রমজান যেভাবে সংযম শিক্ষা দেয়
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৫২ পিএম, ১৬ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার
সারা বছর আমাদের শরীর এবং মনের ওপর যে আবর্জনার আস্তর জমে তা পুড়িয়ে ফেলে সুস্থতা আর শুদ্ধতার সন্ধান দেয় রমজান। রমজান শব্দটি আরবি রমজ ধাতু থেকে এসেছে। যার অর্থ পুড়িয়ে ফেলা, দহন করা, জ্বালিয়ে দেয়া। প্রত্যেক সুস্থ ও সক্ষম মুসলমানের জন্যে এ মাসে রোজা রাখা ফরজ। রোজা হচ্ছে দ্বিমুখী- দেহশুদ্ধি এবং অন্তরশুদ্ধি। না খেয়ে থাকাটা রোজার একটা অংশ। রোজার আরেকটি অংশ হলো- গীবত, রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, ঈর্ষা অর্থাৎ যে অন্যায় মানুষের মনকে কলুষিত করে তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। পানাহার বর্জনের পাশাপাশি এ মাসে আমরা যখন আমাদের আচরণে, কথায় ও কাজে সংযমের পরিচয় দেই তখন প্রকারান্তরে বাকি ১১ মাস আমরা সংযমী থাকার, ভালো থাকার প্রস্তুতিটাই সেরে নেই। রোজার শারীরিক উপকারিতা-
রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, ‘তোমরা রোজা রাখো যেন সুস্থ থাকতে পারো।‘ অনেকের ধারণা রোজা শরীরকে দুর্বল করে দেয়। অথচ সম্প্রতি গবেষণাগুলো উঠে আসছে রোজা রাখার শারীরিক উপকারিতা নিয়ে চমকপ্রদ সব তথ্য।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জাপানের অটোফেজি গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি। রোজা বা উপবাসে সাময়িক খাদ্য সংকটকালে দেহকোষের অভ্যন্তরে সৃষ্ট টক্সিনগুলোর বিনাশ ঘটে। এই প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম অটোফেজি।
জাপানের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইউশিনোরি ওসুমির গবেষণা অনুসারে অটোফেজি চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকে যখন দেহ ১২-১৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকে। এই গ্রীষ্মকালের দীর্ঘ সময়ের রোজা বেশি উপকারি।
রোজা রাখলে যার দেহে রক্তের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল রয়েছে তা কমে যায়। আলঝেইমার হান্টিংটন পার্কিংসন্স এবং মস্তিষ্কের বয়সজনিত রোগগুলোর ঝুঁকিও কমে যায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। উচ্চ রক্তচাপ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি এবং আলসারের সমস্যাও কমে যায় রোজা রাখলে। ওজন কমাতে চাইলে ডায়েটিং-এর চেয়ে রোজা বা উপবাস বেশি কার্যকরী।
এছাড়া রমজান মাস দুহাত ভরে পাওয়ার মাস। নবীজী (স) বলেছেন, যে জীবনে রমজান মাস পেল কিন্তু তার ভুল-ত্রুটি অন্যায় পাপাচার থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না, সে নিশ্চয়ই হতভাগা।
রমজান মাসে মহান প্রভু তার বিশেষ অনুগ্রহে প্রত্যেকটি ভালো কাজের সওয়াব বা বরকত ৭০ গুণ বা তার বেশি পরিমাণ দিয়ে থাকেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ মাস খাদ্য সংযমের মাস, পরিমিতিবোধের মাস, আত্ম উপলব্ধির মাস। কিন্তু বেনিয়াদী পুঁজিবাদীদের দিয়ে প্রভাবিত হয়ে আমরা অনেকে ভোগের উৎসবে মেতে উঠি। সংযমী হয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধির চেয়ে খাবারে, কেনাকাটায় বা আচরণে অসংযম, আসক্তি বা অস্থিরতা এখন দৃশ্যমান।
কিছু ভ্রান্ত ধারণা অনেকের মধ্যেই ছিল বা এখনও আছে। যেমন ১. রমজানে খাবারের কোনও হিসাব দিতে হয় না। ২. সারাদিন কিছু খাব না তাই ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত যত পারো গলধঃকরণ করো। ৩. রোজা শরীরকে দুর্বল করে দেয় ইত্যাদি।
আসলে এই সব ভ্রান্ত ধারণাগুলোর জের ধরেই রমজানকে ভোজন উৎসবের মাসে পরিণত করেছে এক শ্রেণির মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী। রোজাদারেরাও সারাদিন খায়নি ভেবে দেদারসে কিনে নেয় এই সব খাবারের নামে আবর্জনাকে, যা মূলত স্বাস্থ্যের জন্যে ভয়ানক ক্ষতিকর এবং রমজানের শিক্ষার পরিপন্থী। বিশেষ করে খালি পেটে এ সব ভাজাপোড়া একেবারেই স্বাস্থ্যকর বা সহনীয় নয় শরীরের জন্যে।
