কোরআন: সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধতায় অনন্য
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৩:৫১ পিএম, ২৩ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার
কোরআন নাজিলের সূচনা ৬১০ সালে। জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়বস্তু নিয়ে নাজিল হয়েছে খণ্ডে খণ্ডে, দীর্ঘ ২৩ বছরে। কোরআন পরিপূর্ণ রূপ পায় ৬৩২ সালে। কোরআনের প্রথম পঙক্তিমালাই বদলে দেয় নবীজীর (স.) জীবন। এরপর নবীজী (স.) ও সাহাবীদের জীবন আবর্তিত হয় আল্লাহর কালাম এই কোরআনকে ঘিরেই। তাই কোরআনের প্রতিটি আয়াত বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষণে প্রচেষ্টার কোনও কমতি ছিল না।
কোরআনের আয়াতাংশ, আয়াত, সূরা—যখনই যা নাজিল হতো, তখনই নবীজী (স.) তা নিজে বার বার তেলাওয়াত করতেন এবং উপস্থিত সাথিদের শোনাতেন। সাহাবীরা তা বার বার তেলাওয়াত করে মুখস্থ করে ফেলতেন। আর কাতিব অর্থাৎ লিপিকররা তা লিপিবদ্ধ করতেন। বিভিন্ন পর্যায়ে ৪০-এর অধিক সাহাবী কোরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পালন করেছেন।
নাজিলের সূচনা থেকেই মক্কায় নবীজীর (স.) সরাসরি তত্ত্বাবধানে সাহাবীরা মুখস্থ করা ও লেখার মাধ্যমে কোরআন সংকলন ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করেন। কোরআন লিখে রাখার কাজে মোটা কাগজ, চামড়া, পাথরখণ্ড, জন্তুর হাড় ও খেজুর পাতা ব্যবহার করা হয়। আলী ইবনে আবু তালিব, উবাই ইবনে কাব, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, জায়েদ বিন সাবিত (রা.) কোরআন লিপিবদ্ধকারী হিসেবে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন। জায়েদ বিন সাবিতকে নবীজী (স.) তার সামনে বসেই কোরআন লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কোনও আয়াত নাজিল হলেই তিনি তাকে ডেকে নিয়ে তেলাওয়াত করে শোনাতেন। আয়াতটি কোন সূরার কোন আয়াতের আগে বা পরে কোথায় বসাতে হবে, সে-সম্পর্কে নির্দেশনা দিতেন। জায়েদ সেভাবে লিপিবদ্ধ করে শুদ্ধতা যাচাইয়ের জন্যে তা আবার নবীজীকে (স) পড়ে শোনাতেন। এভাবে পুরো কোরআন সূরা আকারে বিন্যস্ত, লিপিবদ্ধ ও মুখস্থ করার নির্ভুল প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন হয় নবীজীর (স.) জীবদ্দশাতেই।
নবীজী (স.) মদিনায় হিজরত করার পর কোরআন চর্চা নতুন গতি লাভ করে। মসজিদে নববী সংলগ্ন চত্বরে নিবেদিতপ্রাণ সাহাবীদের এক বিশাল দল কোরআনের জ্ঞানে জ্ঞানী হওয়ার জন্যে নিজেদের উৎসর্গ করেন। নবীজীর (স.) জীবদ্দশাতেই পুরো কোরআন মুখস্থ করেছেন এমন হাফেজের সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার। আর জায়েদ বিন সাবিত, আলী ইবনে আবু তালিব, উসমান ইবনে আফফান, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, উবাই ইবনে কাব, সাঈদ ইবনুল আস, আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর, আনাস ইবনে মালেক, আবদুর রহমান ইবনে হারিস, মুয়াজ ইবনে জাবল, খালিদ বিন ওয়ালিদ, আবদুর রহমান ইবনে শিহাব, আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) প্রমুখসহ ৬৫ জন সাহাবীর কাছে কোরআনের সব সূরা লিখিত আকারে ছিল। অর্থাৎ পুরো কোরআনই নবীজীর (স.) জীবদ্দশায় সূরা আকারে বিন্যস্ত ও লিপিবদ্ধ অবস্থায় ছিল; শুধু একত্রে ‘মসহাফ’ আকারে গ্রন্থিত হয়নি।
