পরিচ্ছন্ন হলে পবিত্র হয় না
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৮:২৪ পিএম, ২০ মে ২০১৯ সোমবার
যা পবিত্র তা পরিচ্ছন্ন হতে পারে, কিন্তু পরিচ্ছন্ন হলেই পবিত্র হবে এমন কথা বলা যায় না। পরিচ্ছন্নতা হচ্ছে বাইরের, পবিত্রতা হচ্ছে অন্তরের। শরিয়ত বাইরের পরিচ্ছন্নতাকে বাধ্যতামূলক করেছে। ওযু ছাড়া নামায হয় না।
ওজুর সময় শরীরের ওই অংশগুলো ধৌত করছি। সেখানে রয়েছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়। ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে তৈরি হচ্ছি স্রষ্টার মুখোমুখি হতে। অর্থাৎ দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। তওবার আর একটি অর্থ হচ্ছে ওয়াদা করা, প্রতিজ্ঞা করা। তওবা করে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে নিজের গুনাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। ওয়াদা করছি আর বিপদে যাব না। সুতরাং তওবা মানে অন্তরের ওজু। তওবার মধ্যে আর একট জিনিস আছে।
ভয় থাকলে মানুষ কোন অন্যায় করতে পারতো না। মানুষ আল্লাহর ভয়কে ভুলে থাকতে পারে বলেই অন্যায় করতে পারে। তা না হলে কে না জানে নামাজ কত বড় নেয়ামত। নামাজ আল্লাহ নূর। এও সব জানে, নামাজ হচ্ছে মেরাজুল মুমেনিন। মুমিনের জন্যে নামাজ হচ্ছে আল্লাহর দিদার, আল্লাহর দর্শন। এমন যে নামাজ সে নামাজের অন্তর্নিহিত পবিত্রতাকে আমরা ভুলে যাই। বাইরের পরিচ্ছন্নতাকেও ভালোভাবে জানার চেষ্টা করি না। এজন্যেই বলা হয় পৃথিবীতে নামাজী আছে, নামাজ নেই। সেজদার অভাব নাই, কিন্তু নামাজকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বলা হয়েছে পবিত্রতাই নামাজের চাবি এবং নামাজ হচ্ছে বেহেশতের চাবি। আমরা সবাই এসব জানি, কিন্তু পবিত্রতা অর্জন করার প্রয়াস আমাদের নেই।
বাইরের পরিচ্ছন্নতা দিয়ে মানুষের কাছে সম্মান পেতে পারি। কিন্তু অন্তরের পবিত্রতা ছাড়া আল্লাহর কাছে সম্মান পাওয়া যায় না। হযরত আলীর (রা.) শাহাদাতের কথা যদি দেখি, ঘাতক আবদুর রহমান ইবনে মুলজিমও ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়েছিল। হযরত আরী (রা.) কাশফে এ কথা জানতেন। কিন্তু আবদুর রহমানকে তল্লাশি করা হলো না। কারণ শরিয়তের আইনে সন্দেহ করা ঠিক নয়। ফলে যা হবার তাই হলো, পিরচ্ছন্নতা পবিত্রতাকে হত্যা করলো। কিন্তু সেখানেও পরিচ্ছন্নতা পবিত্রতাকে হত্যা করেছিল। আল্লাহর কাছে সেই সবচেয়ে সম্মানিত যে অন্তরের পবিত্রতা নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে পারে।
পানির সাহায্যে আমরা যেভাবে ওজু করি তার অনেকগুলো স্বাস্থ্যগত দিক আছে। প্রথমত হাতে, চোখে, মুখে, ঘাড়ে, পায়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে স্নায়বিক উত্তেজনা প্রশমিত হয়। চীনা আকুপাংচার যারা করেন তারা জানেন যে, শরীরের এসব স্থানে বিশেষ করে প্রান্তিক অংশে রয়েছে কিছু নার্ভ সেন্টার। ঘষে পানি দিয়ে পরিষ্কার করলে এগুলো সক্রিয় এবং সতেজ হয় এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে তার প্রভাব পড়ে। দাঁত পরিষ্কার করা, কুলি করা ইত্যাদির ফলে স্বাস্থ্য রক্ষার কতগুলো নিয়ম দৈনিক পাঁচবার অন্তর পালিত হয়। নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কারেরও স্বাস্থ্যগত দিক রয়েছে। তাঝাড়া ঘাড়ে ঠাণ্ডা পানি দিলে যে স্নায়বিক উত্তেজনা প্রশমিত হয় সে তো সবাই বুঝতে পারে।
বাইরের ওজু সহজ হলেও অন্তরের ওজু খুবই কঠিন জিনিস। অন্তরের ওজু কখনোই হবে না যতক্ষণ না নফসকে আমাদের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি। কোন মূল্যবান জিনিসই সহজে পাওয়া যায় না। উচ্চাঙ্গ সংগীত বা ধ্রুপদী সাহিত্য বলি কোন বড় জিনিসই সহজে মেলে না। এর জন্য চাই সাধনা। সাধনার প্রথম শর্ত সত্য কথা বলবে। হালাল রুজি কামাই করবে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংযম অভ্যাস করবে। মানুষের ক্ষুধা অন্তহীন। কিন্তু সাধককে পরিমিতির অভ্যাস করতে হবে। ক্ষুধা বলতে সব রকম ক্ষুধার কথাই বলছি। আর এই সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা মধ্যে কোন এক সময় পাঁচ মিনিটের জন্যে হলেও একটু ধ্যান করতে হবে। ইসলামের প্রথম ইবাদত কিন্তু মোরাক্বাবা, নামায নয়। হেরা পর্বতের গুহায় হুজুর পাক (সা:) ধ্যান করেছেন দীর্ঘ পনেরো বছর। ধ্যান ছাড়া মানুষের অস্থিরচিত্ত শান্ত হয় না। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত-সবই কিন্তু চিত্তের প্রশান্তি অর্জনের জন্য এক ধরনের অভ্যাস। কিন্তু তাই যথেষ্ট নয়। ধ্যান করলে এক দিকে মানুষ নিজেকে নিজের আত্মার আয়নায় দেখতে পাবে-অন্যদিকে ধ্যানের ফলে তার আরাধ্য এসে যে আয়নায় ধরা দেবে। তখনই তার নিজেকে চেনা পূর্ণ হবে। এজন্যই হিন্দুদের শাস্ত্রে এমন বারে বারে বলা হয়েছে আত্মানং বিদ্ধি। নিজেবে জান। মোরাক্বাবা ছাড়া নিজেকে জানার আর কোন পথ নেই।
তথ্যসূত্র: হযরত সৈয়দ রশীদ আহমদ জৌনপুরির (রহ) এর ‘সংলাপ সমস্র’ বই থেকে সংগৃহীত।
এমএস/ এসএইচ/