রুপপুর প্রসঙ্গ: তদন্তের আগেই চরিত্র হনন
প্রকৌশলী শেখ তাজুল ইসলাম তুহিন
প্রকাশিত : ০৮:১২ পিএম, ২৩ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৮:৪১ পিএম, ২৩ মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার
দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্রিনসিটি প্রকল্পে ২০ ও ১৬ তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনা এবং ভবনে উঠানোর কাজে অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিভিন্ন মিডিয়া থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোচনা হচ্ছে। মূল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো বালিশ উঠানোর দর নিয়ে। এই বালিশগুলো রাশিয়ান নাগরিকদের জন্য কেনা হচ্ছিল যারা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করার জন্য এখানে থাকবেন। দরপত্র আহবান করা হয়েছিল এক বছর আগে পাবনা জেলার গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৗশলীর দপ্তর থেকে।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে এ ঘটনা তদন্তের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়ার প্রেক্ষিতে গণপূর্তের রাজশাহী বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে ইতোমধ্যেই একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এরপর, মন্ত্রণালয় নিজেরাও একটি কমিটি করেছে। আবার, এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য দেশে স্বাধীন সংস্থা হল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কেনাকাটায় দুর্নীতির বিষয়টিতে নজর রাখছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। এই দুর্নীতি নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টেও জনস্বার্থে একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছেন।
এরকম অবস্থায় কথা হলো দুর্নীতি হয়েছে কি হয়নি? দরপত্রে দুর্নীতি হয়েছে কি হয় নাই তা চট করেই বলা সমুচিত হবে কি না? পুরো বিষয় না জেনে অথবা তথ্য প্রমান ছাড়াই এই ক্রয় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করতে পারি কি না? একটা পত্রিকার রিপোর্ট পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই লম্ফজম্ফ শুরু করে দিতে পারি কি না? তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কি আমরা অপেক্ষা করতে পারি না।
গণপূর্ত অধিদপ্তর (PWD) সরকারের সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ প্রকৌশল সংস্থা। সর্বশেষ প্রকৌশল প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের সর্বোত্তম প্রয়োগের দ্বারা পরিবেশ বান্ধব, নিরাপদ ও টেকসইভাবে সকল প্রকার সরকারি দপ্তর, বাসভবন ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ এবং সরকারি কেপিআই স্থাপনাসমূহ সহ সকল প্রকার সরকারি অবকাঠামো সমূহের সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ কাজ নিশ্চিত করার জন্য এই অধিদপ্তর নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। পিডব্লিউডির অবদানের মধ্যে রয়েছে জাতীয় উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য সকল ধরনের ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মান। এর কার্যক্রম দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রায় সকল সরকারী অবকাঠামো প্রকল্পের স্থাপত্য পরিকল্পনা ও নকশা, গণপূর্ত অধিদপ্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরামর্শক্রমে স্থাপত্য অধিদপ্তর করে থাকে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রায় সকল কেনা কাটাই এখন অনলাইনে অর্থাৎ ইলেকট্রনিক গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্ট (e-GP) এর মাধ্যমে অনলাইনে হয়ে থাকে এবং এই ক্রয় কার্যক্রম সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিমালা অনুযায়িই করা হয়। আলোচ্য দরপত্রে প্রতিটি আইটেমের স্পেসিফিকেশন এবং ওই আইটেমের কোয়ান্টিটি (পরিমাণ) লিখে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি (OTM) তে e-GP মাধ্যমে আহ্বান করা হয়েছিল। তার নোটিশ CPTU এর ওয়েবসাইট এবং জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যোগ্যতা সম্পন্ন যেকোন ঠিকাদারদের অনলাইনে এই টেন্ডার সাবমিট করার সুযোগ ছিল। এখানে যোগসাজসে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে টেন্ডার নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিমালা অনুযায়ি এখানে কাজ পাবেন সর্বনিম্ন দরদাতা বা ঠিকাদার।
আমার এই লিখাটার উদ্দেশ্য হলো এখানে বিভিন্ন মিডিয়া থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে। তদন্ত চলাকালীন-ই বিভিন্ন সংবাদপত্র, প্রচার মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যেই একজন ব্যক্তি বিশেষের চরিত্র হনন শুরু হয়েছে। শুধুমাত্র সংবাদের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা যায় না। এর অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন। আমরা সবাই যদি একই জিনিস নিয়ে কাজ করতে থাকি তাহলে তা কতটা ভালো দেখায় ???