নবীজীর (স.) ওফাতের পরই আরবের বিভিন্ন এলাকায় ভণ্ড নবীর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এদের বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে বহু হাফেজ শহিদ হন। তখন হযরত ওমরের (রা.) পরামর্শ ও অনুরোধে প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) পবিত্র কোরআনকে একত্রে গ্রন্থাকারে সংকলনের উদ্যোগ নেন। রসুলুল্লাহর (স.) সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কাতিব জায়েদ বিন সাবিতকে প্রধান করে হযরত আবু বকর (রা.) একটি টিমকে এ-কাজের দায়িত্ব দেন।
খলিফা ফরমান জারি করেন যে, যার কাছে কোরআনের যে অংশ লিখিত আছে, তা জায়েদের কাছে হাজির করতে হবে। জায়েদ একইসঙ্গে হাফেজ ও কাতিব ছিলেন। তিনি শুধু নিজের স্মৃতি ও লেখার ওপর নির্ভর করেননি। তিনি তার কাছে লিখিত প্রতিটি আয়াতের সমর্থনে দুজন করে কাতিবের লেখার সঙ্গে তা মিলিয়েছেন এবং সেই কাতিব যে রসুলুল্লাহর (স) সামনে এই আয়াত লিপিবদ্ধ করেছেন, তার সপক্ষে দুজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। একইসঙ্গে সেই আয়াত দুজন হাফেজ একইভাবে মুখস্থ করেছেন কি না এবং তিনি যে রসুলুল্লাহর (স.) সামনে সেই আয়াত শুনে মুখস্থ করেছেন, তার সপক্ষে দুজন সাক্ষী তলব করেছেন। রসুলুল্লাহ (স.) যে রকম নির্ভুলভাবে আল্লাহর কালামকে পেশ করেছেন, সংকলনের ক্ষেত্রেও সাহাবীরা ছিলেন একইরকম আন্তরিক ও সত্যনিষ্ঠ। গ্রন্থাকারে সংকলন যাতে নির্ভুল হয়, সেজন্যে তারা সবরকম সতর্কতাই গ্রহণ করেছিলেন।
রসুলুল্লাহর (স.) জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ কোরআন আর জায়েদ বিন সাবিতের নেতৃত্বে সংকলিত এই মসহাফের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে যে, রসুলুল্লাহর (স.) সময় কাগজ, চামড়া, পাথর, খেজুর পাতা—যা পাওয়া গেছে তাতেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে আর মসহাফে একই সাইজের কাগজে লিপিবদ্ধ করে একটার পর একটা কাগজ সাজিয়ে ওপরে-নিচে শক্ত মলাট দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছে। শক্ত মলাট দিয়ে বাঁধাই করার কারণেই এর নামকরণ হয়েছে ‘মসহাফ’। মসহাফ তৈরি হওয়ার পর সাহাবীরা সর্বসম্মতভাবে একে সঠিক বলে সত্যায়িত করেন এবং হযরত আবু বকরের (রা.) কাছে সংরক্ষণের জন্যে পেশ করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় মহাফেজখানায় তা সংরক্ষণ করেন।
রসুলুল্লাহর (স.) ওফাতের একবছরের মধ্যেই পুরো কোরআন একত্রে গ্রন্থাকারে সংকলনের এই কাজ সম্পন্ন হয়। হযরত আবু বকরের (রা.) পর হযরত ওমর (রা.) এই মসহাফ সংরক্ষণ করেন। তার সময় খেলাফতের সীমানা পারস্য থেকে লিবিয়া এবং আরব সাগর থেকে আজারবাইজান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। তিনি এই বিশাল অঞ্চলে অভিন্ন উচ্চারণ ও বাক্-রীতিতে পবিত্র কোরআন পঠনপাঠনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পুরো কার্যক্রম তদারকির জন্যে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবু মুসা আশয়ারী, মুয়াজ ইবনে জাবলসহ ১০ জন বিশিষ্ট সাহাবীকে খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। হযরত ওমরের (রা.) মৃত্যুর পর এই মসহাফ তার কন্যা ও উম্মুল মোমেনিন হযরত হাফসা-র (রা.) হেফাজতে সংরক্ষিত হয়।
তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের (রা.) সময় খেলাফতের আরও বিস্তৃতি ঘটে। তিনি সব অঞ্চলে অভিন্ন পঠনপাঠনরীতি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কোরআনের কপি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি হযরত হাফসা-র (রা.) কাছে সংরক্ষিত মসহাফ চেয়ে পাঠান। তিনি কোরাইশদের পঠন ও লিখনরীতি অনুসারে মসহাফের কপি করার জন্যে প্রধান কাতিব জায়েদ বিন সাবিত, আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর, সাঈদ ইবনুল আস, আবদুর রহমান ইবনে হারিস, উবাই ইবনে কাবসহ ১২ জন সাহাবীর একটি টিম গঠন করেন। তারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নির্ভুলভাবে এই মসহাফের কপি করেন। হযরত উসমান (রা.) একটি কপি নিজের কাছে এবং একটি মদিনার মহাফেজখানায় রেখে অবশিষ্ট কপিগুলো সত্যায়ন করে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তাদের কাছে প্রেরণ করেন। আর মূল কপি ফেরত পাঠান হযরত হাফসা-র (রা.) কাছে।
হযরত উসমানের (রা.) সময় কপি করা হয়েছিল বলে ইতিহাসে এ মসহাফ পরিচিতি লাভ করে ‘মসহাফে উসমানী’ নামে। মসহাফে উসমানী-র সত্যায়িত একটি কপি এখনও সংরক্ষিত আছে মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তানের তাসখন্দ মিউজিয়ামে। দামেস্কে প্রেরিত মসহাফের অবিকল প্রতিলিপি সংরক্ষিত আছে তুরস্কে ইস্তাম্বুলের টপকাপি মিউজিয়ামে ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে। হরিণের চামড়ায় তৈরি কাগজে এই মসহাফের প্রতিলিপি সংরক্ষিত আছে মিশরের দারুল কুতুব সুলতানিয়ায়।
মসহাফে উসমানী বিভিন্ন স্থানে প্রেরিত হওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোরআন কপি করার প্রচলন শুরু হয়। শতাব্দী পরিক্রমায় কোরআনের হাজার হাজার কপি সর্বত্র প্রচার লাভ করে। ইসলামের ইতিহাসের সব যুগের কপি করা কোরআনের পাণ্ডুলিপির বিশাল সংগ্রহ রয়েছে ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, আয়ারল্যান্ডের চেস্টার বিয়াটি মিউজিয়াম ও ইংল্যান্ডের লন্ডন মিউজিয়ামে। এসব পাণ্ডুলিপির সঙ্গে তাসখন্দ মিউজিয়াম, ইস্তাম্বুলের টপকাপি মিউজিয়াম ও মিশরে কায়রোর আল-হোসেন মসজিদে সংরক্ষিত মসহাফ মিলিয়ে দেখা গেছে যে, মূল মসহাফের লিখনের সঙ্গে এগুলোর কোথাও কোনও অমিল নেই।
জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের The Institute for Koranforschung হাতে লেখা ৪২ হাজার কপি পূর্ণ বা আংশিক কোরআন সংগ্রহ করে। দীর্ঘ ৫০ বছর গবেষণা করার পর ইনস্টিটিউট এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, পাণ্ডুলিপি পাঠে কোনও পার্থক্য নেই। দুর্ভাগ্যবশত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমাবর্ষণে ইনস্টিটিউটটি ধ্বংস হয়ে যায়।
