ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় হলে ভোগান্তি কমবে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৪৮ পিএম, ১৭ মে ২০১৯ শুক্রবার

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, নাগরিক সেবা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে পারলে জনগণের ভোগান্তি কমে আসবে। আর এই সমস্যা নিরসনে সিটি করপোরেশনের মতো অন্যান্য সংস্থাগুলোকেও দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। 

শুক্রবার রাজধানী ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে মেয়র হিসেবে চার বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। এসময় তিনি উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেন।

সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে জনগণের কাছে সেবা সঠিকভাবে পৌঁছেনো যাচ্ছে না বলেও মনে করেন তিনি।   

তিনি বলেন, অনেক সময় রাস্তায় আমরা কাজ করছি, কাজ চলাকালে জনগণ অনেক ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। যখন আমরা কাজ শেষ করি, তখন অন্য সংস্থাগুলো তাদের উন্নয়ন কাজ করার জন্য অনুমতি চায়। আমাদেরও অনুমতি দিতে হয়। ফলে একটা রাস্তা বারবার খুঁড়তে হয়।

সংবাদ সম্মেলনে যেসব উন্নয়ন ফিরিস্তি তুলে ধরা হয় সেগুলো হচ্ছে-

এলইডি বাতি স্থাপন : অপর্যাপ্ত এবং অকেজো সড়ক বাতি পরিবর্তন করে বিগত চার বছরে ডিএসসিসিতে আধুনিক প্রযুক্তির ৪১ হাজার ১৩৩টি এলইডি বাতি স্থাপন করা হয়েছে। ফলে নাগরিকরা নিরাপদে ও স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারছেন। নবগঠিত ১৮টি ওয়ার্ডে ১৫ হাজার এলইডি বাতি স্থাপনের কাজ চলছে।

রাস্তা, নর্দমা, ফুটপাথ উন্নয়ন ও সংস্কার : সরকার ও সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে ৬৬৯.৯১ কিলোমিটার রাস্তা, ৬৩১.৭০ কিলোমিটার নর্দমা ১৩৩.১৬ কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় ৬০০ কিলোমিটার রাস্তা, ৫০০ কিলোমিটার নর্দমা এবং ১০০ কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে।

পরিচ্ছন্ন কর্মী নিবাস নির্মাণ: প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক দয়াগঞ্জে নির্মিত আধুনিক পরিচ্ছন্নকর্মী নিবাস উদ্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া ধলপুর, লালবাগ ও গণকটুলিতে ছয়তলাবিশিষ্ট ৬টি নিবাস নির্মাণ করা হয়েছে। আরও ৬টির কাজ চলমান রয়েছে।

জলাবদ্ধতা দূরীকরণ : শান্তিনগর, নাজিমউদ্দিন রোড, গণকটুলী এবং বংশাল এলাকায় প্রায় চার যুগের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসন হয়েছে। নগরীর সার্বিক জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প গ্রহণসহ ৪৯৭ কিলোমিটার উন্মুক্ত নর্দমা এবং ৫৩৭ কিলোমিটার পাইপ ড্রেনের আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে। জেট অ্যান্ড সাকার মেশিনের মাধ্যমে ড্রেনে জমাটবদ্ধ হয়ে থাকা আর্বজনা অপসারণ করা হচ্ছে।

নবসংযুক্ত ৮টি ইউনিয়নের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড : ৭৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল, সারুলিয়া এলাকার ১৬৭.৮৮ কিলোমিটার রাস্তা, ৮.৮১ কিলোমিটার ফুটপাথ ও ১৭১.৬৫ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে। এ প্রকল্পের ৮৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই বাকি কাজ সমাপ্ত হবে। এছাড়া ৫১৫.৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মান্ডা, ডেমরা, নাসিরাবাদ ও দক্ষিণগাঁও ইউনিয়নের জন্য ৮১.৩৬ কিলোমিটার রাস্তা, ৬১.৭৯ কিলোমিটার নর্দমা, ৭.৯৫ কিলোমিটার ফুটপাথ, ১২টি আরসিসি ব্রিজ, ৩৮৩ মি. এপ্রোচ রোড নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ চলমান রয়েছে।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নীচে যাত্রাবাড়ী হতে জয়কালী মন্দির, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী ও দয়াগঞ্জ এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা, নর্দমা এবং ফুটপাতের উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করাসহ যাত্রাবাড়ী মোড় হতে ঢাকা চট্টগ্রাম, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা-ডেমরা ত্রিমুখী সড়কের সম্প্রসারণ এবং উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এর ফলে নবসংযুক্ত ৮টি ইউনিয়ন কর্পোরেশনের উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত হয়েছে।

