ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১৩ ১৪৩১

দুই জোট নিয়ে চরম অস্থিরতায় বিএনপি

মঈন বকুল

প্রকাশিত : ০১:২৫ পিএম, ১৫ মে ২০১৯ বুধবার | আপডেট: ০১:৩৫ পিএম, ১৬ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার

সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ ও নানা ইস্যুতে মান-অভিমানের কারণে ভাঙনের মুখে পড়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোট।

ইতিমধ্যে ২০-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছে বিএনপির দুই দশকের সঙ্গী বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। লেবার পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল জোট ছাড়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে।

এছাড়া অপর জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আলটিমেটাম দিয়েছে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।

এমতাবস্থায় ভাঙন ঠেকিয়ে জোটের ঐক্য অটুট রাখাই বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এমতাবস্থায় দুই জোটকে নিয়ে বিএনপিতে চলছে চরম অস্থিরতা।

এছাড়া বিএনপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যেও চলছে চাপা ক্ষোভ। এক নেতার বক্তব্যের সঙ্গে আরেক নেতার বক্তব্যের কোনো মিল নেই। দলের সিদ্ধান্তহীনতা, শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে অমিল, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ছাড়াও বিভিন্ন কারণে বিএনপির অবস্থা  ‍খুবই নাজুক।

সম্প্রতি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্রের বক্তব্যের অমিল পাওয়া যায়। যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

এছাড়া কোনো সিদ্ধান্তেই অনড় থাকতে পারছেন না দলটির নেতারা। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নেতারা বলেছিলেন দলীয় সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাবেন না।

পরে তারা ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট বেঁধে ২০ দল নিয়ে ভোটে গেছেন।

এরপর ভোটের পর ফল প্রত্যাখ্যান করে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখান থেকে বেরিয়ে জোটের কারও সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই শেষ দিন শপথ নিয়ে সংসদে গেছেন। এছাড়া সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন নিতে যাচ্ছে দলটি। কৌশলগত কারণে বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নেননি।

এখন ওই আসন শূন্য ঘোষণা করায় বিএনপি পুনর্নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। নির্বাচন ও শপথ ইস্যুতে এভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনকে ভালোভাবে নেয়নি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন- কোন পথে বিএনপি।

এছাড়া গত ৬মে ২০ দলের শরিক বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ হঠাৎ জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়ার পর থেকে চরম আকার ধারণ করে বিএনপিতে। পার্থের এ ঘোষণায় হঠাৎ করে ২০-দলীয় জোটে ঝড় শুরু হয়। তবে এ ঝড় ঠেকাতে বিএনপির শীর্ষ নেতারা কালক্ষেপণ না করে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।

এরপরের দিনই ২০ দলের আরেক শরিক দল লেবার পার্টিও ২৩ মের মধ্যে বিএনপিকে ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার আলটিমেটাম দেয়। নতুবা ভিন্ন পথ ধরার হুশিয়ারি দেয় মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন দল। এছাড়া ২০ দলের শরিক আরও কয়েকটি দল বেরিয়ে যাচ্ছে বলে গুঞ্জন শুরু হয়। এরপর থেকে নড়েচড়ে বসেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

শরিকদের ক্ষোভ প্রশমনে গত সোমবার ২০-দলীয় জোটের বৈঠক ডাকে বিএনপি। বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আন্দালিভ রহমান পার্থকে দাওয়াত দেয়া হলেও তিনি যোগ দেননি।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, ২০-দলীয় জোটের ঐক্য অটুট রাখতে তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রীয় নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দ্রুত কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ২০-দলীয় জোটের উল্লেখযোগ্য শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ শুরু করেন। ফলে জোটের অন্যতম শরিক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান ড. অলি আহমদ জোটে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে একটি বিবৃতি দেন। কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমও ২০-দলীয় জোটের ঐক্য অটুট রাখার পক্ষে তার অবস্থানের কথা জানান।

এদিকে ২০ দলের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেও ভাঙনের সুরের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। গণফোরামে ভেঙে আলাদা দল গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। আবার জেএসডি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের বিএনপির সঙ্গ ত্যাগের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এসব দলের নেতাদের অভিযোগ, জোটসঙ্গী হলেও বিএনপি তাদের না জানিয়ে সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব মিলিয়ে চতুর্মুখী সংকটে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে দলটিতে।

ইতিমধ্যে‘অসঙ্গতি’ দূর করার জন্য জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দকে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন ফ্রন্টের অন্যতম শরিক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী।

তিনি বলেছেন, ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। এসব অসঙ্গতি ও কিছু প্রশ্নের উত্তর আগামী এক মাসের মধ্যে সুরাহা না হলে ৮ জুন ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে যাবে বলে চিঠি দেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।

চিঠিতে বলা হয়, ‘জনগণের মনে আপনার (ড. কামাল হোসেন) নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে যেসব প্রশ্ন জেগেছে, তার যথাযথ প্রতিকার ও প্রতিবিধান কামনা করছি। তা না হলে আগামী ৯ জুন অথবা পরবর্তী দু’একদিনের মধ্যে প্রয়োজনে আরও ব্যাপক আকারে বৈঠক করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হব’।

এছাড়া নির্বাচন-পরবর্তী ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোয় ব্যর্থ, প্রহসনের নির্বাচনী নাটক প্রত্যাখ্যান পরবর্তী সময়ে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মদের এবং এর পরে গণফোরামের মোকাব্বির খানের শপথগ্রহণ, তাকে গেটআউট বলে বের করে দেয়া, পরবর্তীতে তাকে আবার দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে সামনের সারিতে বসানো নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, শপথ ইস্যুতে ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের মধ্যে চলছে মনকষাকষি। শরিকদের না জানিয়ে বিএনপির ৫ সদস্য শপথ নেয়ার বিষয়টি মানতে পারছে না দলগুলো। আ স ম আবদুর রবের জাসদ, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যও এ বিষয়ে নাখোশ।

এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘৩০ ডিসেম্বরের মতো একটি ফ্রড নির্বাচনের পরও গত চার মাসে আমরা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারিনি। উল্টো সংসদে যোগদান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুতরাং এগুলো নিষ্পত্তি হতে হবে। তা না হলে ঐক্যফ্রন্টের সামনে এগোনো কঠিন।’

তবে তিনি বলেন, ‘যে ধরনের ভয়ংকর এক স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় আছে তাতে জোট ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি।’

গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংকট থাকলেও আলোচনা করে সেগুলো নিষ্পত্তি করা যায়। কাদের সিদ্দিকীকে যথাযথ ব্যাখ্যা দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

তিনি বলেন, ‘আশা করি দেশের সংকটকালের কথাও তিনি বিবেচনায় নেবেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে যাবেন না।’

সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘যে যত কথাই বলুক, কে কোথায় যাবে? যাওয়ার কোনো জায়গা আছে? সরকার তো সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে ফ্রন্ট বা বিএনপিকে ছেড়ে গেলেই রাতারাতি সব সমস্যা সমাধান হবে না। জোটে থেকেই লড়াই করতে হবে।’

এদিকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বীরপ্রতীক বলেন, ‘আমরা ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে যাব এ কথা বলিনি। বরং আমরা ফ্রন্ট শক্তিশালী করার পক্ষে। তবে যে অসংগতিগুলো নির্বাচনের আগে ও পরে হয়েছে সেগুলো দূর করতে বলেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা জোটে থাকব কি না সেটি বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’