হযরত আনাস ইবনে মালিকের (রা) বর্ণনা থেকে জানা যায়, নবীজী ইফতার করতেন তাজা খেজুর দিয়ে, যদি তাজা খেজুর না পাওয়া যেত তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে আর যদি তা-ও না পাওয়া যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করে। (আবু দাউদ) এরপর তিনি মাগরিবের নামাজ পড়ে নিতেন।
ইফতারিতে রকমারি অস্বাস্থ্যকর ভাজাপোড়া পরিবর্তে শুধু খেজুর পানি খান। এরপর মাগরিবের নামাজ পড়ে নিন। তারপর রাতের খাবার গ্রহণ করুন। রাতের খাবারে ভাতের সঙ্গে মাছ (বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ), মুরগীর মাংস, ডাল, ডিম ইত্যাদি খেয়ে নিন। রেড মিট বা গরু খাসির মাংস বর্জন করাই ভালো। এ-ছাড়া মৌসুমী ফল, কাঁচা ছোলাও খেতে পারেন।
অনেক গৃহিণী রমজানে সারামাস জুড়ে ইফতারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মুখরোচক খাবার প্রস্তুতে তাদের সময়, শ্রম ক্ষয় করে। তাই স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারের সিদ্ধান্ত নিন। এতে আপনার সময় বাঁচবে। ইফতারের আগের মুহূর্তগুলো দোয়া কবুলের মুহূর্ত তখন আপনি ইবাদতে মনোযোগী হতে পারবেন। ইফতারের আগের সময়টিতে পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে বসে স্রষ্টার স্মরণে বা দোয়ায় নিমগ্ন হোন।
সেহরিতে বেশি বেশি খাবার বা প্রোটিন গ্রহণ করলে সারাটা দিন পানির তৃষ্ণায় কষ্ট হয়। অন্যদিকে শাকসবজি দিয়ে হালকা সেহরি সারাটা দিন ঝরঝরে প্রাণবন্ত রাখতে সহায়তা করে। তাই সেহেরিতে ভাতের সঙ্গে শুধু সবজি খান। আবার ভাতের পরিবর্তে দই চিড়া খেজুর কলাও খেতে পারেন। আর ভোজন দাস হবো না। আরেকটু খেতে পারি এ সময়েই খাওয়া বন্ধ করুন। এটিই নবীজী (স) এর শিক্ষা। রমজানে যত প্রাকৃতিক খাবার খাব রমজান শেষে আমাদের বাড়তি ওজন কমে যাবে এবং দেহ-মনে আসবে সজীবতা।
বিলাসবহুল হোটেল/ রেস্তোরা / খাদ্যমেলায় ইফতার পার্টিতে অংশ নেবেন না। দাওয়াতে গেলেও ভাজা-পোড়া তৈলাক্ত খাবার কৌশলে অথবা নীরবে এড়িয়ে যান।
রমজানে খাবারের সংযমের পাশাপাশি আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, কেনাকাটায় সংযম। যেই জিনিসের দাম রমজানের আগে এক, তা-ই তিন গুণ দামে বিক্রি হয় পুরো রমজান মাস জুড়ে। তা জেনেও আমরা পণ্য কেনার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ি ঈদ উপলক্ষে। সেহরির আগ পর্যন্ত মার্কেটে জমপেশ কেনাকাটা চলে। ফলে ইবাদত বন্দেগীর পরিবর্তে রাতেই এই সময়টিকে কেনাকাটার জন্যে বেছে নেয় অনেক ক্রেতারা। আর ঈদ উপলক্ষে স্পেশাল ছাড়/ অফার তো আছেই। কেনাকাটাকে সহজ করার নামে অনলাইন শপিং আর ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বর্তমানে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। রমজান শুরুর আগেই ঈদের কেনাকাটা সেরে নিন। এতে আপনি ও আপনার পরিবার পবিত্রতার অনুভূতি নিয়ে উদযাপন করতে পারবেন সুন্দর একটা মাস। ফলপ্রসু হবে আপনার ইবাদত।
আর ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি আর ভুল বিনোদনের খপ্পরে পড়ে আমরা অনেকেই ইফতারের পর টিভি সিরিয়াল, স্মার্টফোন কিংবা সোশাল মিডিয়ার সামনে নিজেদের এলিয়ে দেই। ভার্চুয়াল আসক্তি আমাদের পরিণত করছে পরিবারবিচ্ছিন্ন, আত্মবিশ্বাসহীন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। স্মার্টফোন থেকে ইউটিউব, ফেসবুকসহ যাবতীয় সামাজিক যোগাযোগ ও ভার্চুয়াল গেম অ্যাপগুলো ডিলিট করুন। রমজানে টিভি ও মোবাইল স্ক্রিন থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখুন। ভার্চুয়াল ভাইরাস থেকে মুক্তির এ সংযম আপনাকে সবসময় আল্লাহর রহমতের ছায়ায় রাখবে।
