ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

‘যুগোপযোগী বাজেট না হলে তৈরি হবে জাতীয় সংকট’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৮:৫৯ পিএম, ২১ মে ২০১৯ মঙ্গলবার

বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও বিনিয়োগ করতে পারছে না জাতীয় বাজেট। আবার সমন্বয়, বাস্তবায়ন, উদ্ভাবন ও তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রমের ঘাটতিও প্রকট। এমন প্রেক্ষাপটে মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ তরুণ জনগোষ্ঠী নিয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে যে জনমিতিক সুবিধায় আছে তা একটা সময় বড় ধরণের অসুবিধায় পরিণত হবে।

একশনএইড বাংলাদেশ ‘ যুব জনগোষ্ঠীর জন্য বিনিয়োগ: বাজেটে প্রতিফলন কী?’ নামে একটি গবেষণায় এমন চিত্র তুলে ধরেছে।

মঙ্গলবার ঢাকার পুরান পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-এ আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। একশনএইড বাংলাদেশ ও ইকোনোমিক রিপোটার্স ফোরাম যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

প্রতিবেদনটি নিয়ে আলোচনাকালে বিশেষজ্ঞরা বলেন, পর্যাপ্ত বাজেটের অভাব এবং বিদ্যমান বরাদ্দকৃত বাজেটে যুব উন্নয়নমূলক খাতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় তরুণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্ত হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উন্নয়নে যুব শক্তিতে সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। তা না হলে দেশ ও সমাজ একটি স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে।  যেটি হবে জাতীয় সংকট।

অনুষ্ঠানের শুরুতে যুব বাজেট নিয়ে গবেষণাপত্রটি তুলে ধরেন ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার প্ল্যানিং এডিটর আসজাদুল কিবরিয়া।

গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান শাসন কাঠামো অনুযায়ী ২২টি মন্ত্রণালয় যুব ও যুবদের উন্নয়ন সম্পর্কিত। ২০১৮ সালের বাজেটে এই ২২টি মন্ত্রণালয়ের জন্য বাজেটে মোট বরাদ্দ ছিলো ১.৬৬ লক্ষ কোটি টাকা যা পরবর্তীতে ২১.৬ শতাংশ কমে  ১.৩৭ লক্ষ কোটিতে নেমে আসে। একই সময় মূল জাতীয় বাজেট চার লক্ষ কোটি থেকে ৭.৮১ শতাংশ কমে ৩.৭২ লক্ষ কোটিতে নেমে আসে, অর্থাৎ সামগ্রিক বাজেটের তুলনায় এই ২২টি মন্ত্রণালয়ের বাজেট কমার হার বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, মন্ত্রণালয়গুলোতে নানাভাবে, আলাদাভাবে বা যৌথভাবে তরুণদের জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে তরুণদের জন্য পরিকল্পনা নেই। আবার মন্ত্রণায়গুলোর এই বাজেট ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয়েরও ঘাটতি আছে।

গবেষণার আলোকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএস এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তাফা কে মুজেরী বলেন, “তরুণরাই আমাদের দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অথচ আমাদের দেশের বাজেটে যুব উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ অবহেলিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মস্থান-এর মত গুরুত্বপূর্ণ খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ দরকার তা করা হচ্ছে না। এই বিনিয়োগ দুরাবস্থা আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিনিয়োগ না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমরা খুব খারাপ পরিস্থিতিতে পরবো।

তিনি আরও বলেন, “সামগ্রিক বাজেট কাঠামোতে তরুণদের যুক্ত করা হয় না। আবার তাদের সংগঠিত হয়ে বাজেটে কথা বলার সুযোগ নেই। অন্যদিকে, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে অগ্রসর হওয়া চতুর্থ শিল্প বিপ্লবেও পিছিয়ে পড়ছে আমাদের তরুণরা। পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি হচ্ছে না। ফলে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যত সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের তরুণদের সামনে।”

একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “বিশাল জনগোষ্ঠীর তরুণদের অপর্যাপ্ত বাজেট ও সরকারি ব্যয় সম্পর্কিত নীতিমালার অভাব দীর্ঘমেয়াদী জনমিতির সুফল আদায়ের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হতে পারে এবং দেশের প্রথম জনমিতিক সুবিধাকে একটি দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে পারে। তাই জনমিতির সুফল আদায়ে যুবদের জন্য বাজেটে খাতসমূহ সুনির্দিষ্ট করা এবং তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে অবশ্যই উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও নতুন দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।” 

বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০ অর্থবছর থেকে ২০১৯ পর্যন্ত শিক্ষায় বাজেট প্রায় পাঁচগুণ বেড়েছে তথাপি মোট বাজেট বরাদ্দে শতাংশের হারে শিক্ষায় বরাদ্দের হার প্রায় একই আছে। ২০১০ অর্থবছরে বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের হার ছিলো ১২.৬০ শতাংশ যা ২০১৯ অর্থবছরে এসে ১৪.৬০ শতাংশ এ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষায় বরাদ্দকৃত বাজেটের বাস্তবায়ন ক্রমাগতভাবে কমছে যা যুবদের উন্নয়নের  ক্ষেত্রে একটি প্রতিবন্ধকতা। আবার, শিক্ষা বাজেটে গুণগত উন্নয়নের থেকে সংখ্যাগত উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপের অধিক প্রবণতা এখনো নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। পরিকল্পিত শিক্ষা বাজেটের মধ্যে উন্নয়ন অংশের তুলনায় অনুন্নয়ন ব্যয় এখনো আনেক বেশ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট এর পরিচালক ড. তাহমিনা আখতার বলেন, “শিক্ষায় জোর দেওয়ার বিকল্প নেই। বাজেট বরাদ্দ তো কমই, আবার মন্ত্রণালয়ের বাজেটে সমন্বয়ও থাকে না। যুব উন্নয়নে বরাদ্দকৃত বাজেটের বাস্তবায়নকে ফলপ্রসু করতে যুব ইস্যুতে সম্পর্কিত যে ২২টি মন্ত্রণালয় রয়েছে তাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে, যুবদের জন্য বিনিয়োগ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে একটি সামাজিক বিনিয়োগ।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬১.৩ মিলিয়ন। এর মধ্যে ১০১.১০ মিলিয়নই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছর। গবেষণা বলছে, এই জনমিতিক সুবিধা বাংলাদেশ ২০৩০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভোগ করতে পারবে। সরকারের হিসেবেই বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৩ ভাগই তরুণ। যাদের কর্মসংস্থান একটি বড় প্রশ্ন এই দেশে। বাজেট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সম্মিলিতভাবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১ শতাংশ এর কম। ২০১৯ অর্থবছরে এই মন্ত্রণালয়সমূহের মোট বরাদ্দ ছিলো মাত্র ০.৪৭ শতাংশ। জাতীয় বাজেট তরুণদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে যুগোপযোগী শিক্ষার অভাবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে কাজ পায় না তারা।

আবার তরুণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাজেটে সুনির্দিষ্ট কিছু নেই বললেই চলে। কারণ স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ মোট বাজেটের ৫ শতাংশ যেখানে তরুণদের জন্য বিশেষ সেবার কোন বিষয় নেই।

বক্তব্যে বিজিএমইএ-র সভাপতি রুবানা হক বাংলাদেশে তরুণদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তার মতে, মানসিক স্বাস্থ্য, উদ্দীপনার অভাব, দক্ষতার ঘাটতি ও যুগোপযোগী শিক্ষার অভাব বর্তমানে তরুণদের প্রধান সমস্যা।

রুবানা হক বলেন,“আমাদের বাজেট, কর্মকান্ড তরুণদের ভালো মানসিকতা নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে তার কোন কাজ করতে উদ্দীপ্ত হয় না। আমাদের শিক্ষা কিংবা উন্নয়ন কাঠামো তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়। এদেশের তরুণরা অনেক নতুন আইডিয়া নিয়ে কাজ করছে, ছোট ছোট ব্যবসা শুরু করছে। তবে এগুলো এগিয়ে নিতে তারা কোন সহযোগিতা পান না। ফলে তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায়।”

তাই তার মতে,“তরুণদের উদ্ভাবনী শক্তিকে উৎসাহিত করতে ফান্ড এবং বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং নতুন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা দরকার।”

অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক বলেন, “ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারের ২য় নম্বরে তরুণদের জন্য কাজ করার কথা বলেছে। আমরা তরুণদের উন্নয়নের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তবে এটা ঠিক আমরা তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে পারছি না; ঘাটতি আছে সমন্বয়ে। সপ্তম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনা ও যুব নীতির আলোকে একটি একশন প্ল্যান আমাদের করার কথা। সেটি হলে হয়তো অনেক বিষয় এগিয়ে যাবে।”

তিনি আরও বলেন, “পরিস্থিতি উন্নয়নে সমন্বয় বাড়ানো দরকার। সেজন্য আমরা কাজ করছি। জাতীয় যুব উন্নয়ন কউন্সিল করা হচ্ছে। আর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় বৃদ্ধি জরুরি। প্রয়োজন যুব উদ্যোগগুলোর পর্যবেক্ষণ।”

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম-এর সভাপতি সাইফ ইসলাম দিলাল বলেন, “যুব উন্নয়নের বিষয়টি বাজেটে গুরুত্ব না পেলে বর্তমানে বিশাল সংখ্যার তরুণ জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে অভিশাপে পরিণত হতে পারে। কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেওয়া আমাদের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই বাজেটে যুবদের কর্মসংস্থানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।”

যে গবেষণার উপর অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন সেখানে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরা হয়। উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হলো: জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা; তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন ও গুণগত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরো জোরালোকরণ;  যুবদের মানসিক, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিষয়ে সংবেদনশীল করার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি; তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বরাদ্দ বাড়ানো; বাজেট সম্পর্কে জানতে ও বাজেট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে যুবদের উৎসাহিতকরণ; জাতীয় পরিকল্পনা ও যুব নীতির আলোকে একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করা।

 

কেআই/ এসএইচ/