ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

বিবিসির বিশ্লেষণ

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের তাৎপর্য কী?

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৯:৪৮ এএম, ২৪ মে ২০১৯ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৫৬ এএম, ২৪ মে ২০১৯ শুক্রবার

এবার ভারতের নির্বাচনে প্রধান প্রশ্ন ছিল দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি আবার ক্ষমতায় ফিরবে কি না! আর তারপরেই যে প্রশ্ন নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে, তাহলো বিজেপি কি পশ্চিম বাংলায় মমতা ব্যানার্জীর শক্ত দুর্গে ফাটল ধরাতে পারবে?

আজ দুই প্রশ্নের উত্তরই আমাদের সামনে- আগামী পাঁচ বছর মোদির বিজেপি সরকার ভারতের ভাগ্য বিধাতা, আর মমতার দুর্গ দখল করতে না পারলেও বড় ফাটল ধরিয়েছে বিজেপির গৈরিক বাহিনী।

এবারের নির্বাচনে মোদি এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর জনসভা করেছেন- ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী এই রাজ্যে, এমনকি বিধান সভা নির্বাচনের আগেও, এতো জনসভা করেননি।

আর প্রত্যেকটি জনসভায় মোদি মমতাকে ‘স্পিডব্রেকার দিদি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। বলেছেন, ‘আপনার জামানা শেষ হয়ে আসছে।’

কিন্তু সারা দেশে যখন মোদি সুনামি, পশ্চিমবঙ্গে মমতা যেভাবেই হোক না কেন, নিজের জমি অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছেন। অর্ধেকের বেশি আসন তার দলের দখলে। তাই সেই অর্থে উনি সত্যি ‘স্পিডব্রেকার’।

তবে মোদির বিরুদ্ধে মমতা যত বড় গলা করে বলেছিলেন ‘৪২ এ ৪২’, অর্থাৎ রাজ্যের সবকটি লোকসভা আসনে তৃণমূলের জয় হবে, তা ফলের পরে খুবই ঠুনকো লাগছে। মনে হচ্ছে, খানিকটা হলেও আত্মতুষ্টিতে ভুগছিলো তৃণমূল কংগ্রেস।

বলা বাহুল্য, বিজেপির অভাবনীয় সাফল্যের গুরুত্ব পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির জন্য অপরিসীম - মূলত তিন কারণে।

১. বাংলা ভাগ ধর্মের ভিত্তিতে হলেও ১৯৪৭-এর পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলো কোনদিন মাটি পায়নি। হিন্দুসভার প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী একজন বাঙালি, কিন্তু তার দল অথবা পরে ভারতীয় জনসংঘ অথবা বিজেপি, কেউই পশ্চিমবঙ্গে কিছু করতে পারেনি।

প্রথমে কংগ্রেস (১৯৪৭-৭৭), তারপর সিপিএমএ’র নেতৃত্বে বামফ্রন্ট (১৯৭৭-২০১১), এরপর ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের সবাই বলিষ্ঠভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি করেছে, যার ফলে বিজেপি নেতাদের অনেকেই আজ মমতা ব্যানার্জীকে তির্যক ভাষায় ‘মমতাজ বেগম’ বলে থাকেন। আর তার বিরুদ্ধে বারবার ওঠে মুসলিম তোষণের অভিযোগ।

বিজেপি এতগুলো লোকসভা আসন জিতে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতার জন্য শুধু জোরালো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে তাই নয়, তার চেয়েও বেশি হলো এই প্রথম পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে আবার ধর্মীয় রাজনীতির গৈরিক পতাকার ছড়াছড়ি দেখা যাবে। এখানকার রাজনীতির ভাষায় ধর্মীয় প্রভাব দেখা যাবে- ধর্ম আর ঠাকুরঘরে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে।

২. ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষও ভারতের রাজনৈতিক নকশায় একটা ব্যতিক্রমী রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল। বামপন্থী আদর্শের পেছনে বাংলার একটা আলাদা রাজনৈতিক পরিচয় গড়ে উঠেছিল, পশ্চিমবঙ্গ পরিচিত হয়ে উঠেছিল ভারতের ‘লাল দুর্গ’ হিসেবে। অনেকে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টকে ‘বেঙ্গলি কমিউনিজম’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

তৃণমূল সেই দুর্গ গুড়িয়ে দিলেও বাংলা একটা আলাদা রাজনৈতিক পরিচয় বজায় রাখে তার আঞ্চলিকতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সেই আলাদা জায়গাটা খেয়ে দিয়েছে বিজেপি।

১৯৭৭ এর পর এই প্রথম বাংলায় কোনও জাতীয় দল এতটা জমি দখল করতে পেরেছে। আর তৃণমূল নেতা ও বর্ষীয়ান সম্পাদক চন্দন মিত্র তো আশঙ্কায় বলেই ফেললেন, বিজেপি ইজ এ গভর্নমেন্ট ইন ওয়েটিং, অর্থাৎ বিজেপি তো মনে হচ্ছে আগামী দিনে বাংলায় সরকার গড়তে চলেছে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের মতে, এটা পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটা বড় বিপর্যয়। উনি বললেন, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির দখলে যাওয়া মানে বাংলার ভাগ অবশেষে সবদিক থেকে পূর্ণ হওয়া।

বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ দখল মানে এই রাজ্য এখন ভারতের মূল স্রোতে- সব অর্থে না হলেও অনেক অর্থে। তার ভিন্ন আর কোনও রাজনৈতিক পরিচয় থাকবে না- তবে তাতে অর্থনীতির কত লাভ হবে, সমাজ জীবনে কী পরিবর্তন হবে, এখুনি বলা মুশকিল।

৩. এবারের নির্বাচনে যেভাবে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষ ঘটেছে, বুথে বুথে বোমা-বন্দুক চলেছে, যে ভাষায় মোদি আর মমতা একে অপরকে আক্রমণ করেছেন, বলাবাহুল্য তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংঘাত আরও বাড়বে।

বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ্ বারবার বলেছেন, বিজেপি ক্ষমতায় আসলে আসামের কায়দায় পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিক পঞ্জি (ন্যাশনাল রেজিস্টার ফর সিটিজেনস বা এনআরসি) করা হবে- যার উদ্দেশ্য বাংলাদেশ থেকে আসা ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা’ এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া।

আসামে এ নিয়ে নাগরিক পঞ্জির খসড়ায় (ড্রাফট এনআরসি) প্রায় ৪০ লাখ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের নাম বাদ পড়েছে, প্রায় ৪০ জন আত্মহত্যা করেছেন।

মমতা প্রথম থেকে বলেছেন, তার রাজ্যে এনআরসি করতে দেওয়া হবে না। এখন বিজেপি আর কেন্দ্রীয় সরকার তা করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার দিকে এগোবে—এমনটা অনেকেই মনে করছেন।

তাতে রাজনৈতিক ছকও থাকবে- নাগরিক পঞ্জি থেকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে সংখ্যালঘুদের অনেককেই বাদ দিতে পারলে, আর তারপর কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণে নির্বাচন করলে, বিজেপির জয় নিশ্চিত বলে বিজেপি নেতাদের অনেকেরই ধারণা।

অভিনেত্রী ও বিজেপি নেত্রী রূপা গাঙ্গুলী বলেন, এবার তৃণমূল মারামারি করতে না পারলে বিজেপি কম করে ৩০টি আসন পেত।

বিজেপির রাহুল সিনহা বললেন, ছয় মাসের মধ্যে আমরা তৃণমূল সরকার ফেলতে পারব, ওদের অনেক নেতাকর্মী আমাদের দিকে চলে আসবে- যেমনটা এসেছেন মমতার একদা সেনাপতি বলে পরিচিত মুকুল রায়।

নির্বাচন ও বাংলাদেশ

এবার ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশ বার বার বিজেপির প্রচারে এসেছে। নেতিবাচকভাবেই। বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র বলে থাকলেও এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াতে হবে’ এমন জিগির তুলেছেন।

মমতা তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের জন্য সমস্যা তৈরি করলেও জোরালোভাবে এই অনুপ্রবেশের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, বলেছেন এটা বিজেপির ধর্মান্ধ রাজনীতির একটা সস্তা রণকৌশল।

এনআরসি বা নাগরিক পঞ্জি উনি যে কোনও মূল্যে রুখবেন বলে মোদিকে হুঁশিয়ার করেছেন, ‘বিবাদের রাজনীতি ভারতের ক্ষতি করছে’ বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।

বিজেপির এই বাংলাদেশ বিরোধীতা সাধারণভাবে দুই বাংলার মানুষের মধ্যে সমস্যা তৈরি করেছে বলে মনে করেন সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের আত্মসম্মানে আঘাত করেছে বিজেপি। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বোঝে না, সবটাই হিন্দু-মুসলিম হিসেবে দেখে।

‘এতে বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মনোভাব বাড়বে, আর এর জন্য দায়ী হবে মোদি-অমিত শাহ আর তাদের বাঙালি চামচারা।’

ভারতের গোয়েন্দা ব্যুরোর প্রাক্তন কর্মকতা সুবীর দত্ত মনে করেন, ভারত এবং পশ্চিমবাংলায় বিজেপি বাড়লে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। তাতে করে আওয়ামী লীগ- যারা ভারতের চরম বন্ধু- বেকায়দায় পড়বে। তাতে আখেরে ভারতের খুব ক্ষতি হবে।

‘আর এনআরসি’র মত বিষয় নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক খারাপ হলে তাতে সবচেয়ে বেশি লাভ হবে চীনের,’ বললেন সুবীর দত্ত, যিনি বাংলাদেশের ঘটনাবলির ওপর বহুকাল নজর রেখেছেন। 

সূত্র: বিবিসি

একে//