আল্লাহর অনুগ্রহ আর সাহাবীদের আন্তরিক ও বস্তুনিষ্ঠ প্রয়াসের ফলে নাজিল হওয়ার সময় যেভাবে পঠিত হয়েছে, ১৪ শত বছর ধরে সারা পৃথিবীর ঘরে ঘরে এই একই কোরআন সেভাবেই পঠিত হচ্ছে। কোরআন একমাত্র ধর্মগ্রন্থ, যা তার মূল ভাষাকে ধরে রেখেছে এবং মূল ভাষাতেই পঠিত ও চর্চিত হচ্ছে। সেই একই কোরআন। ১১৪টি সূরা। ৬ হাজার ২৩৬টি আয়াত।
কালের বিবর্তনে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে কোরআনের লেখ্যরূপ বিবর্তিত হয়েছে। মসহাফে উসমানী লেখায় নোকতা, জের, জবর, পেশ ইত্যাদির কোনও ব্যবহার ছিল না। সাধারণ আরবি লেখায় এখনও ওপরে বা নিচে বর্ণ পার্থক্যকারী কোনও চিহ্ন ব্যবহৃত হয় না। আরবরা শব্দের গঠন দেখেই বর্ণের উচ্চারণ করে। আর বাক্যের গঠন দেখেই আরবরা হ্রস্ব-স্বর উচ্চারণে পার্থক্য করে নেয়। হযরত ওমরের (রা.) সময় খেলাফত অন্য ভাষাভাষী অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়। হযরত উসমান (রা.) ও হযরত আলীর (রা.) সময় খেলাফত আরও ভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করে। বর্ণ ও পাঠসহায়ক চিহ্ন ছাড়া কোরআন পাঠে ভবিষ্যতে তারা ব্যাপক ভুলত্রুটির শিকার হতে পারে, এই আশঙ্কা দেখা দেয়। হযরত আলী (রা.) বিশিষ্ট ভাষাবিদ আবুল আসাদ দোয়েলীকে বিষয়টি সুরাহা করার দায়িত্ব দেন। তিনি মসহাফে উসমানী-তে তাশকিল অর্থাৎ পাঠসহায়ক জের, জবর, পেশ ব্যবহার করেন। বর্ণপরিচায়ক নোকতা ব্যক্তিগত মসহাফে প্রথম ব্যবহার করেন হযরত হাসান আল বসরী ও আল্লামা ইবনে শিরিন। আবুল আসাদ দোয়েলী ও তার ছাত্র নসর ইবনে আসিম ও ইয়াহিয়া ইবনে আমর ৫০ হিজরিতে কোরআন লেখায় ‘বর্ণপরিচায়ক’ নোকতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মসহাফে ব্যবহার করেন। ৬০ হিজরিতে খলিফা আবদুল মালেকের নির্দেশে সব মসহাফে বাধ্যতামূলকভাবে নোকতা ও তাশকিল প্রয়োগের কাজ সুসম্পন্ন হয়।
কোরআনের প্রাথমিক কপি মসহাফে উসমানী-তে কোনও সূরার আগে সূরার নাম লেখা হয়নি। রেখা টেনে বা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমকে আলাদা করে ওপরের লাইনে লিখে এক সূরা থেকে আরেক সূরাকে পৃথক করা হয়নি। আয়াতগুলোও কোনও চিহ্ন বা সংখ্যা দিয়ে আলাদা করা হয়নি। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক লিখে যাওয়া হয়েছে। হিজরি প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে সূরার ওপর সূরার নাম এবং ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ওপরের লাইনে আলাদা লেখার এবং দুই আয়াতের মাঝে চিহ্ন বা সংখ্যা দেওয়ার পদ্ধতি চালু হয়।
হিজরি দ্বিতীয় শতকের প্রথমভাগে প্রতিদিন সমপরিমাণ তেলাওয়াত করে সাত দিনে পাঠ সম্পন্ন বা খতম করার সুবিধার জন্যে কোরআনকে ‘সাত মনজিলে’ ভাগ করা হয়। প্রতিবার তেলাওয়াতের হিসাব রাখার সুবিধার্থে হিজরি দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধে কোরআনকে ৫৫৮ ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগের নাম দেয়া হয় রুকু। ৩০ দিনে কোরআন খতম করার সুবিধার্থে কোরআনকে ৩০ পারায় ভাগ করা হয় হিজরি তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমার্ধে। আর হাজার বছর ধরে কোরআনের এই লিখিত রূপই চালু রয়েছে সারা বিশ্বে।
