যাংক হতে আর্থিক সহায়তা পেতে আমার সহযোগিতার জন্য এসেছেন। রূপালী ব্যাংকে না থাকার কারণে কিভাবে এটা সম্ভব তাঁর কাছে জানতে চাই। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে আমি বললে তাঁর কাজ ইনশাল্লাহ হবে। এটা তাঁর বিশ্বাস। আমি কোন রকম দেরি না করেই রূপালী ব্যাংকের অথরিটির কাছে যাদের চিনতাম তাদের, বিশেষভাবে অনুরোধ জানালাম তাঁর অনুদানের জন্য। পরে রূপালী ব্যাংক তাঁকে বড় ধরনের অনুদান দিয়েছে। এই ঘটনার পর আমি মনে মনে চিন্তা করেছি যে, আমার তো তাঁর প্রতি রাগ করার অধিকার নেই। কারণ যে ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে গালিগালাজ করেছে সে আমার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছে-অবশ্যই সংকোচ, দ্বিধা নিয়ে বিপদে পড়ে এসেছে। আল্লাহ তায়ালা আমার কাছে তাঁকে পাঠিয়েছেন এটাই আমার প্রাপ্য। তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকতে পারে না। বিষয়টিকে আমি এই দৃষ্টিতে দেখেছি। কেউ আমাকে অবজ্ঞা করেছে আমি তখন ধৈর্য্য ধারণ করেছি। আমি অবজ্ঞাটাকে গায়ে মাখিনি। আবার সেই লোকই কোন না কোনভাবে আমার কাছে এসেছে। কথায় আছে যে, অন্যের জন্য যদি গর্ত করো তবে তুমি নিজেই সেই গর্তে পড়বে। আমরা ছোটবেলায় যেসব খনার বচন পড়েছি তা বাস্তব ক্ষেত্রে সত্য।
আমাকে বিপদে ফেলার জন্য অনেকে নানাবিধ ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করেছে কিন্তু তারা জীবনের দৌড়ে তেমনটা ওপরে উঠতে পারেনি। আল্লাহ তায়ালার রহমতে আমি যে পজিশনে এসেছি তারা তা করতে পারেনি। আমি কখনোই কাউকে গর্তে ফেলার কোন গর্ত খুঁড়িনি। বরং আমার সঙ্গে যখনই এরকম ঘটনা ঘটেছে, আমি তখন তা সহনশীলতার সঙ্গে সুন্দর-স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছি।
মানুষের উপকারের জন্য কাজ করতে পারায় যে আনন্দ আছে তা আমি খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করি। যোগ্য অফিসারদের যে পদোন্নতি হচ্ছে না এই বিষয় নিয়ে আমার মনটা খুব খারাপ। আমি পেরেশানির মধ্যে আছি। তারপর দেখা গেল প্রমোশন হয়েছে। আবার কোন ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের পদে কাউকে উন্নীত করতে চাচ্ছি, সেটা হচ্ছে না। ছয় মাস বা নয় মাস পর যখন আমার মনোনীত ব্যক্তি পদোন্নতি পেয়েছেন-আমার যে কী আনন্দ তা ভাষায় বলার মতো না।
মানুষের জীবনে তার স্ত্রী সবচেয়ে কাছের। কারণ সেসব কিছুই উপলব্ধি করে। কেউ যখন আমাকে গালি দিচ্ছে বা কেউ অপছন্দ করছে তখন কিন্তু আমি তা মুখ বুঝে সহ্য করেছি। আমার স্ত্রী আমাকে তা দেখে বলত যে, আমার নাকি গন্ডারের চামড়া। সারাদিন কাজ করে যখন কর্মক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শরীরে বাসায় ফিরেও যখন আমাকে বেশ প্রফুল্ল অবস্থায় দেখে আমার স্ত্রী আমাকে বলত ব্যাপারটা কী? দেখা গেছে আমার সকল কর্মকর্তার পদোন্নতির জন্য আনন্দ উদযাপন করছি। আমার এই আনন্দে সেও আনন্দিত হয়। আমি যে মানুষের এত উপকারে আসছি তার জন্য সে আমার প্রশংসা করে থাকে।
সর্বোপরি আমি মনে করি যে, একজন হিউম্যান বিইংয়ের মধ্যে এই গুণাবলি থাকা দরকার। এসব গুণাবলি যদি কারো মধ্যে থাকে তবে ব্যক্তি জীবনে একটি পরিবার ভালো থাকতে পারে। সমাজ জীবনে একটি সমাজ ভালো থাকতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক জীবনে যেমন প্রতিষ্ঠান ভালো থাকতে পারে, তেমনি করে রাষ্ট্রীয় জীবনে রাষ্ট্র ভালো থাকতে পারে। পরস্পরের জন্য কিছু করার চেষ্টা এবং অন্যের উপকারে আসার যে আনন্দ তা মধুর-মধুময়।
সবাইকে তার নিজ নিজ জায়গায় থেকে সৎ, পরিশ্রমী, যোগ্য করে তুলতে হবে, তাহলেই নিজের ভালোর সঙ্গে সঙ্গে দেশের উন্নতি সাধিত হবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক-আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা পরিহার করতে হবে। সর্বজনীন কল্যাণের কথা ভাবতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে বাস্তবে প্রতিনিয়ত এর বিপরীত চিত্রের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা- ব্যক্তিস্বার্থ সমষ্টির ঊর্ধ্বে- দলীয় স্বার্থ সমাজের ঊর্ধ্বে স্থান পাচ্ছে- ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বৃহত্তর স্বার্থের জলাঞ্জলি।
লেখক : সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফার্স্ট সিকিউরিট ইসলামী ব্যাংক লি.