পুরো কোরআনই একটা প্রশ্ন!
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৫:৪০ পিএম, ১৯ মে ২০১৯ রবিবার
মানুষের জীবনটাই একটা প্রশ্ন, একটা বিরাট প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তরও আবার এ জীবন। সব প্রশ্নের অন্তরেই লুকিয়ে থাকে উত্তর। সব উত্তরের অন্তরেই থাকে প্রশ্ন। যতই খুঁজবে ততই নিত্য নতুন প্রশ্ন এসে সামনে পথ আগলে দাঁড়াবে। আর এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার নামই হচ্ছে ইবাদাত। লক্ষ্য করলে দেখবো পুরো কোরআনই একটা প্রশ্ন-সে প্রশ্নের উত্তরও আবার কোরআন নিজেই-এ দুয়ের মাঝেই মানুষের জীবন, অর্থাৎ সত্যিকারের মানুষের জীবন।
কোরআন এক দিকে ইঙ্গিত করছে আল্লাহর ওয়াহদানিয়াত বা ঐক্যের দিকে, তাঁর একক সত্তার দিকে-যে সত্তায় তিনি অনন্য, অতুলনীয়। কিন্তু অন্য দিকে একই কোরআন তাঁর ইচ্ছার প্রকাশের মধ্যে সৃষ্টির বহু বিচিত্র রূপের দিকেও ইঙ্গিত করছে। ঐ যে বলা হলো, ‘ইন্নমা আমারুহু ইজা আরাদা শাইয়ান আইয়াকুলা লাহু কুন ফাইয়াকুন’ (সুরা ইয়াসীন ৮২) -তিনি ইচ্ছা করে বললেন-হও, তাই সব হয়ে গলে। এক বহুতে প্রকাশিত হলো। সে বিচিত্র রূপের মূলে কাজ করছে বিপরীত দুটি শক্তির সংঘাত এবং মিলন। একটিকে যদি বলি পুরুষ তবে অন্যটি হবে নারী। একটিকে যদি বলি আলো, তবে অন্যটি হবে অন্ধকার। একটি যদি হয় কোমল তবে অন্যটি হবে কঠিন। মজার কথা হচ্ছে এই যে, দুটি শক্তি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী কিন্তু একটা শক্তির অন্তরে অন্য শক্তিটি ঘুমিয়ে থাকে। সৃষ্টির অন্তরে যেমন ঘুমিয়ে থাকে ধ্বংস এবং ধ্বংসের অন্তরে সৃষ্টি।
আল্লাহর হুকুমে এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একদিন মহা সংকোচন আবার মহাসত্তার মধ্যেই প্রত্যাবর্তন করবে- ‘কুল্লু মান আলাইহা ফান ওয়া ইয়াব্ ওয়াজহু রাব্বিকা জুলজালালে ওয়াল ইকরাম।’ (সুরা আর রহমান ২৬, ২৭)
- সবকিছুই এক দিন ধ্বংস হয়ে যাবে থাকবে শুধু মহান আল্লাহর মুখচ্ছবি। এখানেও এই সৃষ্টি এবং লয়ের মধ্যে রয়েছে সেই বিপরীত দুটি শক্তির প্রকাশ বা মূলত একই শক্তি থেকে উৎসারিত।
মানুষের সৃষ্টিকে তিনি নিয়মের অধীন করেছেন ঠিকই-কিন্তু তার জীবনকে নিয়মের অধীন করেও দিয়েছেন তাকে ইচ্ছার স্বাধীনতা। মানুষকে তিনি গড়েছেন নিজের আদলে-এই মাটির পিঞ্জরে তিনি ফুঁকে দিয়েছেন নিজের অস্তিত্বের একটি অংশকে। তাই মানুষ এলো পৃথিবীতে আল্লাহরই আর একট রূপ হয়। কিন্তু তার দেহটা গড়লেন মাটি, হাওয়া, আগুন, পানি দিয়ে। এমনিতে দেখবে এ উপাদানগুলো একটা অন্যটার সঙ্গে মেশে না। কিন্তু মানুষের দেহে এরা গলাগলি করে বসবাস করে। শুধু বসবাস নয়, তার স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে। এরই জন্যে মানুষ দেহের স্বাভাবিক কামনা-বাসনাকে অস্বীকার করতে পারে না। মানুষ কামনা-বাসনাকে অস্বীকার করুক- এটাও আল্লাহর ইচ্ছা নয়। মানুষ এ জীবনের পাত্র থেকে আকণ্ঠ পান করবে-বিষের জ্বালায় জর্জরিত হবে কিন্তু সে ভুলবে না যে, এ বিষের মাঝেই রয়েছে অমৃত। এই ভুলতে না পারাটাই তাঁর মনু্ষ্যত্বের সাধনা। সে জানে তাকে উৎসবমুখে ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে পরমাত্মার মাঝে। এটাই তার অন্বেষণ। এটাই তার প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে তাকে, দেহকে অস্বীকার করে নয়। দেহের কামনা-বাসনাকে নিজ নিয়ন্ত্রনে এনে আল্লাহর ইচ্ছাকে জানতে চাওয়ার নামই অন্বেষণ। এটাই ইবাদত। কোরআন তাঁর ইচ্ছারই মূর্ত প্রকাশ। আর সে ইচ্ছাকে যিনি আমাদের কাছে এনে দিয়েছেন তিনি তাঁর প্রিয় হাবিব মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা:)। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো আমরা আল্লাহকে দূরের কথা-তাঁর রাসূলকেই তো চিনতে পারলাম না। চিনবার চেষ্টা করলাম না। আমাদের চোখ, নাক, কান সবই আছে-বিদ্যা আছে কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা তাঁকে চিনলাম না।
মানুষ যতক্ষণ অন্তরের চোখ দিয়ে দেখতে না শেখে ততক্ষণ তার সত্য দর্শন হয় না। আলেমরা সত্যকে দেখেও দেখতে পায় না। তাঁরা সত্যকে খোঁজে কালো কালো অক্ষরের মাঝে-অথচ সত্য তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্তরের চোখ নেই বলে দেখতে পায় না। নিজেও বিভ্রান্ত হয়, অন্যকেও বিভ্রন্ত করে। হুজুর পাক (সা:) সেজন্যেই বলেছেন, তাঁর উম্মতদের মধ্যে প্রথম যে দলটি দোজখে যাবে তারা হচ্ছেন আলেম।
সুরা হুদের ৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘অর্থাৎ তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন কর। তিনি তোমাদের উত্তম জীবন উপভোগ করতে দেবেন এবং নিষ্ঠাবানদের অধিক দান করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে আশঙ্কা করি তোমাদের জন্যে এক মহা শাস্তির।’
সূত্র : হযরত সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌনপুরি’র (রহ) সংলাপ সমগ্র বই থেকে সংগৃহীত।
এমএস//