কোরআনের আয়াতমালা অবিকৃত ও বিশুদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছে একে মুখস্থ রাখার সহজাত আগ্রহ। রসুলুল্লাহর (স.) জীবন হচ্ছে কোরআনের শিক্ষার প্রতিচ্ছবি। আর কোরআন নাজিল হয়েছে ২৩ বছর সময় নিয়ে। তিনি শুধু কোরআন শিক্ষাই দেননি। পুরো কোরআন তার মুখস্থ ছিল। তাকে অনুসরণ করে কোরআন মুখস্থ করতে সাহাবীদের আগ্রহের কোনও অভাব ছিল না। হযরত আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আবু হুরায়রা, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ বিন আমর, হযরত আয়েশা, হযরত হাফসা, হযরত উম্মে সালমা (রা.) প্রত্যেকেই হাফেজ ছিলেন। পুরো কোরআন তাদের মুখস্থ ছিল। রসুলুল্লাহর (স.) জীবদ্দশায় মদিনাতেই হাফেজের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়।
সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ীদের জীবন আবর্তিত হয়েছে কোরআনকে ঘিরে। তারা কোরআন মুখস্থ করেছেন, কোরআনের জ্ঞানে নিজেরা জ্ঞানী হয়েছেন এবং অন্যকে কোরআনের জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে। আর দিনে পাঁচ বার কোরআনের মুখস্থ করা অংশ থেকে তেলাওয়াত করা তো নামাজ কায়েমের জন্যে বাধ্যতামূলক। আবার রাতে দীর্ঘসময় নামাজে দীর্ঘ সূরা পাঠ পরিণত হয় অনেকের দৈনন্দিন অভ্যাসে। সেই যুগে এমন কোনও শিক্ষিত পরিবার ছিল না, যেখানে অন্তত একজন হাফেজ ছিলেন না।
কালের বিবর্তনে কোরআন মুখস্থ করা শিক্ষার একটি অংশে পরিণত হয়। হাজার হাজার হিফজখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কোরআন নাজিলের ১৪ শত বছর পরও কোরআন মুখস্থকারীর সংখ্যা কোনোভাবেই হ্রাস পায়নি, বরং বেড়েছে। মুসলমানদের এমন কোনও পাড়া বা মহল্লা নেই, যেখানে আরব-অনারব, কালো-সাদা, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ কেউ না কেউ কোরআন মুখস্থ পারেন না। এই হিফজ শিক্ষার শুরু রসুলুল্লাহ (স.) থেকে। তার মাধ্যমে শিখেছেন সাহাবীরা। আর তাদের সত্যায়িত প্রক্রিয়াতেই এখনও প্রতি বছর হিফজ করছেন হাজার হাজার হাফেজ।
দুনিয়ায় অনেক ধর্মগ্রন্থ রয়েছে— তাওরাত, জিন্দাবেস্তা, উপনিষদ, বেদ, বাইবেল, গীতা, ধম্মপদ। আছে অনেক সেক্যুলার গ্রন্থ—দর্শন, কাব্য, উপন্যাস। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, এই গ্রন্থ ও রচনাবলির কতটা কতজন মুখস্থ বলতে পারবেন? খোঁজ করলে কদাচিৎ দুই-একজনকে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু যদি কোরআন মুখস্থকারীর সংখ্যা জানতে চান, তবে এ সংখ্যা হবে লাখ লাখ। আর এই লাখ লাখ হাফেজের স্মৃতিতে সংরক্ষিত কোরআন এবং মসহাফে উসমানী থেকে কপি করা মুদ্রিত কোটি কোটি কোরআন একই কোরআন। সংরক্ষণ ও বিশুদ্ধতায় কোরআন এ ক্ষেত্রে অনন্য।
এই বাস্তবতা ও ঐতিহাসিক তথ্যই প্রমাণ করে কোরআনে প্রদত্ত আল্লাহর অঙ্গীকারের সত্যতা: ‘নিশ্চয়ই আমি এই কোরআন (ধাপে ধাপে) নাজিল করেছি এবং (সব প্রকার বিচ্যুতি থেকে) আমি একে রক্ষণাবেক্ষণ করব।’ (সূরা হিজর: ৯)