ধরুন, সারাদিন রোজা রেখে কষ্ট করে এক টিলা পরিমাণ সওয়াবের অধিকারী হলেন ঠিকই কিন্তু দিনশেষে এক পাহাড় পরিমাণ পাপের বোঝা মাথার ওপর জমে বসল। কেমন লাগবে তখন? গীবত বা পরচর্চা এভাবেই আমাদের ভালো কাজের বরকতকে নিঃশেষ করে দেয়। শুধু তাই নয়। রমজান মাসে ধৈর্য্য অনুশীলনের মাস। এ মাস সব প্রকার দুর্ব্যবহার, অসংযমী আচরণ, অশ্লীলতা থেকে নিজেদের রক্ষা করার শিক্ষা দেয়। নবীজী (স) বলেছেন, রোজা অবস্থায় কেউ যদি গালি দেয় বা খারাপ আচরণ করে তাহলে বলতে হবে, আমি রোজা রেখেছি। অর্থাৎ খারাপের বিপরীতেও ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে বলেছেন তিনি। প্রার্থনা করি গীবতমুক্তি/ পরচর্চামুক্তির মাধ্যমে এবারের রমজান যেন শুদ্ধতার সুবাতাস ছড়িয়ে দেয় আমাদের মনে।
প্রতিটি কাজে স্রষ্টার বিধান খেয়াল রাখা মানেই আল্লাহ-সচেতনতা। কোরআন চর্চা এ সচেতনতা বাড়ায়। ফজরের নামাজের পর বা সারাদিনে অন্তত ৩০ মিনিট পড়ুন আল কোরআন ও বাংলা মর্মবাণী। আল্লাহর মহিমা ও গুণাবলি নিয়ে ভাবুন। সময় পেলেই কোরআনের অডিওগুলো শুনুন।
জীবনকে সুন্দর অর্থবহ পরিতৃপ্তিময় ও বিকশিত করার জন্যে কোরআনের জ্ঞানের কোনও বিকল্প নাই। একজন মানুষের জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়, উপকারি ও কল্যাণকর কাজ হচ্ছে কোরআনের জ্ঞান অর্জন করা। কোরআনকে বলা যেতে পারে সুখী জীবনের ম্যানুয়াল। কোরআনের জ্ঞান অর্জনের জন্যে একজন মানুষ যে সময় ব্যয় করে তা হচ্ছে নিজেকে দেয়া জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। রমজান মাসেই কোরআন নাযিল হয়েছে যে কারণে এ মাসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব এত বেশি।
রসুলুল্লাহ (স) এর দৃষ্টিতে তিনিই উত্তম যিনি নিজে কোরআনের আলোয় আলোকিত হন এবং অন্যদেরকে কোরআনের আলোয় আলোকিত করেন। কোরআনের জ্ঞান নিজে জানা যেমন ফরজ, তেমনি অন্যকে জানানোও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। সাহাবীরা একটি নতুন আয়াত শোনার পর ছুটোছুটি শুরু করতেন কে কার আগে কত মানুষের কাছে এ বাণীকে পৌঁছে দিতে পারেন। তাই রমজান মাসে যে-কোনও বিশেষ নিয়তে কমপক্ষে ৪০ কপি বাংলা মর্মবাণী বিতরণ করুন। মৃত আত্মীয়-স্বজনের মাগফেরাত কামনায়, সমস্যামুক্তি ও বালামুসিবত থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে কমপক্ষে ৪০টি মর্মবাণী এ রমজানে বিতরণ করুন। একটি মর্মবাণী বিতরণ ১*৭০*৭০ = ৪৯০০ টি মর্মবাণী বিতরণের সমান সওয়াব পাবেন। বাংলা মর্মবাণী বিতরণে আপনি স্রষ্টার রহমতকে অনুভব করবেন। যাদেরই স্মার্টফোন আছে আল-কোরআনের অ্যাপস ডাউনলোড করুন এবং অন্যদের সঙ্গেও শেয়ার করুন।
সবসময় হাতের কাছে মর্মবাণী রাখুন। ইফতারের আগে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আল কোরআনের দোয়ার অডিও ট্র্যাকটি শুনুন। রমজানে একবার কোরআন মর্মবাণী খতম করুন।
যাকাতদাতা হওয়া অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। রূপার বর্তমান বাজারদর হিসেবে আপনার কাছে যদি ৪৫ হাজার টাকা একবছর সঞ্চয় থাকে তাহলে আপনি সৌভাগ্যবান যাকাতদাতা। আসলে যাকাত দিলে সম্পদ বাড়ে।
আসলে রমজান হলো ইবাদতের মৌসুম। হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রমজান মাস এসেছে কি না তা আমরা রসুলুল্লাহকে (স) দেখে বুঝতে পারতাম। অর্থাৎ অন্য সময়ের তুলনায় এ মাসে তার ইবাদত বন্দেগি বেড়ে যেত। যার ফলে অন্যরা তাকে দেখে বুঝতেন যে, এখন রমজান চলছে। রমজান অত্যন্ত বরকত নিয়ে আসে। তাই রমজানের প্রথম ১০ দিন রহমত/ দয়া কামনা করে, দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফেরাত/ ক্ষমা চেয়ে এবং তৃতীয় ১০ দিন নাজাত/ পরিত্রাণের জন্যে দোয়া করুন।
রমজান পালনের পর আমরা যেন নতুন এক আলোকিত মানুষে রূপান্তরিত হতে পারি এই প্রাথর্ন পরম করুণাময়ের দরবারে।