ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪,   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ক্যান্সার যোদ্ধা আহনাফের অন্যরকম পৃথিবী

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০১:৪৭ পিএম, ২০ মে ২০১৯ সোমবার | আপডেট: ০৫:০৮ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ শুক্রবার

নূর এ সাফী আহনাফ

নূর এ সাফী আহনাফ

একটি ছেলে ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখে সে বড় হয়ে রাষ্ট্রনায়ক হবে। দেশের প্রেসিডেন্ট হবে। মানুষের জন্য কাজ করবে। অন্য অনেকে যখন নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে ছেলেটি তখন আল্লাহকে বলে, আল্লাহ আমি এমন কিছু করতে চাই যাতে করে মানুষ যুগ যুগ ধরে তার সুফল ভোগ করে।

সেই ছেলেটি যখন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র তখন তার ধরা পড়লো ব্লাড ক্যান্সার। পরিচিত মহলে সবাই জানে এ ব্যাধি মহাঘাতক ব্যাধি। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আটকে যায় ছেলেটির সময়- স্বপ্ন। তারপর ছেলেটি কী করে?

যার কথা বলছি তিনি নূর এ সাফী আহনাফ। দেশে লিউকআেমিয়া অ্যান্ড লিম্ফোমা সোসাইটি অব বাংলাদেশ  ( LLSB) নামক একটি সংগঠন ক্যান্সার রোগীদের নিয়ে কাজ করে। সারাদেশে যার সদস্য সংখ্যা প্রায় আঠারো হাজারেরও বেশি। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নূর এ সাফী আহনাফ।

আহনাফ একজন ক্যান্সার যোদ্ধা। রোগী না বলে যোদ্ধা বলছি এই কারণে দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করছেন। নিজে যেমন হতাশাকে নিজের জীবনে ঠাঁই দেননি তেমনি তার মতো অনেক ক্যান্সার যোদ্ধার জীবনের অনুপ্রেরণা তিনি।

আহনাফ যখন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্র তখন তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। সেই আহনাফ এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে সম্মান শেষ বর্ষে পড়ছেন। জড়িত আছেন বিভিন্ন স্বেচ্চাসেবী কাজে। ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি।

ক্যান্সার ধরা পড়ার সময়ের স্মৃতিচারণ করে একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে আহনাফ বলেন, আমি যখন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষে পড়ি, তখন হঠাৎ করে আমার শরীরটা খারাপ করে। খারাপ মানে, আমার প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছিল `সামথিং ইজ রং`। মনে হচ্ছিল শরীরটা আগের মতো নাই।

শরীরের কোথাও যেন কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। আমার বাবা - মা দুজনেই সরকারী চাকুরীজীবী। আমি ঢাকায় রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে- এর হোস্টেলে থাকি। আর তারা থাকেন জামালপুর। আম্মু আমাকে বললেন ডাক্তার দেখাও।

অতীতের সময়গুলোতে ফিরে গিয়ে আহনাফ বলেন, আমাদের কলেজে নিয়ম কানুন ছিল খুব কড়া। অনেকটা ক্যাডেট কলেজের মতো। সবসময় আমরা হোস্টেলেই থাকতাম। বাবা মায়ের সাথে কাটানোর জন্য বড় সুযোগ ছিল ছুটি। খুব বড় বড় ছুটি হতো। ৎ

কয়েকদিন পরেই ছিল কুরবানী ঈদের ছুটি। ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করছিলাম। তার একদিন আগে রাতের বেলা সারা শরীরে বেশকিছু জায়গায় লাল লাল দাগ যায়। কিন্তু আমি সেটাকে তেমন পাত্তা দেইনি।

যেহেতু দীর্ঘদিন আমার শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না, মনের ভেতরটাও কেমন কেমন করছিল তাই পরেরদিন ডাক্তারের কাছে যাই। সাথে আমার বাবা ছিলেন। ডাক্তার হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক এবিএম আবদুল্লাহ। ওনাকে আমি প্রথমে গায়ের লাল দাগগুলো দেখাই।

তিনি সবকিছু দেখে বললেন, তুমি যেহেতু ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছ চলে যাও। ছুটি শেষ হলে একবার আসিও। আমি ডাক্তারের এমন আশ্বাস শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আসছি এমন সময় ডাক্তার আবার বললেন, তুমি যেহেতু আসছ আমি আরেকবার একটু দেখি।

আহনাফ অতীত হাতড়ে বলেন, যদিও আমার শরীর ভাল যাচ্ছিল না তবুও আমি নিজেকে সুস্থ মনে করতাম। আমি ভাবতাম, শরীর ভাল নেই এটা আমার অহেতুক মানসিক দুঃশ্চিন্তা। তাই আমি ডাক্তারের রিপোর্ট খুলেও দেখিনি।

তবে আমার বাবা জানতেন। তিনি আমাকে বলেননি। নিজে নিজে কান্না করতেন। ওনার কান্না দেখে আমি আশ্চর্য্য হতাম ও ওনাকে সান্ত্বনা দিতাম। আমি ভাবতাম, আমার তো কিছু হয়নি। তাহলে বাবা কান্না করেন কেন?