সরকারি ক্রয় কার্যক্রম কোন বিজ্ঞান (Science) নয়, এটা একটা কলা (Arts)। সরকারি ক্রয়ের ক্ষেত্রে মূলনীতি গুলো হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সমান সুযোগ, প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি নিশ্চিত করা। আলোচ্য দরপত্রে এগুলো করা হয়েছে কি না তা যাচাই করা প্রয়োজন আগে। এক্ষেত্রে দূদকের তদন্তের পাশাপাশি সরকারি ক্রয়ে অভিজ্ঞ প্রফেশনালদের অভিমত নেয়াও প্রয়োজন।
দরপত্রে সঠিক মূল্য প্রতিফলন হওয়া অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সরবরাহকারীদের প্রস্তুতি, দরদাতাদের অংশগ্রহন, সঠিক প্রাক্কলন, পণ্যের গুনগন মান, কারিগরি বিনির্দেশ, ওয়ারেন্টি, সংশ্লিষ্ট ভ্যাট, ট্যাস্ক, Hidden cost, পরস্পরের মধ্যে যোগসাজস, মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ, ইত্যাদি। সামগ্রিক বিষয় না জানা পর্যন্ত শুধু কয়েকটি আইটেমের Unit Rate দেখে কোন মন্তব্য করা সমীচিন হবে না বলে আমি মনে করি। স্বাভাবিক দরদামের চেয়ে বেশি দামে কেনাকাটা করা হলে তা অবশ্যই অস্বাভাবিক ও অনিয়মের মধ্যে পড়ে। তবে আন্তর্জাতিক কোনো ‘রেট’ এখানে প্রযোজ্য কিনা সেটাও দেখতে হবে।
এখানে আসল সুযোগ সন্ধানীদের খুঁজে বের করতে হবে। জানা যায়, এই টেন্ডারের ক্রয়কারী নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মাছুদুল আলম দরপত্রটির মূল্যায়ন কমিটিতেই ছিলেন না। কাজেই অস্বাভাবিক দরে যদি কোন টেন্ডার কাউকে দেয়ার সুপারিশ করা হয় সেক্ষেত্রে তিনি কিভাবে দায়ী হলেন? সরকারি ক্রয় করা হয় PPR অনুযায়ি, ফলে তার এখানে কিছুই করণীয় নেই। কাজেই কে দায়ী তা নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত প্রকৌশলী মোঃ মাছুদুল আলমকে ব্যক্তিগতভাবে হেয় করে যেভাবে সামাজিক মাধ্যমে পোষ্ট দেয়া বা বিরূপ মন্তব্য করা, হেনস্থা করা হচ্ছে তা কোনভাবেই কাম্য নয়। দোষী প্রমাণিত হওয়ার আগেই কাউকে ঢালাওভাবে, ব্যক্তিগত ভাবে এবং সামাজিকভাবে অপমান করার অধিকার আমাদের নেই। সঠিক তদন্ত ব্যতিত media trial দ্বারা আসল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নিরাপরাধ কাউকে ঢালাওভাবে দোষী সাব্যস্ত করাও একটা অপরাধ। আশা করছি গণপূর্ত অধিদপ্তর খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করবে।
আমাদের প্রত্যেককেই যার যার স্থান থেকে প্রফেশনাল আচরণ করা প্রয়োজন। দোষী সাব্যস্থ হওয়ার পূর্বেই কারও ব্যক্তিগত এবং সামাজিক মর্যাদা ব্যাপকভাবে প্রশ্নের মুখোমুখি করে তোলা আমাদের উচিত হবে না। তাহলে এর চেয়ে বড় তামাশা আর কিছুই হতে পারে না। অনুমাননির্ভর কোনো তথ্যের ভিত্তিতে কারও চরিত্রহনন হোক - এটা যেমন কাম্য নয়; তেমনি যদি কারও কারসাজিতে এরকম হয়ে থাকলে তারা পার পেয়ে যাবে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে তাও হতে দেয়া যায় না। কিছু মানুষের অতি উৎসাহ এবং কিছু অতি তৎপরতায় তদন্তের গতিপথ বদলানো ঠিক হবে না।
শেষ কথা হচ্ছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটি সরকার তথা দেশের জন্য অনেক গূরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প। এর সাথে একাধিক বন্ধুরাষ্ট্র জড়িত। এটা জাতীয় বিষয়, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প বহুদিন ধরে চলছে। কিন্তু এটার বাস্তবায়নের কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্ব ও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রকল্পের সফলতা সরকারকে আরও বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহনের সাহস জোগাবে।
এই প্রকল্পের বেতন-ভাতা নিয়েও অভিযোগ উঠেছিল যা পরে ভূয়া প্রমাণিত হয়েছে। বালিশের ক্ষেত্রে এরকম একটা পরিস্থিতি তো হতেও পারে। কাজেই এ বিষয়ে পুরোটা না জেনে চূড়ান্ত মন্তব্য না করাই উচিত হবে।
লেখক: সেক্রেটারী, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিভিশন-ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (আইইবি)
বিদ্র: লেখকের মতামত তার নিজস্ব।