খেলার মাঠ-পার্ক উন্নয়ন: ‘জলসবুজে ঢাকা’ প্রকল্পের মাধ্যমে পার্ক এবং খেলার মাঠগুলো বিশ্বমানে উন্নীত করার কাজ চলছে। বেশির ভাগ খেলার মাঠ ও পার্কের উন্নয়ন কাজ শেষ। উদ্বোধনের অপেক্ষাধীন রয়েছে। ১৯টি পার্কের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী আব্দুল খালেক সরদার পার্কের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। সিরাজ-উদ-দৌলা পার্ক এবং গুলিস্থান পার্কের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ১২টি খেলার মাঠের মধ্যে শহীদ আব্দুল আলীম খেলার মাঠের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। রসুলবাগ মাঠ এবং জোড়পুকুর খেলার মাঠের উন্নয়ন কাজও প্রায় শেষের দিকে। অন্যান্য খেলার মাঠ ও পার্কগুলোর উন্নয়ন কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে, যা চলতি বছরেই জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে। এসব খেলার মাঠ ও পার্কের উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি এক নতুন দৃষ্টিনন্দন রূপ লাভ করবে। আধুনিক এসব খেলার মাঠ ও পার্কে ফুল, বিনোদনের রাইড, ওয়াকওয়ে, ব্যায়ামাগার, কপি শপ, গ্যালারি ইত্যাদি নানাবিধ বিনোদন সুবিধা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বাসরুট রেশনালাইজেশন : সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক ডিএসসিসি মেয়রের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নগর পরিবহনগুলো ৬টি কোম্পানির আওতায় এনে ২২টি রুটে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ধানমন্ডি-নিউমার্কেট-আজিমপুর, এয়ারপোর্ট-মতিঝিলসহ কয়েকটি রুটে চক্রাকার বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। চালকদের দক্ষ করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চালক, পথচারীদের সার্বিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে আইন মোতাবেক সড়কে চলার বিষয়ে শিক্ষার্থীসহ নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে।

যাত্রী ছাউনি নির্মাণ: নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ২৮টি আধুনিক যাত্রীছাউনি নির্মিত হয়েছে। আরও ২টির নির্মাণ কাজ চলছে। এসব যাত্রীছাউনিতে ওয়াই-ফাই সুবিধা এবং টিকেট বিক্রয় কাউন্টার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ : নিরাপদে সড়ক পারাপারের লক্ষ্যে নতুন ৮টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে এবং ৭টি নির্মাণাধীন রয়েছে। পুরানো ১৬টি ফুটওভার ব্রিজের সংস্কার কাজ শেষ হয়েছে।

যানজট নিরসন : নগরীর বিভিন্ন স্থানে ২০.৩০ কিলোমিটার রোড মিডিয়ান নির্মাণ এবং ফুটপাতে ১৭.০৮ কিলোমিটার গার্ড রেইল স্থাপন, ১০ কিলোমিটার রাস্তায় রোড মার্কিং, ১২২টি জেব্রা ক্রসিং ও ২২০টি ট্রাফিক সাইন স্থাপন করা হয়েছে। ৭ কিলোমিটার রোড মিডিয়ানের সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। ৪০টি ট্রাফিক সিগন্যাল সচল করে এগুলোতে সোলার প্যানেল, কাউন্ট-ডাউন টাইমার ও অটো ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৯টি সিগন্যাল পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। ২১৯.৫৩ কিলোমিটার প্রতিবন্ধীবান্ধব ফুটপাত নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে। নগরীর ৮টি স্থানে ৫৬০টি অনস্ট্রিট পার্কিং চালু করা হয়েছে। ১৮টি ইন্টারসেকশন উন্নয়ন এবং ১২টি নতুন ইন্টারসেকশনে ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়েছে।

কেমিক্যাল কারখানা স্থানান্তর : ২০১০ সালে পুরানো ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর কেমিক্যাল ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন এবং নতুন ইস্যু বন্ধ রাখা হয়। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে অবৈধ কেমিক্যাল কারখানায় সংঘটিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১টি প্রাণ ঝরে যায়। পুরানো ঢাকার জনজীবন অধিকতর নিরাপদ করার লক্ষ্যে টাস্কফোর্স পরিচালনার মাধ্যমে অবৈধ প্রতিষ্ঠান সিলগালা, জরিমানা আদায়, দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের পরিসেবা সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩১০ একর জায়গায় কেমিক্যাল পল্লী গঠনের কাজ চলছে। এই কাজ শেষ হলে কেমিক্যাল ব্যবসা ষেখানে পুরোপুরি স্থানান্তর হবে। অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবেলায় অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই আগুন নিভিয়ে ফেলার ব্যবস্থা যেন থাকে সে লক্ষ্যে প্রতিটি গুদাম ও দোকানে পর্যাপ্ত বালু, পানি এবং অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সচেতন করা হয়েছে। পুরানো ঢাকার বাবুবাজার ব্রিজের নিচে একটি ফায়ার ষ্টেশন স্থাপনের কাজ চলছে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : তিন বছর পূর্বে পরিচ্ছন্ন কর্মীদের কর্মস্থলে হাজিরা নিশ্চিত করতে ‘সিম ট্রাকিং’ চালু করা হয়। বর্জ্যের কন্টেইনারগুলো সড়কে বা ফুটপাতে রাখার পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব করার ব্যবস্থা হিসেবে ২১টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) নির্মাণ করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমন্বয়ে ব্যতিক্রমধর্মী ‘নাইট শিফট’ চালু করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ভৌত-অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজের তত্ত্বাবধান জোরদার করা হয়েছে।

পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, ইমাম-খতীব, সুশীল সমাজ, সেলিব্রেটি, এনজিও, সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে শোভাযাত্রা, মতবিনিময়,গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার, লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধকরণে প্রচারণা চালানো হয়েছে। নাগরিকদের পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির লক্ষ্যে সমাজের সব স্তরের লোকজনকে সম্পৃক্ত করে প্রতীকী পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। যা গৌরবদীপ্ত ‘গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’ অর্জন করে।

সংবাদ সম্মেলনে ডিএসসিসির কাউন্সিলরগণ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান, প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. জাহিদ হোসেন, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রি. জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ, সচিব মোস্তফা কামাল মজুমদার, কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদসহ ডিএসসিসির অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

কেআই/