আহনাফ বলেন, আমি প্রথম আমার ক্যান্সার হওয়ার খবর জানতে পারি ফেসবুকে। আমি কলেজে বিভিন্ন স্বেচ্চাসেবী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খুব সক্রিয় ছিলাম। নিয়মিত বিতর্ক করতাম।

ডিবেট সোসাইটির প্রধান ছিলাম। ফলে বন্ধুরা আমাকে ভালবাসে। তারা আমার ক্যান্সার হওয়ার খবরটি জেনে গিয়েছিল। দোয়া চেয়ে তারাই প্রথম খবরটি ফেসবুকে দেয়। একদিন দুপুরে ফেসবুকের নিউজফিডে ঘুরতে ঘুরতে খরবটি আমার চোখে পড়ে।

ব্লাড ক্যান্সারের অনেকগুলো ধরণ রয়েছে। আহনাফ যে ক্যান্সারে আক্রান্ত তার নাম ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া। সংক্ষেপে একে বলা হয় CML. প্রতি বছর ২২ সেপ্টেম্বর তারিখটিকে CML দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সাথে আলাপকালে আহনাফ বলেন, "আমার জীবনটা নাটকীয়তায় ভরা। এখানেও একটি নাটকীয়তা আছে। ২২ সেপ্টেম্বর CML ডে। আবার এই ২২ সেপ্টেম্বর আমার জন্মদিন।" ব্যাপারটি হয়তো কাকতালীয়। কিন্তু এই কাকতালীয়তার মাঝেই যে এক গভীর বিষাদ লুকিয়ে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রথম যখন আহনাফ জানলেন তিনি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত তখন তার অনুভূতিটা কেমন হয়েছিল? একুশে টেলিভিশন অনলাইনে আড্ডাচ্ছলে আহনাফ বলেন, সত্যি কথা হচ্ছে জানার সাথে সাথে আমার কিছু দুঃখ হয়েছিল। আবার কিছু আনন্দও হয়েছিল। দুঃখ হয়েছিল এই কারণে ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল আমি কোনো একদিন দেশের প্রেসিডেন্ট হব। রাষ্ট্রনায়ক হব। কিন্তু ক্যান্সার আমার সেই স্বপ্ন পূরণে কী বাধা হয়ে দাঁড়াল? এই প্রশ্নটা আমাকে পীড়া দিতে থাকে। আমার স্বপ্ন ছিল আমি পৃথিবী ঘুরে দেখব। আল্লাহর সৃষ্টি এত সুন্দর পৃথিবী। পৃথিবী ঘুরে দেখাটাও আমার কাছে ইবাদাত। আমার মনে একটা কষ্ট দানা বাঁধতে থাকে। হায়! আমার কী পৃথিবী ঘুরে দেখা হবে না?

আহনাফ বলেন, কিন্তু কিছুক্ষন পরে আমার একধরনের সুখানুভূতি তৈরি হয়। সুখানুভূতি হচ্ছে এ জন্য, এমন একটা জিনিস আমি ধারন করে আছি যা পৃথিবীতে সবার নেই বা খুব কম লোকের আছে। আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম এটা আমার জন্য স্রষ্টার আশীর্বাদ। যে অভিজ্ঞতা আমার হবে বা হচ্ছে তা অন্য সবার হবে না। নিজেকে সাহস দেওয়ার জন্য এটা ছিল আমার সবচেয়ে বড় যুক্তি। তবে আমাকে তখন প্রায় স্টেরয়েড দিয়ে রাখা হত। ফলে অামাকে কোন মানসিক চাপ নিতে হতো না বা নেওয়ার সুযোগ ছিল না।

আহনাফ এর ভাষায়, সে এক কষ্টকর সময়। ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। শরীর দুর্বল লাগত। খেতে পারতেন না। বমি হতো। রাতে ঘুমাতে পারতেন না। হাত পা নাড়াতে কষ্ট হতো। শরীরে ছোপ ছোপ লাল লাল দাগ।

ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন আহনাফ- এর বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। কিন্তু তার সাথে ম্যাচিং করে এমন বোনমেরু পাওয়া যায়নি। ভাই বোন হলে মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্যি আহনাফ- এর ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। চিকিৎসার জন্য আহনাফ কে কলকাতা টাটা মেডিকেল  সেন্টারে ডা. মামেন চেন্ডির অধীনে ভর্তি করানো হয়।

ক্যান্সার একটি ঘাতক ব্যাধি। ক্যান্সার হলে রক্ষা নাই। ক্যান্সারের চিকিৎসা খুব ব্যায়বহুল। সহজে কান্সারের চিকিৎসা পাওয়া যায় না। এমন অনেক কথা ক্যান্সার সম্পর্কে প্রচলিত। আহনাফ - এর জীবনেও এর অনেকগুলো সত্য হয়েছে। তবে আসল বিষয় হলো আহনাফ হাসিমুখে সে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন।

একটি জনপ্রিয় অনলাইন পোর্টালে আহনাফ নিয়মিত ফিচার লেখেন। টেন মিনিট স্কুলে কন্টেন্ট কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করেন। ইকোনোমিকস ক্যারিয়ার অ্যালাইন্স- এ সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। অ্যাকসন এইড- এ তিনি একজন ইন্টারপ্রেটার অ্যান্ড ফ্যাসিলেটার।

দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করা আহনাফ- পড়াশুনায়ও ভাল ফলাফল করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। আহনাফ এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলেন স্কলারশিপ সহ। পরবর্তীতে ক্যান্সার নিয়ে যুদ্ধ করতে করতেও তিনি একই ফলাফল অর্জন করেন। ঢাকা বোর্ডে তার অবস্থান ছিল ৭৬। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় তার অবস্থান ছিল ২৩২।

আহনাফ তাদের একজন যারা সবসময় হাসিখুশী থাকে। নিজেকে নানা কাজে ব্যস্ত রাখে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আহনাফ বলেন, আমি যখন টাটা মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি হই, তখন অামি অবাক হয়ে গেলাম। আশেপাশে এত এত ক্যান্সার রোগী যেন এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

(আগামী পর্বেঃ ক্যান্সার রোগীদের মানসিক শক্তি)

 আআ//